|
লাহোরের এই বাগান যেমন দৃষ্টি নন্দন তেমনি সমৃদ্ধ এর ইতিহাস। অপূর্ব স্থাপত্য নিদর্শন ও ইতিহাসের জন্য ইউনেসকো শালিমার গার্ডেন ও লাহোর দুর্গকে বিশ্ব সভ্যতার একটি উত্তরাধিকার বলে ঘোষণা করেছে। জম্মু ও কাশ্মীরেও একটি শালিমার গার্ডেন আছে কিন্তু লাহোরের শালিমার গার্ডেন তার সৌন্দর্য ও ইতিহাসের জন্য বেশি বিখ্যাত।
১৬৪১ খ্রীস্টাব্দে মোগল সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে এই বাগানের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং পরের বছর সমাপ্ত হয়। বাদশাহ শাহজাহানের দরবারের সম্ভ্রান্ত সদস্য খলিলুল্লাহ খান, আলী মর্দন খান ও মোল্লা আলাউল মুলকের সহায়তায় এর নির্মাণ কাজের তত্বাবধান করেন ।
লাহোর শহর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে বাগবানপুরের কাছে শালিমার গার্ডেন অবস্থিত । এর খুব কাছে রয়েছে ঐতিহাসিক গ্র্যান্ট ট্রাঙ্ক রোড । মধ্য এশিয়া, কাশ্মীর, পশ্চিম পাঞ্জাব,পারস্য এবং দিল্লী সালতানাত এর স্থাপত্য ঘরানার মিশ্রণ ঘটেছে এই বাগানে । তবে ফোয়ারা ও স্থাপনার ক্ষেত্রে পুরোপুরি মোগল স্থাপত্যরীতির ঐতিহ্যকে বহণ করছে শালিমার গার্ডেন । কারুকার্য করা উঁচু দেয়ালে ঘেরা আয়তকার এই বাগান উত্তর-দক্ষিণে ৬৫৮ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ২৫৮ মিটার ।
সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে নির্মিত তিনটি প্রশস্ত চত্বর নিয়ে গড়ে উঠেছে এ বাগান । প্রতিটি চত্বর একটি অন্যটির চেয়ে ৪ থেকে ৫ মিটার উঁচু । চত্বর তিনটির নাম হলো ফারাহ বকশ বা আনন্দ চত্বর, ফয়েজ বকশ বা শুভ চত্বর,হায়াত বকশ বা জীবন চত্বর ।
বাগানে রয়েছে বেশ কয়েকটি ভবন। বাদশাহ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিশ্রামের জন্য খোওয়াব ঘর,বেগম সাহেবার খোওয়াব ঘর,আরামঘর । বাদশাহর সঙ্গে দেখা করার জন্য দিওয়ানি আম,দিওয়ানি খাস,কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য আইওয়ান বা গ্র্যান্ড হল ।স্নানের জন্য হাম্মামখানা,ভৃত্যদের জন্য নোকরখানা এবং পৃথক বর্ষা ভবন ও গ্রীষ্ম ভবন ।বিগত দিনের বাদশাহী শানশওকত ও বিলাস বৈভবের নিদর্শন হয়ে আজও দর্শকদের মুগ্ধ করে এই ভবনগুলো । বাগানে ঢোকার জন্য রয়েছে কারুকার্যময় দুটি বিশাল তোরণ ।এছাড়া বাগানের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বসার বেদী ।
শালিমার গার্ডেন লাহোরের শুষ্ক একটি স্থানে অবস্থিত । এই বাগানের সেচের জন্য ১৬১ কিলোমিটার দূরে বর্তমান ভারতের রাজপত বা মাধপুর থেকে একটি খালের মাধ্যমে পানি আনার ব্যবস্থা করা হয় । এই খালটির নাম শাহ নহর । এই খালের মাধ্যমে পানি প্রবাহিত হয়ে বাগানের মাঝখানে মার্বেল পাথরে তৈরি একটি বিশাল জলাধারে জমা হয় ।
বাগানে রয়েছে ৪১০টি ফোয়ারা এবং মার্বেল পাথরে তৈরি বড় বড় জলাধার। উপরের চত্বরে আছে ১০৫টি ফোয়ারা,মধ্যের স্তরে ১৫২টি এবং নিচের চত্বরে ১৫৩টি ফোয়ারা রয়েছে। অন্যান্য ফোয়ারাগুলো রয়েছে বাগানের বিভিন্ন জায়গায় । এছাড়া বাগানের বিভিন্ন স্থানে আছে মার্বেল পাথরে তৈরি ৫টি বড় জলাধার। এই জলাধারগুলোর অপূর্ব কারুকার্য দর্শনার্থীদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। লাহোরের তাপমাত্রা গ্রীষ্মে অনেক বেড়ে যায় । অনেক সময় তাপমাত্রা ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে যায় । সেই প্রচন্ড গ্রীষ্মে বাগানের মধ্যে ফোয়ারা ও জলাশয়ের ধারে গাছের ছায়ায় যে শান্তিময় পরিবেশের সৃষ্টি হয় তা দর্শনার্থীদের বিমুগ্ধ করে তোলে ।
শালিমার গার্ডেনে গোলাপ,নার্গিস,হাসনাহেনা,চামেলি সহ দেশী বিদেশী বিভিন্ন রং বেরং ও সৌরভের ফুল রয়েছে । রয়েছে বাদাম,আপেল,নাশপতি চেরি,আম,মালবেরি,পিচ,লেবু,কমলালেবু,সাইপ্রাস,চিনার,পপলারসহ বিভিন্ন জাতের গাছ ও লতাগুল্ম ।
শালিমার গার্ডেনের পুরো এলাকাটি এক সময় ছিল বাগবানপুরের সম্ভ্রান্ত জমিদার মিয়া পরিবারের সম্পত্তি ।মোগল সম্রাট শাহজাহান যখন এই স্থানের মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ দেখে এখানে বাগান করার ইচ্ছা পোষণ করেন তখন মিয়া পরিবারের প্রধান মুহম্মদ ইউসুফ বাদশাহকে ইশকপুর নামে এই স্থানটি উপঢৌকন দেন । প্রতিদানে বাদশাহ ইউসুফ মিয়াকে দরবারে সম্মানিত করেন এবং মিয়া পরিবারকে এই বাগানের শাসনভার অর্পণ করেন। পরবর্তী সাড়ে তিনশ বছর শালিমার গার্ডেন মিয়া পরিবারের তত্বাবধানে থাকে। এই সাড়ে তিনশ বছর ধরে এখানে চিরাঘান উত্সব নামে একটি উত্সব ও মেলা অনুষ্ঠিত হত ।
১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকার লাহোরের শালিমার গার্ডেন জাতীয়করণ করে । এরপর থেকে সরকারীভাবে এই বাগানের পরিচর্যা চলছে ।
শালিমার গার্ডেনে প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী আসেন এবং বাদশাহ শাহজাহানের শিল্পরুচির পরিচয়ে বিমুগ্ধ হন। (শান্তা)
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |