নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর পূর্বদিকে বাগমতি নদীর তীরে পশুপতিনাথ মন্দির অবস্থিত। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও বিখ্যাত এই শিবমন্দির ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্যতম ।এটি কাঠমান্ডুর প্রাচীনতম হিন্দু মন্দির ।হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান দেবতা শিবের আরেক নাম পশুপতি ।মন্দির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে ।এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত কাহিনীতে বলা হয়েছে একবার শিব ও পার্বতি কাঠমান্ডু উপত্যকায় বাগমতী নদীর তীরে বেড়াতে আসেন ।নদী ও বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে শিব পার্বতী মুগ্ধ হয়ে নিজেদের হরিণে পরিণত করে এই এলাকায় ঘুরে বেড়ানো শুরু করলেন ।কিছুদিন পরেই দেবতা ও মানুষরা শিবকে খুঁজতে শুরু করলেন ।বিভিন্ন ঘটনার পর দেবতারা শিবকে খুঁজে পেলেও তিনি এই স্থান ত্যাগ করতে অস্বীকার করেন ।শেষ পর্যন্ত শিব ঘোষণা করলেন যেহেতু তিনি বাগমতীর তীরে হরিণ বেশে ঘুরেছেন সেহেতু তিনি এখানে পশুপতিনাথ বা পশুদের অধিকর্তা বলে পরিচিত হবেন ।এই মন্দির কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা সঠিক ভাবে জানা না গেলেও চতুর্থ শতাব্দী থেকে এখানে মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল।এখানে একটি দেবালয় ও শিবলিঙ্গ ছিল।৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে লিচ্ছবি রাজা সুপুস পদেভ এখানে একটি পাঁচ তলা মন্দির নির্মাণ করেন। একাদশ শতকে রাজা শিবদেব এই মন্দিরের সংস্কার করেন ।১৭শ শতকে রাজা ভূপেন্দ্র মল্ল মন্দিরটি পুনর্নিমাণ করেন । কাঠমান্ডু শহরের খুব কাছে দিওপাটন শহরের কেন্দ্রে পশুপতিনাথের মন্দির অবস্থিত।
প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢোকার পর একটি বিশাল প্রাঙ্গনের মাঝখানে পশুপতিনাথের মূল মন্দিরটি নেপালের প্যাগোডা রীতিতে তৈরি । কৌণিক গঠন,কাঠের কারুকার্য এ সবই নেপালের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যরীতির অংশ। মন্দিরটি চারকোণা ।একস্তর বিশিষ্ট ভিত্তিভূমির ওপর স্থাপিত মন্দিরটি ভূমি থেকে ২৩.৬ মিটার উঁচু ।মন্দিরটির সারা গায়ে সোনা ও রূপার কারুকাজ করা ।হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি খোদাই করা হয়েছে মন্দিরের দেয়ালে ।
দু'স্তর বিশিষ্ট ছাদ তামার তৈরি তাতে সোনার প্রলেপ দেওয়া ।মন্দিরটির চারটি প্রধান দরজা । চারটি দরজাই রূপা দিয়ে মোড়া ।প্রতিটি দরজার দু'পাশে সোনা দিয়ে প্রধান দেবদেবীদের মূর্তি তৈরি করা হয়েছে ।মন্দিরের ভিতরে রয়েছে একটি পবিত্র কক্ষ । এখানে একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে । এটি একমিটার দীর্ঘ ও চতুর্মুখ ।এই চারটি মুখ পশুপতিনাথ বা শিবের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কিত চার দেব বিষ্ণু,সূর্য,পার্বতী ও গণেষের । মন্দিরের চূড়া সোনার তৈরি । পশ্চিম দরজার সামনে রয়েছে একটি বিশাল ষাঁড়ের মূর্তি যার নাম নন্দী ।নন্দী মূর্তিটি ব্রোঞ্জের তৈরি সোনার প্রলেপ দেওয়া । মূল শিবলিঙ্গটি কালোপাথরে তৈরি ৬ ফুট দীর্ঘ । মন্দিরের ছাদের নিচের দেয়ালে সপ্তদশ শতাব্দীতে কাঠের অপূর্ব কারুকার্যের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে শিব,পার্বতী,গণেষ,কুমার কার্তিক এবং যোগিনীদের মূর্তি । এছাড়া রয়েছে হনুমান,রাম,সীতা,লক্ষ্মণসহ রামায়ণের বিভিন্ন চরিত্র ও পুরাণের বিভিন্ন কাহিনী ও দেবদেবীর ছবি । পশুপতিনাথের প্রাঙ্গনেই রয়েছে আরো বেশ কয়েকটি প্রাচীন মন্দির ।মন্দিরের দক্ষিণে আছে ৭ম শতকে তৈরি লিচ্ছবি মন্দির চাদেশ্বর,উত্তরে রয়েছে নবম শতকে নির্মিত ব্রহ্মা মন্দির ।এছাড়া রয়েছে একাদশ শতকে নির্মিত গুহেশ্বরী মন্দির,চতুর্দশ শতকে নির্মিত রাম মন্দির ও বৈষ্ণব মন্দির। পশুপতিনাথের উত্তর-পূর্বদিকে আছে প্রাচীন বাসুকিনাথের মন্দির ।নাগ দেবতা বাসুকি পশুপতিনাথ শিবের সঙ্গী ।মূল মন্দিরে প্রবেশের আগে অনেকেই বাসুকিনাথের মন্দিরে পূজা দেন।পশুপতিনাথের মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলছে বাগমতী নদী ।হিন্দু ও বৌদ্ধ দু'সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই বাগমতী পবিত্র নদী । পুণ্যার্থীরা এই নদীতে স্নান করেন। এজন্য নদীর দু'তীরে রয়েছে অনেক ঘাট।এর মধ্যে উনিশ শতকে প্রতিষ্ঠিত আর্য ঘাট বিশেষ গুরুত্ব বহন করে ।এ ঘাটে শুধু মাত্র নেপালের রাজপরিবারের সদস্যদের মরদেহ দাহ করা হতো । তবে ভষ্মেশ্বর ঘাটে মূল শ্মশান অবস্থিত ।এই ঘাট হলো কাঠমান্ডু উপত্যকার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শ্মশান ঘাট । নদীর তীরে গেলেই দেখা যায় সারি সারি চিতা জ্বলছে। গৌরি ঘাট হলো নারীদের স্নানের জন্য বহুল ব্যবহৃত ঘাট । নেপালের পশুপতিনাথ মন্দির তার অপূর্ব শৈল্পিক কারুকার্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিশ্ব বিখ্যাত । পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক পশুপতিনাথের মন্দির দেখতে আসেন ।(শান্তা)