|
বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত এই মন্দির পোড়ামাটির কাজ বা টেরাকোটা নকশার জন্য বিখ্যাত ।১৭০২ সালে দিনাজপুর অঞ্চলের মহারাজা প্রাণনাথ এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন ।তাঁর ছেলে মহারাজা রামনাথ ১৭৫২ সালে এর নির্মাণ শেষ করেন ।
এই মন্দিরের স্থাপত্যরীতি নবরত্ন ধরনের ।মন্দিরের নয়টি চূড়া ছিল কারুকার্য শোভিত।কিন্তু১৮৯৭ সালে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে নয়টি চূড়া ধ্বংস হয়ে যায়।মন্দিরের মূলকাঠামোটি ৫২ বর্গফুট ।মূল ভিত্তি মাটি থেকে ৩ ফুট উঁচু একটি বিশাল প্রস্তর খন্ডের উপর স্থাপিত ।বলা হয়ে থাকে এই বিশাল পাথরের খন্ডটি দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরে প্রাচীন জনপদ বাণনগরের ধ্বংসাবশেষ থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল ।মন্দিরটি দোতলা । এতে আছে প্রার্থনা গৃহ এবং গর্ভগৃহ ।পুরো মন্দিরটি প্রকৃত পক্ষে আটকোণাকৃতির এবং দূর থেকে দেখতে একটি রথের মতো লাগে ।মন্দিরের ছাদ বাংলার ঐতিহ্যবাহী আটচালা রীতিতে নির্মিত।গর্ভগৃহে রয়েছে কৃষ্ণ বা কান্তজিউর বিগ্রহ ।দিনাজপুর শহর থেকে ১৩ মাইল উত্তরে ধাপ নদীর তীরে কান্তনগর গ্রামে এই মন্দির অবস্থিত হওয়ায় একে কান্তনগর মন্দিরও বলা হয় । মন্দিরের ভিত্তিভূমি থেকেই শুরু হয়েছে টেরাকোটা নকশা ।মন্দিরের বাইরের চারদিকের দেয়াল জুড়ে ভিত্তি থেকে ছাদ পর্যন্ত টেরাকোটা নকশা এর প্রধান আকর্ষণ ।ভিত্তিভূমিতে রয়েছে চারটি প্যানেল ।প্যানেলগুলো সমান্তরাল ছোট ছোট ফলক বসানো । প্রথম সারিতে রয়েছে ফুল ও লতাপাতার নকশা । বাংলার সুলতানী রীতিতে লতাপাতার নকশাগুলো উত্কীর্ণ।দ্বিতীয় সারিতে রয়েছে সমসাময়িক বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ও দৈনন্দিন কাজকর্মের দৃশ্য । যেমন ধান ভানা,ফসল কাটা,বিয়ের উত্সব ইত্যাদি। এরপর রয়েছে শিকারের দৃশ্য । হাতিতে চড়ে জমিদার বা রাজা তাঁর দলবল নিয়ে শিকারে যাচ্ছেন । বাঘ শিকারে করা হচ্ছে বন্দুক দিয়ে,নৌকায় চড়ে সুন্দর বনে শিকার করা হচ্ছে,ইউরোপীয় পোষাক পরে ইংরেজরা শিকার করছে এমন অসংখ্য দৃশ্য উত্কীর্ণ রয়েছে ফলকগুলোতে । ভিত্তিভূমির সর্বশেষ সারিতে রয়েছে গোলাপ ফুলের নকশা । ঐতিহ্যবাহী সুলতানী রীতিতে তৈরি এধরনের গোলাপ ফুলের নকশা বাংলার অন্যান্য সুলতানী রীতির স্থাপত্য, যেমন ষাট গম্বুজ মসজিদ ও ছোটসোনা মসজিদেও দেখা যায় ।
শিকারের দৃশ্যের সঙ্গে রয়েছে রাজকীয় শোভাযাত্রা ও শিকার অভিযানের ছবি । মোগল রাজদরবারের পোষাক পরা আমির ওমরাহর সাথে বাদশাহ যাচ্ছেন হাতীতে চড়ে এমন ছবি রয়েছে । রয়েছে হাতির শোভাযাত্রা, রাজকীয় ঘোড়া,উট,গরুর গাড়ি,রথ,ঘোড়ার গাড়ির ছবি । বাদশাহ এবং জমিদাররা গড়গড়ার নল মুখে দিয়ে দরবারে বসে আছেন এমন ছবি রয়েছে টেরাকোটা ফলকে ।বাংলার ঐতিহ্যবাহী ছিপ নৌকা,বজরা,পানসীর ছবি রয়েছে । আছে নৌকা বাইচের দৃশ্য ।মন্দিরের দেয়ালে রয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক দৃশ্য ।মন্দিরের দক্ষিণ ও পূর্বদিকের দেয়ালে রয়েছে মূলত রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনার চিত্রায়ন ।যেমন জটায়ুর সাথে রাবণের যুদ্ধ,অশোক বনে বন্দিনী সীতা,রামচন্দ্র ও সীতাদেবী ইত্যাদি ।উত্তর দিকের দেয়ালে রয়েছে কৃষ্ণ ও বলরামের জীবনের বিভিন্ন কাহিনীর ছবি ।
বৃন্দাবনে গোপিনীদের ছবি,রুক্মিনীর সাথে কৃষ্ণের পরিণয় এর ছবি রয়েছে পোড়ামাটির ফলকে ।
পশ্চিম দিকের পুরো দেয়াল জুড়ে সারিবদ্ধভাবে টেরাকোটা নকশায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী ।কংসের রাজসভায় শ্রীকৃষ্ণের বীরত্ব,কংসবধ এসব দৃশ্য রয়েছে এখানে ।এছাড়া রয়েছে রাধা-কৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলার অসংখ্য ছবি ।
কান্তনগরের টেরাকোটা নকশার মধ্যে পৌরাণিক এসব ছবির পাশাপাশি বাংলার প্রকৃতি ও আবহমান জনজীবনের ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ।নবান্নে ফসলকাটা,উত্তর বঙ্গের ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি,দইয়ের ভান্ড বাঁকে নিয়ে দইওয়ালার পথ চলা,কলসী কাঁখে গ্রামীণ নারী –এসব দৃশ্য আজও গ্রাম বাংলার চিরন্তন ছবি ।টেরাকোটা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্প ।প্রাচীন কাল থেকেই দক্ষ মৃত্শিল্পীরা পোড়ামাটির কাজে কারুকার্যময় করেছেন বিভিন্ন স্থাপনা ।মহাস্থানগড়,পাহাড়পুর,ময়নামতি বৌদ্ধবিহার,পাল,চন্দ্র,সেন ও সুলতানী আমলের বিভিন্ন স্থাপনায় যে দৃষ্টিনন্দন ও সৌকর্যময় টেরাকোটার কাজ দেখতে পাওয়া যায় তার চরম উত্কর্ষের নিদর্শন হলো কান্তজিউর মন্দিরের টেরাকোটার অপূর্ব চিত্র । কান্তজিউর মন্দিরে এখনো নিয়মিত শ্রীকৃষ্ণের পূজা ও কীর্তন হয়ে থাকে ।হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই মন্দির অত্যন্ত পবিত্র ।তবে সব ধর্মের মানুষই এখানে আসেন এর টেরাকোটার কাজ দেখতে ।বাংলাদেশের এই বিখ্যাত স্থাপনাটিকে ইউনেস্কো বিশ্বসভ্যতার অন্যতম উত্তরাধিকার বলে ঘোষণা করেছে । (শান্তা)
| ||||
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |