Web bengali.cri.cn   
মধ্য-বিত্ত শ্রেণীর জীবন ও মানদন্ড
  2013-09-02 16:26:17  cri


 


আমাদের সবার জীবনেই কমবেশি মধ্য-বিত্ত জীবনের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাই না? মধ্য জীবনের টানাপোড়েনে পড়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন-সাধকে জলাঞ্জলী দিতে হয়। মধ্যবিত্ত জীবন মানেই যেন বিশেষ এক ছাঁচে গড়া জীবন।

সিনেমায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য-বিত্তের জীবনটা হচ্ছে এ রকম যে: তারা শহরের উপকন্ঠে থাকেন, একটি বাড়ি, দু'তিনটি শিশু ও একটি কুকুর। শিশুরা খেলা করছে আর দম্পতি টিভি দেখার সঙ্গে সঙ্গে কোক আর খই খাচ্ছে।

এবং তা হল যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক কাঠামোর সাথে সংগতিপূর্ণ "মধ্য-বিত্ত শ্রেণী"। এটা কিন্তু বিশ্বের সর্বত্র এক রকম নয় বরং বিভিন্ন দেশের অবস্থা ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। তাহলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে "মধ্য-বিত্ত শ্রেণী"র জীবন ও তাদের সামাজিক অবস্থান কেমন, সে বিষয় নিয়ে আজকের অনুষ্ঠানে আমরা কিছু আলোচনা করতে পারি।

প্রথমে আমরা কোন সামাজিক অবস্থান ও পদমর্যাদার কারণে একটি শ্রেণীকে মধ্য-বিত্ত শ্রেণী হিসেব চিহ্নিত করা হয়, সে সম্পর্কে কিছু তথ্য আপনাদের জানিয়ে দিতে চাই। তাহলে কোন ধরণের মানুষদেরকে মধ্য-বিত্ত শ্রেণীর পর্যায়ভূক্ত করা যায়, এ বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানদন্ড রয়েছে। এবং তা হল: আয়ের দিক থেকে, মধ্য-বিত্ত শ্রেণী মানে যাদের বার্ষিক আয় ৫ হাজার ডলার থেকে ৩৫ হাজার ডলারের মধ্যে সীমিত থাকে, এ রকম মানুষদেরকে মধ্য-বিত্ত শ্রেণী বলা যায়। বলা হয়ে থাকে তাদের তেমন বেশি আর্থিক চিন্তা নেই, দৈনন্দিন সামগ্রী, যেমন খাবার, কাপড়, এসব কিছু পরিমানে কম বেশি কিনতে তারা সক্ষম। এই শ্রেণীদেরকে একটি দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এই শ্রেণীর ওপর বিশেষ ভাবে নির্ভর করে থাকে।

কিন্তু বিভিন্ন দেশের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা ভিন্ন, তাই মধ্য-বিত্ত শ্রেণীর মানদন্ডও ভিন্ন হয়ে থাকে। তাহলে আমরা প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবিত্ত শ্রেণী সম্পর্কে কিছু বলি। সারা বিশ্বের ন্যায় যুক্তরাষ্ট্রে মধ্য-বিত্ত শ্রেণীকেও তিনটি পর্যায় ভাগ করা হয়। এ দেশে উচ্চ-মধ্যবিত্ত পর্যায়ের শ্রেণী দেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ। তারা প্রধানত আইনজিবি, চিকিত্সক, লেখক ও প্রকৌশলী প্রভৃতি সামাজিক পেশার মানুষ হয়ে থাকেন। তাদের বার্ষিক আয় ১ লাখ মার্কিন ডলারেরও বেশি। তারা অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকধারী হয়ে থাকেন। আর নিম্ন মধ্যবিত্ত পর্যায়ের শ্রেণী মানে এরা কোনো কোম্পানী বা সংস্থার জন্য নয় বরং স্বাধীনভাবে কাজ করা এক শ্রেণীর মানুষ। তাদের বার্ষিক গড় আয় ৩৫ হাজার মার্কিন ডলার। আসলে যুক্তরাষ্ট্র যদিও একজন মানুষের বার্ষিক আয় ১ লাখ মার্কিন ডলার, তবুও তার জীবন খুব আরামের হবে না। কেননা, তার আয়ের একটি বড় অংশ চলে যাবে কর বিভাগের হাতে। যেমন আয়ের ৩৫ শতাংশ ফেডারেল কর, বাড়ির ঋণ অথবা বাড়ি ভাড়া আর গাড়ির ফি বাবদ প্রায় ৩০ শতাংশ চলে যায়। এরপর হাতে অবশিষ্ট যে টাকা থাকে সেটা ইচ্ছা মত খরচ করতে পারে, কিন্তু সে টাকার পরিমাণ মাসে দু'তিন হাজার মার্কিন ডলারের বেশি নয়। এ দু'তিন হাজার মার্কিন ডলার দিয়েই গোটা পরিবারের খাওয়া দাওয়া, যাতায়াত এবং সন্তানদের শিক্ষার ফি দিতে হয়। বলা যায় দিন আনা দিন খাওয়ার মত অবস্থা। অবশিষ্ট বা সঞ্চয়ের সুযোগ খুব একটা থাকে না।

তাই এমন একটি কথা আছে, যদি তুমি কাউকে ভালোবাসো, তাহলে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাও। কারণ সে দেশ হল স্বর্গ সেখানে সে শান্তিতে থাকবে। আবার যদি তুমি কাউকে ঘৃণা করো, তাহলেও তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাও। কারণ সে দেশ হচ্ছে নরক যেখানে তার জীবন দূর্ভোগে কাটবে। সত্যিই তাই, যুক্তরাষ্ট্রে বৃদ্ধবৃদ্ধা আর শিশুর জন্য সত্যি স্বর্গের মত, তবে সে দেশের মধ্য-বিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপন মোটেই সুখকর নয়, বলা যায় উদ্বেগ আর দুঃশ্চিন্তায় ভরা এক জীবন।

এ ক্ষেত্রে ব্রিটেন মধ্য-বিত্তের মানদন্ড যাচাইয়ে বার্ষিক আয়ের ওপর তত বেশি গুরুত্ব দেয় না। মানে তারা মনে করে কেবল বার্ষিক আয়ের পরিমান দিয়ে মধ্য-বিত্ত শ্রেণীকে যাচাই করা কোনো ভাল উপায় নয়। ব্রিটিশরা বলবে, যদিও তুমি আমার চেয়ে বেশি আয় কর, যদিও তোমার বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। তবে তুমি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছ, সেটা প্রথম শ্রেণীর নয়, তোমার কথা বলার ধরণ বিদেশীদের মত, তুমি হাই-ক্লাস বা উচ্চ বিত্তের খেলাধুলা ইভেন্টের সাথে যুক্ত নও, তাই তুমি যথার্থ অর্থের মধ্য-বিত্ত শ্রেণীর মানুষও নও।

সম্প্রতি বিবিসি এ সংশ্লিষ্ট একটি জরিপ করেছে। জরিপে ১.৬ লাখ মানুষ এতে অংশ নিয়েছে। এবং তারা মনে করে মধ্য-বিত্ত শ্রেণীর সামাজিক মানদন্ড যাচাই করতে হলে তিনটি বিষয়কে প্রধান বিবেচ্য হিসেবে রাখতেই হবে। এর মধ্যে প্রথমটি খুব সহজেই বোঝা যায়, সেটি হল আর্থিক সম্পদ, মানে আপনার কত টাকা আছে। এরপরে রয়েছে সামাজিক সম্পদ, এটা মানে আপনার সামাজিক মর্যাদা এবং সামাজিক প্রভাব কতটা মজবুত। এবং তৃতীয় বিষয়টি হল সাংস্কৃতিক সম্পদ। মানে আপনার শখ, বিনোদন আর আমোদপ্রমদ ইত্যাদি। এ থেকে বোঝা যায়, যদিও মধ্য-বিত্তের জন্য টাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ব্রিটিশদের চোখে সামাজিক ও মানসিক সম্পদ আরো গুরুত্বপূর্ণ।

এখন আমরা ভারতে যাবো এবং দেখি সে দেশের মধ্য-বিত্তের মানদন্ড কেমন। ভারত বর্তমানে একটি নতুন উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অর্থনীতির সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের মধ্য-বিত্ত শ্রেণীর সংখ্যাও বাড়ছে। আন্তর্জাতিক কন্সুলেট সংস্থা ম্যাকিনসি'র রিপোর্ট অনুযায়ী, পরিবারের বার্ষিক আয় ২ লাখ রুপি থেকে ১০ লাখ রুপি হলে মধ্য-বিত্ত শ্রেণী হিসেবে বলা যায়। এ মানদন্ড অনুযায়ী ভারতের মধ্য-বিত্তের সংখ্যা ২৫ কোটিরও বেশি। বিশ্ব ব্যাংকের মানদন্ড অনুযায়ী, দেশের মধ্য-বিত্তের সংখ্যা ৩০ কোটি। তবে অনেকেই এই পরিসংখ্যান ও মানদন্ডের সাথে একমত নয়। সাধারণ ভারতীয়রা মনে করে, ব্যক্তিগত মাসিক আয় ৩০ হাজার রুপি থেকে ৫০ হাজার রুপি হলে এবং ইংরেজি ভাষা বলতে পারলেই মধ্য-বিত্ত হতে পারবে।

যদিও দেশের উন্নয়নের গতি দ্রুত, তবে ভারতে ধনী আর গরিবের বৈষম্য অনেক বেশী। অন্যান্য দেশের বিবেচনায় মধ্য-বিত্ত শ্রেণীর অবশ্যই গাড়ি আর বাড়ি থাকবে। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয়। ভারতের স্থানীয় তথ্য মাধ্যমের মে মাসের এক জরিপ থেকে জানা যায়, ভারতে শুধু ৪.৭ শতাংশ মানুষের গাড়ি আছে, শুধু ৯.৫ শতাংশ মানুষের লেপটপ বা কম্পিউটার আছে। আর ২১ শতাংশের মানুষের মটরসাইকেল আছে। ৪৭.২ শতাংশের মানুষের টেলিভিশন আছে। অর্থাত্ এই পরিসংখ্যান মতে ভারতের মধ্য-বিত্ত শ্রেণীর মধ্যে খুব কম মানুষেরই গাড়ি অথবা বাড়ি আছে। তাছাড়া ভারতে বাড়ি কিনতে হলে বেশ চড়া মূল্য দিতে হয়। তাই নিজের একটি বাড়ি থাকার স্বপ্ন সহজেই পূরণ করা সম্ভব হয় না।

আমরা একটি দৃষ্টান্ত থেকে ভারতের মধ্য-বিত্ত জীবনধারার কিছুটা হালচিত্র জানতে পারি। কলকাতার অধিবাসী ৩১ বছর বয়সি এক নারী, যিনি ভারতের বৃহত্তম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির টাটার টেলি যোগাযোগ কোম্পানীর একজন মধ্যম শ্রেণীর প্রধান কর্মকর্তা। তার মাসিক বেতন ৮০ হাজার রুপি, কম নয়, তাই না? তিনি নিশ্চিত ভাবেই মধ্য-বিত্ত শ্রেণীর পর্যায়ভূক্ত একজন মানুষ। ৭ বছর আগে তিনি মুম্বাই-এ এসেছেন। আর দশজন ভারতীয় নারীর মতো তিনিও সাধারণ জীবন যাপন করেন। শহরের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি একটি ভাড়া বাড়িতে অন্য একজনের সঙ্গে যৌথভাবে থাকেন। তিনি এখনও বিয়ে করেন নি। শেয়ার করার পরেও তাঁকে মাসিক ২৫ হাজার রুপি ভাড়া গুণতে হয়। অতিসাধারণ জীবন যাপন করতে পছন্দ করেন, কেননা নামীদামি ব্রান্ডের জামাকাপড় ক্রয়ের সক্ষমতা তাঁর নেই। তাই গুণগতমান কিছুটা ভালো অথচ দামে সস্তা এমন কাপড় চোপড়ই বেশি ক্রয় করে থাকেন। যদিও তাঁর কাজের চাপ অনেক বেশি তবুও প্রতি সপ্তাহ অন্তত দু একবার শহরের পশ্চিমা ধাঁচের ভালো খাবার রেস্তরাঁয় খেতে পছন্দ করেন। তাছাড়া অফিস ছুটির পর সহকর্মী বা বন্ধুদের সাথে পানশালায় যেতেও ভাল লাগে তার। এভাবেই প্রয়োজনীয় খাওয়া দাওয়া, বিনোদন আর কেনাকাটার মাধ্যমে মধ্যম শ্রেণীর আরাম আয়াসের জীবন উপভোগ করতেই মাসের টাকা সব ফুরিয়ে যায়, সঞ্চয় বলে কিছুই থাকে না তার হাতে। তথাপিও তিনি তাঁর এই মধ্যবিত্তের টানাটানির জীবন নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট। শ্রোতা, এই হল ভারতের একজন শিক্ষিত এবং বেশ মর্যদাপূর্ণ চাকুরিরত মধ্যবিত্ত নারীর সাধারণ জীবন কথা। শ্রোতারা, এটা শুনে আপনার কেমন লাগছে? অথবা আপনার দৃষ্টিতে মধ্য-বিত্তের জীবন কেমন? আপনার মতামতের অপেক্ষায় রইলাম, আশাকরি আগামী পর্বে আপনার মতামতের ভিত্তিতে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মানদন্ড আর সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কে জানতে পারবো।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক