Web bengali.cri.cn   
জিএসপি সুবিধা পেতে বাংলাদেশের অপেক্ষা
  2013-08-05 17:51:39  cri
যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানিতে বিশেষ অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা ফিরে পেতে বাংলাদেশকে এখন অপেক্ষার প্রহর গুনতে হচ্ছে। সরকার আশা করছে, আগামী ডিসেম্বরে জিএসপি (জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্স) পুনর্বহাল হবে।

জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তর (ইউএসটিআর) যেসব শর্ত দিয়েছে তার কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা বিশ্লেষণে কাজ শুরু করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তা নিয়ে সোমবার আলোচনা হওয়ার কথা আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে।

কর্মকর্তারা জানান, জিএসপি সুবিধা ফেরত পাওয়ার শর্তগুলোর মধ্যে কয়েকটি ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে ভাল অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। কয়েকটি বিষয় নিয়ে সরকার ও মালিকপক্ষ কাজ করছে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে শ্রমিকদের নাজুক কর্মপরিবেশের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক অধিকার সংগঠনের আবেদন এবং কয়েকটি তৈরি পোশাক কারখানার দুর্ঘটনায় অনেক শ্রমিক মারা যাওয়ার প্রেক্ষাপটে গত ২৭ জুন বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করে বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তর। এরপর আশঙ্কা দেখা দেয়, যুক্তরাষ্ট্রের পথ ধরে বাংলাদেশি পণ্যের সর্ববৃহত্ বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নও একই ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে, যেটা বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলতে পারে।

অবশ্য মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তর জানায়, বাংলাদেশের জিএসপি বিষয়টি আগামী ডিসেম্বর মাসে পুনর্বিবেচনা করবে ওবামা প্রশাসন। পরে সুবিধাটি পুনর্বহালের একটি রোডম্যাপ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র, যাতে বলা হয়েছে, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত এবং শ্রম অধিকার বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল এটা ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের শ্রমমানের উন্নয়নে আন্তর্জাতিকভাবেও বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেসব উদ্যোগের মধ্যে ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতাদের প্রক্রিয়ায় সরকার যুক্ত না থাকায় এসবের বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় 'সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্ট' নামে পরিচিত উদ্যোগের প্রায় এক মাস পরও বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মধ্যস্থতায় সরকার একটি ত্রিপক্ষীয় যৌথ ঘোষণা দিয়েছিল। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ১০ দিনের মাথায় পরিস্থিতির উন্নয়নে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ত্রিপক্ষীয় ঘোষণা অনুযায়ী, এ বছরের মধ্যে রপ্তানিমুখী সবগুলো তৈরি পোশাক কারখানার অগ্নিকাণ্ড ও কাঠামোগত নিরাপত্তা পরিদর্শন শেষে করণীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া কারখানা পরিদর্শন-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে কারখানা পরিদর্শকের দপ্তরে আগামী ছয় মাসে অতিরিক্ত ২০০ পরিদর্শক নিয়োগের কথাও রয়েছে।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, কারখানা পরিদর্শন ও নতুন পরিদর্শক নিয়োগের কাজটি ত্রিপক্ষীয় ঘোষণার সময়সূচি অনুযায়ী শেষ হবে না। তবে কাজগুলো যাতে যথাযথভাবে এ সময়ের মধ্যে শুরু করা যায়, সেদিকেই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

শ্রমিক অধিকার সংগঠনের আবেদনের প্রেক্ষাপটে বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তর থেকে জারি করা নোটিশের ওপর গত ২৭ জানুয়ারি চূড়ান্ত মতামত দাখিল করেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ওই সময় সরকার জানায়, শতভাগ পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা হয়েছে। বিভিন্ন শিল্পে গত এক বছরে ১৩৬টি ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে এবং দেশে বর্তমানে সাত হাজার ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে।

সে সময় বলা হয়, মামলাজনিত কারণে চারটি ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন দেওয়া হয়নি। তবে যারা আবেদন করছেন তাদের নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে। চূড়ান্ত মতামতে ওই সময় আরও বলা হয়, অধিকাংশ পোশাক কারখানায় মালিক-শ্রমিক অংশগ্রহণমূলক কমিটি গঠন করা হয়েছে, চিংড়ি শিল্পে শ্রমমান উন্নয়নে গত ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমঝোতা স্বাক্ষর স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং অধিকাংশ কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য জিএসপি সুবিধা পায় ২০০৭ সালে। তবে সর্বেশেষ দফার আগে আরও দু'বার এ সুবিধা বাতিলের জন্য বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তরে আবেদন জানায় অধিকার সংগঠন। অবশ্য সে সব আবদেনের শুনানি শেষে রায়ে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বহাল থাকে।

প্রসঙ্গত, একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য রফতানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব মতে, ২০১১-১২ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট রফতানি করেছে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়েছে মোট পরিমাণের ২১ শতাংশ, অর্থাত্ ৫০০ কোটি ডলারের পণ্য।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে ৪ হাজার ৮৮০টি পণ্যের শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা দিয়েছে। বাংলাদেশের ৯৭টি পণ্যের রফতানিতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার রয়েছে। তবে প্রধান রফতানি পণ্য গার্মেন্টস, টেক্সটাইল এবং নিটওয়্যার পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশের শ্রমমানের উন্নয়নের লক্ষ্যে বর্তমানে সরকার পোশাক কারখানার অগ্নিনিরাপত্তা ও কাঠামোগত মানদণ্ড নিশ্চিতের ওপর জোর দিচ্ছে। গত ২৫ জুলাই সরকার, মালিক ও শ্রমিকপক্ষ ন্যাশনাল ট্রাইপাট্রেট অ্যাকশন প্ল্যান অন ফায়ার, বিল্ডিং অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল সেফটি (এনএপি) নামের সমন্বিত এ কর্মপরিকল্পনায় সই করে। পোশাক কারখানার পরিবেশের মানোন্নয়নে তিন ধাপে — আইনগত, প্রশাসনিক ও বাস্তবায়নের কর্মপন্থার ভিত্তিতে এ কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়। এ কর্মপরিকল্পনায় পরিস্থিতি পর্যালোচনার সময়সীমা এ বছরের ডিসেম্বরে এবং চূড়ান্ত মূল্যায়ন হবে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে।

এদিকে সরকারের সক্রিয় অংশগ্রহণ না থাকায় ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের নেওয়া বড় উদ্যোগের বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইউরোপের ৭৭টি ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতার এ উদ্যোগে বাংলাদেশের শ্রমমানের উন্নয়নের অংশ হিসেবে কারখানার নিরাপত্তা খতিয়ে দেখার কথা বলা হচ্ছে। এমনকি তাদের পক্ষ থেকে কাজ তদারকি করতে বাংলাদেশে ও নেদারল্যান্ডসে দুটি আলাদা দপ্তর খোলার কথা বলা হয়েছে। অথচ তাদের এ প্রক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত সরকারকে যুক্ত করা হয়নি।

অন্যদিকে ত্রিপক্ষীয় ঘোষণায় দেশের সবগুলো রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা পরিদর্শনের কাজ চলতি বছরের মধ্যে শেষ করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হলেও পরিদর্শনের কাজ এখনো শুরু হয়নি। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) কাজটি তদারক করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বুয়েটের তত্ত্বাবধানে দেশের আরও পাঁচটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় ৩০টি দল দুই ধাপে পরিদর্শনের কাজ সম্পন্ন করবে। প্রথম দফায় একবার সব কারখানা পরিদর্শন করে সাধারণ মতামত দেওয়া হবে। এরপর দ্বিতীয় ও শেষ ধাপে প্রতিটি ভবন পরিদর্শন শেষে কোন ক্ষেত্রে কী করণীয়, সে বিষয়ে সুপারিশ করা হবে।

পরিদর্শনকাজে ব্যবহারের জন্য ইতোমধ্যেই যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ২০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ কাজে যেসব যন্ত্রপাতি প্রয়োজন, তার একটি তালিকা ইতোমধ্যেই আইএলওকে দেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে রপ্তানিমুখী সব পোশাক কারখানার পরিদর্শনকাজ শেষ হবে না বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।

মন্তব্য
লিঙ্ক