Web bengali.cri.cn   
বি শু মিন ও তাঁর নতুন উপন্যাস 'করোলা ভাইরাস'
  2012-05-29 21:29:55  cri

 ২০১২ সালের বসন্তকালে প্রকাশিত চীনের বিখ্যাত লেখিকা বি শু মিনের নতুন উপন্যাস 'করোলা ভাইরাস' মানসিক বিপর্যয়ের ওপর দৃষ্টি রেখে বর্তমান সমাজে মানসিক সংকট মোকাবিলার উপায় অন্বেষণ করেছে। তিনি চিকিত্সকের মন ও মনস্তত্ত্ববিদের বুদ্ধি দিয়ে আমাদের কীভাবে নিজের মানসিক শক্তি সংহত করে তথাকথিত ভবিষ্যত মহাপ্রলয়ের দুর্যোগ প্রতিরোধ করতে হবে তা জানিয়েছেন। বন্ধুরা, আজকের এ আসরে আমরা লেখিকা বি শু মিনের সর্বশেষ উপন্যাস 'করোলা ভাইরাসের' মাধ্যমে মানুষের প্রাণের চূড়ান্ত তাত্পর্য নিয়ে আলোচনা করবো।

চীনা লেখক বি শু মিন

চিকিত্সকের মূর্তি ও কাহিনী হচ্ছে বি শু মিনের উপন্যাসের এক অদ্বিতীয় চিহ্ন। তাঁর আগের লেখা 'লাল ব্যবস্থাপত্র', 'রক্ত লিংলোং', 'স্তন উদ্ধার' আর 'নারী মনস্তত্ত্ব ডাক্টার'ই হোক, আর সম্প্রতি প্রকাশিত 'করোলা ভাইরাস' হোক, তিনি সবসময় চিকিত্সকের আহতদের চিকিত্সা করা এবং মৃতপ্রায় ব্যক্তিদের বাঁচিয়ে তোলার আবেগ আর লেখকের চেতনা সংযুক্ত করে তাঁর সাহিত্য কর্মের মধ্যে মূল্যবান প্রাণ আর দুর্বল মানসিকতার জন্য এক একটি ঔষধ তৈরি করেন। তাঁর নতুন উপন্যাস 'করোলা ভাইরাস' প্রসঙ্গে বি শু মিন বলেন,  'লেখক জীবন শুরুর আগে আমি বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ডাক্তার ছিলাম। ফলে মানুষের প্রাণের ওপর আমি অনেক মনোযোগ দিতাম। ২০০৩ সালে আমিও সার্স প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেছি। আমি এ উপন্যাস লেখার সময় তখনকার অভিজ্ঞতা আমাকে খুব সাহায্য করেছে। আমি মনে করি, ভাইরাস এক অতি প্রাচীন জীব। মানবজাতি হচ্ছে পৃথিবীতে সর্বোচ্চ শ্রেণীর জীব। কিন্তু মানবজাতি আর ভাইরাসের সংগ্রাম কখনো থেমে থাকেনি। এক অতি নিম্ন পর্যায়ের জীব অন্য এক সর্বোচ্চ পর্যায়ের জীবের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। আমরা পৃথিবীতে কীভাবে সকল জীবের সাথে সম্প্রীতিমূলক সহাবস্থান করতে পারি? আমরা কীভাবে পৃথিবীতে একটি আরো সুষম ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারি? এটা হচ্ছে আমার মনোযোগের বিষয়। আমি এটা নিয়ে আলোচনা করতে চাই বলে এ উপন্যাস লিখেছি।'

'করোলা ভাইরাসের' কেন্দ্রীয় মতাদর্শ হচ্ছে 'ভবিষ্যত বিশ্বে মানবজাতির মানসিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে সক্রিয়ভাবে মানসিক সংকট মোকাবিলার উপায় খুঁজে বের করা'। 'প্রাণকে মূল্য দেওয়া এবং সম্মান করা' হচ্ছে এ উপন্যাস রচনার ভিত্তি। বি শুন মিন আশা করেন, তাঁর লেখা লেখকের দায়িত্ববোধের দ্বারা প্রাণের প্রকৃতির কাছে আসতে পারে। নিজের প্রতিনিধিত্বশীল সৃষ্টি 'লাল ব্যবস্থাপত্র' আর এ নতুন উপন্যাস 'করোলা ভাইরাস'এর মধ্যে তুলনা করে বি শু মিন বলেন, 'যদিও লাল ব্যবস্থাপত্র লেখার সময় আমি কেবল মানবজাতির প্রাণকে ভালোবাসতাম। কিন্তু এখন আমি পৃথিবীর সকল প্রাণকে ভালোবাসি। আমি মনে করি, পৃথিবী কেবল মানবজাতির নয়। এটা হচ্ছে সব প্রাণীর দোলনা আর আমাদের অন্তিম পরিণাম।'

১৯৯৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বি শু মিন এক আকস্মিক সুযোগে জানতে পেরেছেন, হংকং চীনা ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব অধ্যাপক লিন মেং পিং পেইচিংয়ের নোর্মল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবেন। বি শু মিনের সর্বদাই মানুষের মনস্তত্ত্বের ওপর আগ্রহ আছে বলে তিনি রচনা কাজ অস্থায়ীভাবে বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে মনস্তত্ত্বের মাস্টার ও ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০২ সালে তিনি বন্ধুর সঙ্গে যৌথভাবে একটি মনস্তত্ত্ব ক্লিনিক খোলেন। ক্লিনিকে তিন বছর কাজ করার সময় তিনি অসংখ্য রোগীর সঙ্গে দেখা করেন। মনস্তত্ত্ব চিকিত্সক হওয়ার সময় এ বিষয় নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা তাঁর ছিল না। কিন্তু শত শত রোগী এসে তাঁর কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণের অনুরোধ জানানোর পর তিনি আর স্থির থাকতে পারেননি । তিনি বলেন,  'এক দম্পতি আমাকে বলেন, তাঁরা বিবাহবিচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে তাঁর আগে দু'জন নিজেদের বিয়েটি টিকিয়ে রাখতে চায়। তাঁরা প্রস্তাব করেন, আমরা বি শু মিনের ক্লিনিকে যাবো, দেখি তাঁর কাছে কোন উপায় আছে কিনা, যা দিয়ে আমাদের বিয়ে না ভেঙ্গে বরং বাঁচানো যায়। তারপর তাঁরা আমার ক্লিনিকে এসে নাম তালিকাভুক্ত করেন। তাঁর এসেছিলেন বসন্তকালে। কিন্তু শরত্কাল পর্যন্ত তাদের পালা আসেনি। তাঁরা প্রতি দিন সকালে ঘুম থেকে জেগে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করতেন আজ কি আমাদের পালা হবে? এ কথা শুনে আমার মন খুব ভারি হয়ে যেত। আমার তো কোন উপায় নেই। আমিতো একাই। এতো বেশি রোগী আছে, আমি কী করবো?'

২০০৪ সালে বি শু মিন দ্বিতীয় বার চিকিত্সকের জীবন ত্যাগ করে লেখকের জীবন শুরু করেন। সেই সালে তিনি 'নারী মনস্তত্ত্ব চিকিত্সক' নামের উপন্যাসটি লিখতে শুরু করেন। তিনি বলেন, 'আমি বিবেচনা করার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আবার লেখক হবো। আমি আমার সব চিন্তাভাবনা শব্দের দ্বারা প্রকাশ করবো। রচনাগুলো আমার কলম অথবা আমার কম্পিউটার থেকে ত্যাগ করার পর নিজের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রাণ বজায় থাকবে। তারা হাজার হাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে পাঠকের হাতে বা বালিশের পাশে যেতে পারে।'

বর্তমান সমাজে অনেক লোক বিভিন্ন জিনিস দেখে চোখ অন্ধ হয়ে দিক ও আদর্শ হারিয়েছে। হারিয়েছে সুখবোধ। কেউ কেউ বলেন, চীন হচ্ছে পৃথিবীতে মনস্তত্ত্ব চিকিত্সকের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় স্থান। বি শু মিন নিজের প্রয়াসের মাধ্যমে মানুষকে আত্মার বাড়ি খুঁজতে সহায়তা করতে চান। তিনি বলেন, 'প্রথমে আমি মনে করি, যারা মনস্তত্ত্ব চিকিত্সকের কাছে আসেন, তাঁরা পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন। তাঁদের নিজের জীবন নিয়ে গবেষণা করার সাহস আছে। আমি কখনো তাঁদেরকে আবর্জনা মনে করি না। দ্বিতীয়ত, প্রত্যক মানুষের জীবনে এমন হতবুদ্ধিকর সময় আসতে পারে। এমন সময়ে মানবের মৈত্রীর ওপর বিশ্বাস রাখতে পারলে, মনস্তত্ত্ববিদ্যাকে বিশ্বাস করতে পারলে, নিজের পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা বিশ্বাস করলে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ ও সহায়ক হয়। গত কয়েক বছরে আমি রোগীদের সঙ্গে বিনিময় করার সুযোগ পেয়েছি, সে অভিজ্ঞতা আমার জীবনের সম্প্রসারণ করেছে। আমি অনেক বেদনাদায়ক অবস্থা দেখার পাশাপাশি মনুষ্যত্বের অনেক সুন্দর বিষয়ও দেখেছি।'

'নীর স্বর্গ' হচ্ছে বি শু মিনের বিশ্ব ভ্রমণের পর লেখা মানসিক অভিজ্ঞতার বই। বইয়ের মধ্যে তিনি একাকী যাত্রায় মানুষের নিয়তি আর সুখী জীবনের চিন্তা বলেছেন। ছেলের সঙ্গে এ যাত্রার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, 'আমি তার সঙ্গে বাইরে যাওয়ার সময় গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি যে, আমরা দুই প্রজন্মের মানুষ, আমাদের অনেক পার্থক্য। যেমন আমরা ক্যারিবীয় সাগর অতিক্রম করার সময় আমি নীল সমুদ্র দেখে অতি সুন্দর মনে করি। সমুদ্রের পানি রেশমীর মতো সমতল। তখন আমার ছেলে আমার কাছে এসে জিজ্ঞাস করলো, তুমি কি মনে করো আমাদের সঙ্গে জলদস্যুদের মোলাকাত হবে? পরে আমি ভেবেছি, তারমনে কেন এমন সব ভাবনা আসে? আমি আশা করি, সমুদ্র সবসময় শান্ত ও শান্তিপূর্ণ থাকে। কোন জলদস্যুর সাথে মিলিত হতে চাই না। আমি মনে করি, সাধারণ মানুষ সব আমার মতো চিন্তা করে।'

বি শু মিন মনে করেন, যুবকদের কল্পনা থাকতে পারে। কিন্তু তাঁর ছেলের কল্পনা তাঁর ভাবনার বাইরে গেছে। তবে এ রকম ভাব বিনিময়ের সুযোগে বি শু মিন যুবকের মন স্পর্শ করতে পেরেছেন। তা থেকে প্রতিফিত হয়েছে যে, তাঁর পরিবারের সুষম পরিবেশ। তাঁর স্বামীও তাঁকে যথেষ্ঠ স্বাধীনতা দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'আমার স্বামী সাধারণত অপেক্ষাকৃত স্বল্পভাষী মানুষ। অনেক বিষয়ে আমার ও তার মতামতের মিল হয় না। আমি মনে করি, আমাদের দু'জনের একটি ভালো দিক হচ্ছে আমরা নিজের নিজের মত ও অবস্থান ব্যাখ্যা করতে পারি। ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে তো ভালো। নাহলে একজন আপোস করে। সাধারণত আমি আপোস করি।'

পৃথিবীতে টাকা পয়সা, বাড়িঘর, গাড়ি, রেশমী কাপড়চোপড় আর অন্য জনের মূল্যবান বস্তু আমরা সব সময় অধিকার করতে পারি। কিন্তু এ সব প্রাণ বাঁচানোর জন্য অপরিহার্য জিনিস নয়। তুমি কেবল কেন বেঁচে থাকা, নিজের নির্ধারিত চূড়ান্ত লক্ষ্য সবসময় মনে রাখা দরকার। অর্থাত্ আধুনিক মানুষের এক অবিচল লক্ষ্য বা জীবনের আদর্শ স্থাপন করা উচিত। বি শু মিন বলেন, 'আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষের দুটি দিক আছে। এক দিক শরীরবৃত্তের, আরেক দিক মনস্তত্ত্বের। আমরা চীনা মানুষ অতীতকালে শরীরবৃত্তের প্রয়োজনের ওপর বেশি মনোযোগ দিয়েছি। পেট ভরে খেয়েছে কিনা? গায়ে গরম কাপড় পরতে পেরেছে কিনা? কেমন বাড়িতে থাকতে পেরেছে? কী রকম গাড়ি আছে? কিন্তু চীন মোটামুটি খাওয়া-পরার পর্যায় থেকে সচ্ছল জীবনে রূপান্তরিত হওয়ার পর আমাদের সুখ ও আনন্দ আর শুধু শুধু এ সব দ্রব্য থেকে আসে না। মনে থেকে সৃষ্টি হয়। তোমার নিজস্ব সৃষ্টিক্ষমতার উন্নয়ন ও সন্তোষ থেকে সৃষ্টি হয়। আমি বিশেষ করে জরুরিভাবে বস্তুগত উপভোগের জন্য অন্বেষণ না করার আহ্বান জানাই। আমরা মনের ভিতরের সুন্দর, আলোকিত ও উষ্ণ জিনিষ খুঁজবে। এগুলো হচ্ছে আমাদের জীবন আরো সুখী ও আনন্দিত হওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'

এমন একটি গল্প আছে। একটি ইউরোপীয় দেশ 'পৃথিবীতে কে সবচেয়ে সুখী?' এই প্রশ্ন নিয়ে একটি জরীপ করেছে। এর শ্রেষ্ঠ চারটি ফলাফলের মধ্যে রয়েছে, প্রথম ব্যক্তি, সন্তানের জন্য সদ্য গোসল করেছে এমন মা। দ্বিতীয় ব্যক্তি, রোগীর রোগ চিকিত্সা করার পর হাসপাতালের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ দিয়ে রোগীর সঙ্গে বিদায় নেওয়া ডাক্তার । তৃতীয় ব্যক্তি, সৈকতে নিজের তৈরি বালির দুর্গ দেখার শিশু। চতুর্থ ব্যক্তি, রচনার শেষ শব্দ লেখার লেখক। বি শু মিন বলেন, এ চারটি অবস্থা তিনি সব অনুভব করেছেন। কিন্তু তিনি একটুও সুখ অনুভব করেন নি। আসলে জীবনের সব উষ্ণ মুহুর্ত ও চমত্কার সন্ধিক্ষণের সমন্বয়ে আমাদের মনে দীর্ঘদিন স্থায়ী আবেগ হচ্ছে আসল সুখ। (ইয়ু / শান্তা)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্যের পাতা
ভিডিও চিত্র
সাক্ষাত্কার
চিঠিপত্র
Play Stop
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040