এদিকে ছোকরা চাকর ততক্ষণে এসে পড়েছে। দূতকে ডেকে এনে সে-ই হাজির করে দিলে। দূত তখন কুরনিশ করে বললো-'হে রাজন'। রাজা আঁতকে উঠে বলে ফেললেন-'য়্যাঁ', মন্ত্রী তাড়াতাড়ি তাঁকে আশ্বস্ত করবার জন্য তাঁর কানে কানে বলে দিলেন, 'আজ্ঞে মহারাজ, ভয়ের কিছু নাই, ওদের ওরকম বলাই দস্তুর'। দূত তখন বলে চলেছে- ' শ্রী শ্রী শ্রী শ্রী শ্রীযুক্ত পরম পরাক্রান্ত সসাগরাধরণীর অধিপতি স্বর্গ মর্ত পাতাল ত্রিলোকের পালক, চন্দ্রসূর্য যাঁহার মার্বেল-গুলি, নক্ষত্রমন্ডলী...'
'এই মন্ত্রী, এই মন্ত্রী কি কি বলছে এসব?' রাজা এবার ফ্যালফ্যাল করে একবার সকলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। মন্ত্রী তাড়াতাড়ি কানে কানে বললেন- একটু সবুর করুন মহারাজ, এখনো শেষ হয়নি, আরও খানিকটা বাকি আছে'।
' চন্দ্রসূর্য যাহার ঝাড়লন্ঠন, হিমালয় যাহার ইটের পাঁজা, নদী সমুদ্র যাহার নালাডোবা, সেই মহামনি অজর অমর অজেয় রামনগরের মহারাজের দ্বারা আদিষ্ট হইয়া এই পত্র আপনাকে প্রদান করিলাম।
দূত রাজার হাতে এবার পত্রখানা তুলে দিলে, রাজার মুখে এতক্ষণে হাসি দেখা দিল, বললেন—'তাই বল চিঠি এনেছে, আর আমি কিনা কি সব ভেবে বসে আছি'। তার পরেই রাজা মুখ গম্ভীর করে এ-পকেট ও পকেট হাতড়ে বললেন, ' এই যাহ্! চশমা আনতে তো মনে নাই! মন্ত্রী নাও এটা পড় দেখি কি লিখেছে এখানে?
মন্ত্রী ততক্ষণে বাজারের পোটলা আর ঝোলা হাতা-সাফাই করে সিংহাসনের তলায় লুকিয়ে ফেলেছেন। চিঠিটা হাতে নিয়ে তিনিও এপকেট ওপকেট করে অবশেষে বললেন, 'আজ্ঞে আমিও দেখছি চশমাটা আনতে ভুলে গেছি। পড় হে কোটাল, তোমার তো আবার চোখের খুব জোর'। এবার কোটাল মন্ত্রীর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বাধ্য হয়েই চিঠিটা হাতে তুলে নেয়। তারপর উল্টেপাল্টে একবার কাছে, একবার দূরে—নানারকমে ধরেও কোটালের চিঠি পড়া আর হয় না। এই দেখে রাজা ধমক দিয়ে বললেন- 'কই হে পড় না, ভারি তো একটা চিঠি, তাই পড়তে দিন কাটাবে নাকি! নেহাত্ চশমাটা ফেলে এসেছি, তা না হলে দেখিয়ে দিতাম!'
কোটাল কাঁচুমাচু হয়ে বললেন—'আজ্ঞে পড়তে তো এক্ষুনি পারি, কিন্তু এর যে আগাগোড়া ব্যাকরণ ভুল। এমন অশুদ্ধ ভাষা কেমন করে মুখ দিয়ে বার করব তাই ভাবছি'। ছোকরা চাকর এতক্ষণ এ-ধারে দাঁড়িয়ে পান চিবুচ্ছিল। তাড়াতাড়ি চিঠিটা টেনে নিয়ে বললে-'থাক, কাউকে পড়তে হবে না'।
মন্ত্রী অমনি বলে উঠলেন- 'হ্যাঁ, হ্যাঁ পড়ো তো বাবা, এইতো তোমাদের পড়বার বয়স!', কোটাল সায় দিয়ে বললেন- 'আর তোমাদের তো অত শুদ্ধ-অশুদ্ধ-বিশুদ্ধ বিচার নেই! পড়লেই হলো'। এবার ছোকরা চিঠিখানা মনে মনে পড়ে ফেলে বললে-' রামনগরের মহারাজা আপনার ছেলের সাথে তাঁর মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন। তিনদিনের মধ্যে রাজপুত্র নিয়ে বিয়ের জন্য রওনা না হলে রামনগর থেকে সাতহাজার সেনা তাঁকে নিতে আসবে'। এবার সভাশুদ্ধ সবার মুখ শুকনো খেজুরের মতো হয়ে গলো। রাজা ঢোক গিলতে গিলতে বললেন- 'সাতহাজার! ঠিক পড়েছ তো হে, সাতহাজার নাকি সাতাশ সাতত্রিশ এরকম কিছু, আবার দেখ তো বাবা'!
ছোকরা: আজ্ঞে, সাতহাজার পদাতিক আর সাথে তিনহাজার ঘোড়-সওয়ারেরও কথা আছে'।
রাজা: আবার ঘোড় সওয়ারও আছে!
রাজার এবার ভিরমি যাবার অবস্থা। ভিরমি যাওয়া তো আশ্চর্য কিছু নয়, প্রথমত, রাজা রাজপুত্র পাঠাবেন কি করে রাজাতো বিয়েই করেন নি। আবার যদি রাজপুত্র না পাঠালে সাতহাজার সৈন্য নিতে আসার যে কি মানে তা তো সবাই হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। সে কালে অমনি করেই যুদ্ধ টুদ্ধ হতো কিনা !
রাজা তাকায় মন্ত্রীর দিকে, মন্ত্রী কোটালের দিকে, পাত্র মিত্র সকলেই যে যার মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। এখন উপায়!
রাজা বার কয়েক ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললেন-'ওহে দুত... ওর মানে কী! বুঝেছো কিনা—অর্থাত্ এই ধরুন গিয়ে, হলো গিয়ে... ওই যে কী বলে—দুত্তোরি ছাই... বল না হে মন্ত্রী'।
'এই বলি মহারাজ....' মন্ত্রী এবার বেশ জোরে গলা খাকারি দিয়ে শুরু করলেন-'ওহে দূত, ওর মানে কী.... বুঝেছ কিনা...' দূত এতক্ষণ পর্যন্ত কিঞ্চিত জলযোগের আশায় থেকে থেকে এইবার তার কোনো সম্ভাবনা নেই দেখে চটে গিয়েছিল—বললে... 'যা বলবার তাড়াতাড়ি সেরে নিন মশাই, আমার তো আর সারাদিন এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না- খাওয়া দাওয়া তো আছে'।
কিন্তু এতো বড়ো ইশারাটাও মাঠে মারা গেলো। রাজা বললেন-'নিশ্চয়ই! বল না হে মন্ত্রী যা বলবার'। ছোকরা এবার এগিয়ে এসে হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে বললে—'ওহে বাপু দূত'। এতে দূত চটে গিয়ে বললে-'ওহে বাপু কী হে?'
ছোকরা: আচ্ছা, না-হয় ওহে বাছা দূত, তোমার রাজাকে গিয়ে বলো যে রাজপুত্র গেছেন শিকারে, শিকার থেকে ফিরে এলেই তিনি যাবেন বিয়ে করতে'। সভা শুদ্ধ সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। দূত রাগে গসগস করতে করতে বলে গেল-'কিন্তু বেশি দেরি হলে আমরা তুলে নিতে আসবো, মনে থাকে যেন'।
তারপর একমাস, দুমাস করে ছয় মাস চলে যায়, কিন্তু রাজার ছেলে তো আর আসে না। রামনগরের দূত এসে জিজ্ঞেস করে- 'কই রাজপুত্র শিকার থেকে ফিরলো?' প্রতিবার ছোকরা চাকরই জবাব দেয়- 'ফিরবে বৈকি, এই ফিরলো বলে, পথে আছে'। কিন্তু এমন করে তো বেশি দিন আর চলা যাবেনা, এবার সত্যি সত্যি রাজপুত্র না নিয়ে গেলেই নয়। চাকর ছোকরা বললে-' হুজুর রাজপুত্র খুঁজুন'।