Web bengali.cri.cn   
বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ ক্ষেত্র এবং বস্তির জীবন
  2013-09-09 15:49:54  cri


 


গত শতাব্দীর ৯০ দশকের দিকে জিন ওয়াকার নামে একজন ব্রিটিশ নারী ফিলিপাইনের ম্যানিলা ভ্রমণ করেছিলেন। এ সময়ে একদিন তিনি ম্যানিলার সূর্যোদয় উপভোগ করতে ভোর সকালে বেরিয়ে পড়েন এবং চলতে চলতে এক সময় পথ হারিয়ে স্থানীয় একটি বস্তিতে ঢুকে পড়েন। বস্তিতে ঢুকে তিনি যা দেখেন তাতে তিনি ভীষণরকম অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি দেখেছিলেন বিরাট একটি ময়লা আবর্জনার পাহাড়। সে পাহাড় থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া আকাশের দিকে উড়ছে। পরে তিনি জানতে পারেন যে, স্থানীয় বাসিন্দা এটিকে "ধোঁয়া পাহাড়" নামে ডাকে। বস্তির অনেকেই ভীষণ নোংরা, দূর্গন্ধ আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শুয়ে আছে। মূলত ময়লা আবর্জনা সংগ্রহ করেই তারা জীবন কাটায়। তাদেরকে দেখতে এত অসহায় লেগেছে আর তাদের জীবন এতটাই কষ্টের যে, ওয়াকার তাত্ক্ষণিকভাবে একটি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, সে আর ব্রিটেনে ফিরে যাবে না। সে এই ময়লা দূর্গন্ধযুক্ত ধোঁয়া পাহাড়েই থাকবেন, যাতে এই সব অসহায় মানুষদের জীবনমান উন্নয়নে কিছুটা হলেও সাহায্য করা যায়। শ্রোতা বন্ধু, তিনি কিন্তু আবেগের বশবর্তী হয়ে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। কেননা তিনি এখনো সেখানে আছেন এবং বস্তির নারীদেরকে আবর্জনা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া পুরোনো ম্যাগাজিন, কাপড়, প্লাস্টিক প্রভৃতি বস্তু ব্যবহার করে দৃষ্টিনন্দন হস্তশিল্প যেমন, হ্যান্ডব্যাগ বিভিন্ন অলংকার প্রভৃতি তৈরি করার পদ্ধতি শেখাচ্ছেন। তাদের তৈরি এইসব হস্তশিল্পের ডিজাইন বৈশিষ্টপূর্ণ এবং গুণগতমানও অনেক ভালো, তাই দ্রুতই তাদের তৈরী পণ্য বিক্রয়ে চাহিদা বেড়ে যায়।

বর্তমান বিশ্বে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল অনেক দেশ আছে, যাদের দুর্বল বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ বা ব্যবস্থাপনার কারণে ম্যানিলার "ধোঁয়া পাহাড়ের" মতোই জমি, পানি ও বায়ুর দূষণ করছে অবিরত আর তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে।

প্রথমে আমরা দেখি ভারতের বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের অবস্থা। বড় একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ভারতের পর্যটন সম্পদ বিভিন্ন দেশের পর্যটকের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। হ্যাঁ, সুদীর্ঘ ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রাচীন এবং সনাতন ধর্মীয় আচার, রীতিনীতি সত্যি খুব আকর্ষণীয়। কিন্তু দেশের সামগ্রিক বর্জ্য ও আবর্জনা ব্যবস্থাপনার দুর্বল প্রক্রিয়া পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে জন্য মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা তৈরী করছে। ভারতের অনেক শহরেই ডাষ্টবিন বা বর্জ বাক্স নেই, যাতে হাটাচলার পথে লোকজন সুবিধামত তাদের উচ্ছিষ্ট বা বর্জ্য পদার্থ ফেলতে পারে। রাস্তায় দেখা যায় পয়োঃপ্রণালীর দূষিত পানি। বস্তির অবস্থা কি ভয়াবহ হতে পারে তাতো বলার অপেক্ষা রাখে না। পাহাড়ের মত আবর্জনার স্তুপের কাছে বাস করে কতশত দরিদ্র অসহায় মানুষ। এমন পরিবেশে থেকে সেখানকার মানুষ অহরহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। ভারতে বিশেষ কিছু বড় আকারের ধর্মীয় উত্সবের সময়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ দূষণের বিষয়টি অনেক সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্ব পেয়ে থাকে। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা লক্ষ লক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী পুরুষ একসাথে গঙ্গাস্নান করেন এবং গঙ্গাতীরে অবস্থিত মন্দিরে তীর্থ যাত্রা করেন। এ সময় তারা গঙ্গা নদী বা গঙ্গাদেবীর উদ্দেশে ফুল,ফলসহ নানা সামগ্রী অঞ্জলি দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ আবার ভক্তির নিদর্শন স্বরূপ নদীতে দূধ ঢেলে থাকেন। নদীতে ফেলা এই বিশাল পরিমানের সামগ্রী মারাত্মক নদী দূষণের কারণ হয়ে ওঠে।

আগে ভারতের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা প্রক্রিয়াকরনের পদ্ধতি উন্নত ছিল না। মূলত মাটি চাপা দেয়া বা পুতে ফেলাই ছিল অধিক প্রচলিত একটি পদ্ধতি। কিন্তু এই পদ্ধতিতে দিন দিন বর্জ্য-আবর্জনা জমে জমে পাহাড়সম হয়ে ওঠে আর তা আশেপাশের নাগরিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেয়। তাই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত ধীরে ধীরে উন্নত মানের আবর্জনা প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। যেমন ভারতের টাটা গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান টাটা জ্বালানী গবেষণা ইন্সটিটিউট সাফল্যের সঙ্গে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া আবিস্কার করেছে। এবং তার নাম দেয়া হয়েছে "তেল ঘাতক"। এই ব্যাকটেরিয়া শতভাগ প্রকৃতিজাত বস্তু দ্বারা তৈরী করা হয়েছে। ৫ ধরনের ব্যাকটেরিয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে এই 'তেল ঘাতক'। এই ব্যাকটেরিয়া সব ধরনের তেলযুক্ত বা তৈলবস্তুগত আবর্জনা ধ্বংস করে পুনরায় উর্বর মাটিতে রূপান্তরিত করতে পারে। পরীক্ষামূলক ভাবে গত ৬ বছরে এই "তেল ঘাতক" ইতোমধ্যেই ৮ হাজার টন আবর্জনা উর্বর মাটিতে রূপান্তরিত করেছে।

তাহলে এখন আমরা কেনিয়ায় যাবো, দেখি সেখানে বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা এবং এর সাথে বাস করা মানুষের জীবনযাত্রা কেমন। যদি আপনি কোনো এক শনিবার সেখানে যান, তাহলে আপনি কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির ডানদোলালা বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় কয়েক শ' মানুষ দেখতে পাবেন, যারা প্রতিদিন আবর্জনা পাহাড় খুঁড়ে মূল্যবান জিনিস খুঁজতে থাকে। এ বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ এলাকার আয়তন ১২ হাজার বর্গমিটার। এই বিশাল ক্ষেত্রটি প্রতিদিন নাইরোবির ২ হাজার টন শহরের প্রাত্যহিক আবর্জনা গ্রহণ করে। বলা হয়ে থাকে এটি হল আফ্রিকার বৃহত্তম বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ ক্ষেত্র।

সেখানে বাস করে মুছিলি নামে একজন দরিদ্র মানুষ। আবর্জনা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া সামগ্রি সংগ্রহ করে, সেগুলো বিক্রি করে যে টাকা পায়, তা দিয়েই চলে তার পরিবারের ৪ সন্তানের ভরণ পোষণ। সে এখানে দশ বছর ধরে আছে। সে ইতোমধ্যেই এ জায়গাটিকে নিজের বাড়ি হিসেবে মনে করে। সে স্বীকার করে যে বর্জ্য আবর্জনার স্তুপে কাজ করা ভালো কাজ নয়। আবর্জনা সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রতি মূহূর্তে তাকে স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়। কেননা মারাত্মক জীবানু মিশ্রিত ভাঙ্গা ক্লাস, বোতল সুচ আর পঁচনশীল বস্তু বাহিত জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হওয়া সম্ভাবনতো থাকছেই।

৩০ বছর বয়সী মানচালিয়া দু'শিশু সন্তানের বাবা। সেও ডানদোলালা বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় দশ বছর ধরে কাজ করছে। তার মতে, আমরা বর্জ্য কাগজ, বোতল ও প্লাসটিক সংগ্রহ করি এবং তারপর সে সব সামগ্রী পুনঃ প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানীর কাছে বিক্রি করি। আসলে আবর্জনা সংগ্রহের কাজ করতে সাহস লাগবে। ডানদোলালা বর্জ প্রক্রিয়াকরণ ক্ষেত্রে শুধু যে দূর্গন্ধ আছে, তা নয়, বরং অনেকেই সেখানে আবর্জনা সংগ্রহ করতে আসে এবং তাদের মধ্যে রয়েছে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা যা কখনো কখনো সহিংস হয়ে ওঠে। তাছাড়া স্বাস্থ্যের জন্যও এটা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। মানচালিয়া বলেন, তারা সপ্তাহের সাত দিনই সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাজ করতে থাকেন। যদি আবহাওয়া ভালো থাকে এবং ভাগ্য ভালো থাকে, তাহলে অনেক বেশি সামগ্রী সংগ্রহ করতে পারে। মানচালিয়ার সবচেয়ে সাফল্যমন্ডিত অভিজ্ঞতাটি হচ্ছে: সে এবং তাঁর সহকর্মী এক সপ্তাহের মধ্যে ৮ শ' কেজি সাটা কাগজ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে, এবং এ থেকে ৮০ মার্কিন ডলার মুনাফা পেয়েছে।

সেখানে পুরুষেরা আবর্জনা থেকে বস্তুগত ভালো সামগ্রী সংগ্রহ করে, আর মহিলারা সংগ্রহ করে অবশিষ্ট খাবার। অনেকেই আছেন যারা এই এলাকাটিকে অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে মেনে নিয়েছেন এবং তারা উপার্জনের পদ্ধতিও শিখে ফেলেছে ভাল ভাবে। তবে দুর্ভাগ্যের কথা হল, সমাজ তাদেরকে অপরাধী হিসেবে দেখে। আমরা বলে থাকি আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যত' কিন্তু ডানদোলালা বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ ক্ষেত্রে থাকা শিশুদের কি ভবিষ্যত আছে? ২০০৭ সালে জাতিসংঘ পরিবেশ কার্যক্রমের গবেষকরা সেখানের ৩২৮জন ২ বছর থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশু, কিশোরের ওপর শারিরিক পরীক্ষা চালায়। এর ফলাফল থেকে জানা যায়, তাদের মধ্যে অধিকাংশ শিশুর রক্তেই সীসার পরিমাণ স্বাভাবিকতার মাত্রা ছাড়িয়ে বিপদজনক পর্যায় রয়েছে। তাদের শারিরিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক এবং এর প্রধান কারণ হল আবর্জনা।

এ সব তথ্য জেনে আপনাদের কেমন লাগছে? ব্যক্তিগত ভাবে আমি কিন্তু খুব উদ্বিগ্ন। শিশু হল একটি দেশের ভবিষ্যত। প্রত্যেক শিশু জন্ম থেকে সমান মর্যাদা আর সুযোগ সুবিধা নিয়ে বেড়ে ওঠার অধিকার রাখে। কিন্তু বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় থাকা শিশুদের জীবন সত্যিই দুঃখজনক। আমাদের সমাজ এবং সরকারের উচিত তাদের জন্য কিছু করা, আর এ ছাড়া বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণেরও নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা উচিত। আর আমরা যারা সাধারণ মানুষ, আমাদের উচিত যত্রতত্র আবর্জনা না ফেলে আমাদের পরিবেশকে বাসযোগ্য করে রাখা, এটা আমাদেরই নৈতিক দায়িত্ব। একটু ভেবে দেখুন না, যে নিজের বাস করা ছোট্ট বাসাটিই কেবল নয়, পুরো এলাকাটিই আপনার বাসা। কারন ঘুমের সময়টুকু বাদে বাকি সময়তো ঘরের বাইরেই থাকতে হয়। তাহলে আপনার পরিবেশ কি আপনার বাসস্থান নয়? সুন্দর পরিবেশের সুফল কি আপনিও ভোগ করবেন না? এভাবে যদি সবাই ভাবি, তাহলে আমাদের এ সুন্দর পৃথীবির জন্য কিছু করা কি খুব কঠিন কিছু বিষয়? আপনার কি মনে হয়?

মন্তব্য
লিঙ্ক