আকাশ ছুঁতে চাই ৬৪
2024-04-04 17:58:06

১.  বাংলাদেশকে ভালোবাসেন চীনা নারী লিউ ইফাং

২. ভূমিদাসী থেকে মুক্ত জীবনে

নারী ও শিশু বিষয়ক অনুষ্ঠান আকাশ ছুঁতে চাই থেকে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আমাদের অনুষ্ঠানে আমরা কথা বলি নারী ও শিশুর অগ্রযাত্রা, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, সাফল্য, সংকট সম্ভাবনা নিয়ে। আমরা কথা বলি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার নিয়ে।

বাংলাদেশকে ভালোবাসেন চীনা নারী লিউ ইফাং

বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন চীনা নারী লিউ ইফাং। পদ্মা রেলওয়ে সংযোগ প্রকল্পের ডিভিশন ছয় এর ইউনিট ২ তে দোভাষী হিসেবে কাজ করেন তিনি। নারীবান্ধব পরিবেশ, বন্ধুর মতো সহকর্মী লিউকে দিয়েছে কিছু ভালো অভিজ্ঞতা। আজকে শুনবো লিউ ইফাংয়ের বাংলাদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা।

আধো আধো বাংলা বলা শিখে গেছেন ২৬ বছর বয়সী নারী লিউ ইফাং। ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশে কাজ করছেন এই নারী। পদ্মা রেলওয়ে সংযোগ প্রকল্প নির্মাণকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন-সিআরইসির ডিভিশন ছয় এর ইউনিট ২’য়ে দোভাষী হিসেবে কাজ করেন তিনি।

সিআরইসির নারীবান্ধব কর্মময় পরিবেশে সকলের মতো একইরকম সুযোগ সুবিধা পেয়ে কাজ করে চলেছেন এই নারী।

লিউ ইফাং বলেন, ‘আমি এখানে অন্য সহকর্মীদের মতো সমান সুযোগ-সুবিধা পাই। এখানে সবকিছুই সমান। সিআরইসি নারী কর্মীদের সব সময় স্বাগত জানায়। তাই ধন্যবাদ জানাই সিআরইসিকে। এখানে অনেক নারী নিয়োগ পাচ্ছেন। এতেও আমি খুব খুশি।’

এই প্রকল্প নির্মাণে কর্মরত চীনা ও বাংলাদেশির কথা চীনা কিংবা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন তিনি। কখনো অফিসে আবার কখনো মাঠে গিয়ে এই কাজ করতে হয় তাকে।

 লিউ ইফাং বলেন, একজন দোভাষী হিসেবে আমাকে সব সময় সাইটে যেতে হয়। সাইটের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে হয়। 

চীনা ও বাংলাদেশি মিলেমিশে কাজ করার যে উদাহরণ তৈরি করেছে সিআরইসি, সেখানে লিউ ইফাংও একজন। তবে শুরুর দিকে নিজ দেশের বাইরে ভিন্ন একটি দেশে কাজ করার যে ভয় লিউ ইফাংয়ের মধ্যে ছিল, তা ভিত্তিহীন হওয়ায় হেসে উড়িয়ে দিচ্ছেন এই নারী।

 কেননা বাংলাদেশিদের ব্যবহার , কথা বলার ধরণ মুগ্ধ করেছে তাকে। এখন সবাই যেন তার বন্ধু।

এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যখন আমি বাংলাদেশে প্রথম আসি তখন একটু দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। দেশের বাইরে এটাই আমার প্রথম কাজ। আমার ভয় ছিল স্থানীয়রা কেমন হবে, যখন আমি বাংলাদেশে এলাম, দেখলাম স্থানীয়রা বেশ বন্ধুসুলভ। যখন আমি বাইরে যাই তারা খুব সাহায্য করে, তারা খুব উদ্যমী। 

দিন যত যাচ্ছে বাঙ্গালিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়ছে লিউ ইফাংয়ের। আর স্মৃতিতে জায়গা করে নিচ্ছে মজার মজার অভিজ্ঞতা।

মধুময় স্মৃতির কথা স্মরণ করতে গিয়ে লিউ ইফাং বলেন, প্রতিবছর এখানকার কর্মীরা অনেক আম নিয়ে আসে অফিসে। একদিন আমি বাইরে থেকে অফিসে এসে দরজা খুলে তো অবাক। অনেকগুলো আম । আমি এখানকার পরিবেশ, খাবার ও মানুষদের খুব পছন্দ করি। তাদের কারণেই আমার মনে হয়, সিআরইসি আমার বাড়ি।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লিউ ইফাং নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশিদের খাবার, সংস্কৃতি , ঐতিহ্যকে সঙ্গী করে এগিয়ে চলেছেন এই নারী।

প্রতিবেদন- আফরিন মিম

সম্পাদনা- শান্তা মারিয়া

ভূমিদাসী থেকে মুক্ত জীবনে

চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল সিচাং বা তিব্বত। ১৯৫৯ সালের ২৮ মার্চ ছিল সিচাং বা তিব্বতবাসীর জন্য এক অনন্য আনন্দের দিন। এদিন সিচাং এর ১০ লাখের বেশি ভূমিদাস (সার্ফ) দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে নতুন জীবনে প্রবেশ করেন।

শত শত বছর ধরে তিব্বতে দাসত্ব প্রথা ছিল। ১৯৪৯ সালে চীনের মহান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে ১৯৫৯ সালের ২৮ মার্চ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল সিচাংয়ের দশ লাখের বেশি ভূমিদাসের মুক্তি ঘটে। ২০০৯ সালে আঞ্চলিক আইনসভা ২৮ মার্চকে ১০ লাখ ভূমিদাসের মুক্তি দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।

১৯৫৯ সালের পর তিব্বতের অসংখ্য মানুষ ভূমিদাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে নতুন জীবনের আস্বাদ পান।  এমনি একজন নারীর গল্প শুনবো প্রতিবেদনে।

দক্ষিণ পশ্চিম চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল সিচাং ।শত শত বছর ধরে এখানে প্রচলিত ছিল ভূমিদাস প্রথা বা সার্ফডম। এই অমানবিক প্রথায় মানুষের উপর চলতো নির্যাতন। এখানে মানুষকে জোর করে আটকে রাখা হতো। তাদের দিয়ে কঠোর শ্রম করানো হতো। তাদের পেটভরে খাওয়া জুটতো না। পরনের কাপড় ছিল ছেড়াখোঁড়া। শীত নিবারণের তেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না। পশুর খোঁয়াড়ের ভিতর কোনভাবে থাকতে হতো দাসদের। প্রাসাদে মনিবদের জন্য খাটতে হতো সারাদিন।

শিক্ষাগ্রহণের অধিকার ছিল না। রোগ হলে চিকিৎসাও জুটতো না।  জীবনের কোন উজ্জ্বল দিক ছিল না।

 

শতাব্দিব্যাপী এই নির্যাতনের অবসান ঘটে ১৯৪৯ সালের চীনের মহান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে। ১৯৫৯ সালে সিচাংয়ের অসংখ্য মানুষ মুক্তির স্বাদ পান। এদেরই একজন কেলসাং ছোড্রোন। এই নারীর জন্ম ১৯৩৪ সালে। শৈশবে তিনি ছিলেন স্থানীয় প্রাসাদের ভূমিদাসী। তার বাবা মাও ছিলেন ভূমিদাস। তাদের বাধ্য করা হতো কঠোর পরিশ্রম করতে। কাজ ছেড়ে চলে যাওয়ার অধিকার ছিল না। পালানোর চেষ্টা করলে চলতো নিষ্ঠুর নির্যাতন।

কেলসাংয়ের শৈশব ছিল যন্ত্রণাময়। দিনরাত সীমাহীন কঠোর শ্রম ও ক্ষুধা নিয়ে বেঁচে থাকা ছিল ভীষণ যন্ত্রণার। ভালোভাবে একবেলাও খেতে পারেননি কখনও। পরনের কাপড় ছিল শতছিন্ন। জুতা পায়ে প্রাসাদের ভিতরে ঢোকার অনুমতি ছিল না। থাকতে হতো খোঁয়াড়ের ভিতর।  শীতে, ক্ষুধায় ও কঠিন শ্রমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন বালিকা কেলসাং। এক সময় কেলসাং ও প্রাসাদের অন্য দুজন ভূমিদাসী মেয়ে একসঙ্গে পালানোর পরিকল্পনা করেন। গভীররাতে চুপি চুপি পালিয়ে যায় তিনটি মেয়ে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। তিনজনেই ধরা পড়েন। কপালে আরও দুর্ভোগ নেমে আসে। নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করা হয় তাদের।

১৯৫৯ সালের পর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। মুক্তি মেলে দাসত্ব থেকে। নতুন জীবন গড়ে তোলেন কেলসাং। বিয়ে করেন। চার সন্তানের মা হন। স্বামীর সঙ্গে সুখী জীবন কাটান তিনি।

বর্তমানে কেলসাং তার নাতি নাতনিসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একটি দোতলা বাড়িতে থাকেন। তিনি তার অতীতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করেন। তবে বর্তমানের সুখী জীবনের জন্য তিনি বিপ্লবকে ধন্যবাদ দেন।

 বলেন,  ‘আমার জীবন থেকে ক্ষুধার কষ্ট চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছে।’

কেলসাংয়ের গল্প সিচাংয়ের অসংখ্য মানুষের উন্নত সুখী মুক্ত জীবনকে তুলে ধরে যারা অতীতে দাসত্বের শিকলে বাঁধা ছিলেন। 

প্রতিবেদন: শান্তা মারিয়া

সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

সুপ্রিয় শ্রোতা আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছি আমরা।

অনুষ্ঠানটি কেমন লাগছে সে বিষয়ে জানাতে পারেন আমাদের কাছে। আপনাদের যে কোন পরামর্শ, মতামত সাদরে গৃহীত হবে। আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আবার কথা হবে আগামি সপ্তাহে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।

সার্বিক সম্পাদনা : ইয়ু কুয়াং ইউয়ে আনন্দী

লেখা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: শান্তা মারিয়া

অডিও সম্পাদনা: রফিক বিপুল