Web bengali.cri.cn   
বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধ
  2011-12-22 15:48:34  cri

বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধ

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী বীর শহীদদের স্মরণে জাতির শ্রদ্ধা নিবেদনের চিরন্তন প্রতীক জাতীয় স্মৃতিসৌধ । বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে সাভার উপজেলায় ৪৪ হেক্টর জায়গা নিয়ে স্থাপন করা হয়েছে স্মৃতি সৌধ কমপ্লেক্স।

১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পরপরই ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মরণে জাতীয় পর্যায়ে স্মৃতি সৌধ নির্মানের পরিকল্পনা নেওয়া হয় ।১৯৭১ এর ডিসেম্বরে সাভারের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ,মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত বিজয়,তাদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগ স্মরণ করে স্মৃতি সৌধ সাভারে নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয় ।স্থান নির্বাচন,রাস্তা নির্মাণ ও ভূমি উন্নয়নের পর স্থাপত্যের নকশা নির্বাচনের জন্য দেশ জুড়ে শিল্পী,স্থপতি ও ভাস্করদের কাছ থেকে নকশা আহ্বান করা হয় ।১৯৭৮ সালের জুন মাসে নকশা জমা দেওয়ার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় ।৫৭টি সেরা নকশার মধ্য থেকে স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেনের নকশাকে নির্বাচন করা হয়।১৯৮২ সালের কিছু পর স্মৃতিসৌধের মূল কাঠামো,কৃত্রিম লেক এবং উদ্যান তৈরির কাজ সমাপ্ত হয় ।

সৌধের মূলকাঠামো সাত জোড়া ত্রিভূজাকৃতির দেয়াল নিয়ে গঠিত ।দেয়ালগুলো ছোট থেকে বড় এই ক্রমে সাজানো হয়েছে।মাঝখানের দেয়ালটি দৈর্ঘ্যে সবচেয়ে ছোট কিন্তু উচ্চতায় সবচেয়ে বেশি । সর্বোচ্চ বিন্দুতে সৌধটি ১৫০ ফুট উঁচু ।এই সাতজোড়া দেয়াল স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি প্রধান পর্যায়কে নির্দেশ করে ।১৯৫২র ভাষা আন্দোলন,১৯৫৪র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন,১৯৫৬র শাসনতন্ত্র আন্দোলন,১৯৬২র শিক্ষা আন্দোলন,১৯৬৬র ছয়দফা আন্দোলন ,১৯৬৯র গণ অভ্যুথ্থান,১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। এই সাতটি ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমা বিবেচনা করে এবং মুক্তিযুদ্ধকে সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচনা করে রূপদান করা হয়েছে ।বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সৌধটি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দৃষ্টিগোচর হয় ।স্থপতি মইনুল হোসেন সৌধের মূল কাঠামোটি কংক্রিটের এবং কমপ্লেক্সের অন্যান্য স্থাপনা লাল ইটের তৈরি করেন ।মূল সৌধের গাম্ভীর্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য এই পার্থক্য। এর দ্বারা রক্তের লাল জমিতে স্বাধীনতার স্বতন্ত্র উন্মেষ নির্দেশ করা হয়েছে ।

পুরো কমপ্লেক্সে রয়েছে কৃত্রিম জলাশয়,বাগান এবং গণকবর।১৯৭১ এ সাভারে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের এক বড় যুদ্ধ হয় । অনেক মুক্তিযোদ্ধা সে যুদ্ধে শহীদ হন ।এই চূড়ান্ত যুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় ও পাকিস্তানের পরাজয় নির্ধারিত হয়।এর আগে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সাভার এলাকার গ্রাম থেকে অনেক বাঙালিকে বন্দী করে ক্যাম্পে নিয়ে আসে ।নির্যাতনের পর তাদের হত্যা করা হয়। অসংখ্য গ্রামবাসীকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে নিচু জমিতে ফেলে রাখা হয় বা মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয় ।যুদ্ধের পর এই এলাকায় আবিষ্কৃত হয় বধ্যভূমি ও গণকবর ।এই গণকবরগুলো স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্সে অবস্থিত । জাতীয় স্মৃতি সৌধের মূল কাঠামোর সামনেই রয়েছে একটি জলাশয়। এখানে প্রতিফলিত হয় জাতীয় স্মৃতি সৌধের মূল কাঠামো এবং জাতীয় পতাকা ।এই জলাশয়ে ফুটে আছে অসংখ্য শাপলা ফুল।বাংলাদেশের জাতীয় ফুল ।

জাতীয় স্মৃতি সৌধ নির্মাণের কাজ তিনটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয় ।প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয় ১৯৭২ সালে।সে সময় ২৬ লাখ টাকা খরচ করে ভূমি অধিগ্রহণ ও সড়ক নির্মাণের কাজ করা হয়।দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৭৪ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত কাজ চলে।এ সময় ৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা খরচ করে গণকবরের এলাকা,হেলিপ্যাড,গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান,চত্বর ইত্যাদি নির্মিত হয় ।১৯৮২ সালের আগস্ট মাসে শুরু হয় মূল স্মৃতি সৌধ তৈরির কাজ ।৮৪৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় স্মৃতি সৌধ ।এর পর এখানে তৈরি হয় কৃত্রিম লেক,সবুজ বেষ্টনী,ক্যাফেটেরিয়া,রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য আবাসিক এলাকা ইত্যাদি ।স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্সের প্রধান ফটক দিয়ে কেউ যখন এ এলাকায় প্রবেশ করেন তখন তিনি প্রথমেই স্মৃতি সৌধটি চোখের সামনে দেখতে পান । যদিও সৌধ পর্যন্ত যেতে হলে তাকে অনেক দীর্ঘ পথ হাঁটতে হয় । এই পথের মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো উঁচু নিচু চত্বর । এই চত্বরগুলো পার হতে হলে তাকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে বেশ কয়েক বার ওঠা নামা করতে হয় ।তারপর পার হতে হয় বড় একটি কৃত্রিম জলাশয় । জলাশয় পার হওয়ার জন্য রয়েছে সেতু ।এই পথের দু'পাশে রয়েছে গনকবর।এই প্রতিটি চত্বর ও সিঁড়ি লাল ইটের তৈরি ।স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য জাতিকে যে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে,চড়াই উতরাই পার হতে হয়েছে।তার প্রতীক এই দীর্ঘ হাঁটা পথ ।স্বাধীন স্বদেশ পাওয়ার জন্য যে রক্ত দিতে হয়েছে তার প্রতীক লাল ইট ।জলাশয় অশ্রুর প্রতীক । আর গণকবর স্মরণ করিয়ে দেয় শহীদদের আত্মদানের ইতিহাস ।পুরো এলাকাটি ৩৪ হেক্টর এলাকা নিয়ে নির্মিত । এর চারপাশে আরো ১০ হেক্টর জায়গা জুড়ে রয়েছে সবুজ ঘাসের বেষ্টনী।এই সবুজ বেষ্টনী সবুজ শ্যামল বাংলাদেশের প্রতীক । বিজয় দিবস,স্বাধীনতা দিবস সহ বিশেষ জাতীয় দিবসে এখানে লাখো জনতার ঢল নামে ।মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের প্রতি নিবেদিত হয় শ্রদ্ধাঞ্জলি । (শান্তা)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্যের পাতা
ভিডিও চিত্র
সাক্ষাত্কার
চিঠিপত্র
Play Stop
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040