Web bengali.cri.cn   
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের সংকট
  2013-05-06 18:48:35  cri
বাংলাদেশে শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে অনেকদিন ধরেই কথাবার্তা চলছিল। সম্প্রতি ৫টি তৈরি পোশাক কারখানার ভবন ধসে পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে এ আলোচনা আরও জোরালো হয়ে ওঠে। এ প্রেক্ষাপটে তৈরি পোশাক খাত নিয়ে সম্প্রতি রয়টার্স এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, দেশের পোশাক কারখানার মালিকদের অনেকে পশ্চিমা ব্যবসায়ীদের মতো ধনাঢ্য। তাঁদের জীবনযাপনও বিলাসবহুল, কিন্তু তাঁরা নিজ কারখানার শ্রমিকদের অনেক কম মজুরি ও বেতন দেন ।

মালিকদের দাবি, বিশ্বের নামীদামি ব্র্যান্ডগুলো অনেক কম দামে তাঁদের কাছ থেকে পণ্য কেনে বলে তাঁরা শ্রমিকদের বেশি বেতন দিতে পারেন না। তাঁরা আরও উচ্চমূল্যে পণ্য কিনতে বিদেশি ক্রেতাদের প্রায়ই আহ্বান জানান।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা বিশ্বের যেকোনো দেশের এই খাতের শ্রমিকদের চেয়ে কম বেতন পান। কর্মপরিবেশও নিরাপদ নয়। তবে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও নতুন আসা শিল্প পুলিশের মাধ্যমে শ্রমিক অসন্তোষকে দমিয়ে রাখা হয়।

গত ২৪ এপ্রিল ঢাকার অদূরে সাভারে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, সেখানে কয়েকটি তৈরি পোশাক কারখানা ছিল। এই বিপর্যয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, কর্তৃপক্ষ, মালিক ও ক্রেতাদের সম্মিলিত ব্যর্থতায় কত বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে। একই এলাকার আরেকটি তৈরি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনার পর কর্মস্থলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ছয় মাসের মধ্যেই আবার ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটল। তৈরি পোশাক কারখানায় নিয়োজিত ৪৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিকের বেতন বাড়ানো ও উন্নত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার ব্যাপারে বিশ্বসম্প্রদায়ের চাপ অব্যাহত আছে।

শ্রম-অধিকার বিষয়ক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নেতা বুলবুল আখতার দাবি করেন, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে মালিকরা শ্রমিকদের কম মজুরি দেন। শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনের জেরে তিন বছর আগে তাঁকে জেলে ঢোকানো হয়।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে যারা তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ভালো বেতন ও উন্নত কর্মপরিবেশের দাবিতে সোচ্চার, রাষ্ট্র তাদের অনেক সময় শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার আমিনুল ইসলামকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

বিশ্বব্যাংকের ২০১০ সালের তথ্য অনুসারে, তৈরি পোশাক খাতের সবচেয়ে সস্তা শ্রমবাজার বাংলাদেশ। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার জ্যেষ্ঠ বেতন বিশেষজ্ঞ মাল্টে লুবকের বলেন, এই বেতন কমের মধ্যেও কম।

২০০৪ সাল থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পোশাকের ক্ষেত্রে কিছু কোটা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এতে সুফল পেয়েছে বাংলাদেশ। পশ্চিমা নামী ব্র্যান্ডগুলো যে দামে বাংলাদেশের কাছ থেকে পণ্য কেনে, এর চেয়ে অন্তত ১০ গুণ দামে বিক্রি করে। বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের প্রায় ৬০ শতাংশ ইউরোপে ও ২৩ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে যায়।

২০১০ সালে তীব্র শ্রমিক অসন্তোষের পর তাঁদের সর্বনিম্ন মাসিক মজুরি তিন হাজার টাকা করা হয়। ছোট কারখানাগুলোকে এই সর্বনিম্ন মজুরির বিধান মানতে কড়াভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়। অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান জানায়, তারা সর্বনিম্ন মজুরি হিসেবে পাঁচ হাজার টাকা দেয়। চীনে এই মজুরি বাংলাদেশের চেয়ে আড়াই থেকে সাড়ে তিন গুণ বেশি।

ইপিজেড এলাকায় অবস্থিত চেরি বডি ফ্যাশনসের মহাব্যবস্থাপক ওয়ালেস চু জানান, ১০ বছর আগে হংকংয়ের এই প্রতিষ্ঠানটির চীনা কারখানায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক ছিলেন। এখন চীনের কারখানায় তাদের শ্রমিক ২০০ আর বাংলাদেশে তাদের কারখানায় শ্রমিক আড়াই হাজার। প্রতিষ্ঠানটি টিকে থাকার তাগিদে এখানে তাদের ব্যবসা আরও সম্প্রসারণ করবে বলে তিনি জানান।

শ্রমিকদের মজুরি ও কর্মপরিবেশ উন্নত করার ব্যাপারে পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলোর ক্রমাগত চাপ সম্পর্কে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা মিখাইল শিপার বলেন, তারা সর্বনিম্ন মজুরি বাড়ানোর কথা বলে। কিন্তু তারা বেশি দামে পণ্য কেনার ঘোষণা দেয় না।

তৈরি পোশাক কারখানার একজন মালিক জানান, ২০১১ সালে একজন আন্তর্জাতিক ক্রেতা তাঁকে শার্টপ্রতি পাঁচ মার্কিন ডলার করে দিতেন। পরের বছর একই পণ্যের জন্য ওই ক্রেতা সাড়ে চার মার্কিন ডলার করে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। দুই বছর ধরে এখানকার তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারীদের অন্তত ৪০ শতাংশ কম মূল্যে কাজ নিতে হচ্ছে।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে দর-কষাকষিতে যেতে চান না মালিকেরা। কারণ, বড় কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ ফিরিয়ে দিলে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো সেগুলো লুফে নেওয়ার চেষ্টা করে।

একটি অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে অনেক শ্রমিক সর্বনিম্ন মজুরির চেয়েও কম পান। বোনাসও অনেক কম তাঁদের।

শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিলে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ২০১০ সালে প্রায় তিন হাজার সদস্য নিয়ে শিল্প পুলিশ গঠন করে। শ্রমিক অধিকারকর্মী বুলবুল আখতার বলেন, শ্রমিকেরা দাবিদাওয়া নিয়ে মাঠে নামলে শিল্প পুলিশ এসে তাঁদের কাজে ফিরে যেতে বলে। যদি শ্রমিকেরা তা না করে, তাহলে লাঠিপেটা শুরু হয়।

তবে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম জানান, সরকার শ্রমিক ইউনিয়ন সমর্থন করে। সরকার চায়, তারা আরও জোরালো ভূমিকা পালন করুক। একই সঙ্গে তাঁর দাবি, সরকার শ্রমিকপন্থী।

বাংলাদেশের পোশাকখাতে শ্রমিকের মজুরি যখন গড়ে প্রতিদিন মাত্র দুই ডলার অর্থাত্ দেড় শ' টাকা এবং যখন পোশাক খাতের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমন নাজুক, তখন কীভাবে সামনে আগাবে এ খাতটি সেটাই বড় প্রশ্ন।

মন্তব্য
লিঙ্ক