দেহঘড়ি পর্ব-৬০
2024-03-03 10:00:05

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং ভেষজের গুণ নিয়ে আলোচনা ‘হারবাল হিলিং’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

নিউমোনিয়ার টিসিএম চিকিৎসা

নিউমোনিয়া শ্বাসযন্ত্রের এক ধরনের সংক্রমণ, যা এক বা উভয় ফুসফুসের বায়ুথলিতে প্রদাহ সৃষ্টি করে, যার ফলে কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। এটি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক বা অন্যান্য অণুজীবের কারণে হতে পারে। তবে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস নিউমোনিয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ। নিউমোনিয়া হালকা থেকে গুরুতর পর্যন্ত হতে পারে এবং কখনও কখনও, বিশেষ করে বয়স্ক, ছোট শিশু এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে, জীবন-হুমকির কারণও হতে পারে।



প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় ব্যাকটেরিয়াজনিত নিউমোনিয়া চিকিৎসায় সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়। পাশাপাশি এ রোগের উপসর্গ উপশমের জন্য বিশ্রাম, তরল গ্রহণ এবং ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধের মতো সহায়ক যত্ন প্রয়োজন হয়। অবস্থা গুরুতর হলে অক্সিজেন থেরাপি এবং হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে। নিউমোকোকাল নিউমোনিয়া এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা-সম্পর্কিত নিউমোনিয়ার মতো নির্দিষ্ট ধরনের নিউমোনিয়া প্রতিরোধে ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। জটিলতা এড়ানো এবং নিউমোনিয়া থেকে সেরে উঠার জন্য দ্রুত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় প্রাচীনকাল থেকে ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসাপদ্ধতি (টিসিএম) ব্যবহৃত হয়ে আসছে। টিসিএম তত্ত্বে মনে করা হয়, শরীরে যে কোনও রোগের কারণ মূলত নির্দিষ্ট অঙ্গে মূল শক্তি বা ‘ছি’ ও রক্ত প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা বা স্থবিরতা। নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। নিউমোনিয়ার টিসিএম চিকিৎসায় বেশ কয়েকটি পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, যার প্রতিটির লক্ষ্য থাকে ‘ছি’র ভারমাস্য দূর করা এবং তার মধ্য দিয়ে সামগ্রিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা। তবে এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, নিউমোনিয়ার চিকিৎসার জন্য, বিশেষ করে গুরুতর ক্ষেত্রে, প্রচলিত চিকিৎসার পাশাপাশি টিসিএম চিকিৎসা ব্যবহার করা উচিত। জানিয়ে দিচ্ছি নিউমোনিয়ার জন্য কিছু সাধারণ টিসিএম চিকিৎসা:

ভেষজ: টিসিএম চিকিৎসকরা একজন রোগীর নির্দিষ্ট লক্ষণ এবং শারীরিক গঠন অনুসারে ভেষজ ফরমুলেশন নির্ধারণ করেন। নিউমোনিয়া চিকিৎসার জন্য সাধারণভাবে যেসব ভেষজ ব্যবহৃত হয়, সেগুলোর মধ্যে থাকে অ্যাস্ট্রাগালাস রুট (হুয়াং ছি), পিনেলিয়া রাইজোম (পান সিয়া), ইফেড্রা (মা হুয়াং), যষ্টিমধু (কান ছাও) এবং প্ল্যাটিকোডন রুট (চিয়ে ক্যং)।

অ্যাস্ট্রাগালাস রুট ‘ছি’ ভারসাম্যহীনতার বিরুদ্ধে লড়ে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে; পান সিয়া কফ ও কাশি দূর করে; ইফেড্রা বুকের ভিতর জমাট বাঁধা পরিস্থিতি দূর করতে এবং জ্বর কমাতে সাহায্য করে; যষ্টিমধুর প্রদাহ-বিরোধী ও কফ-উপশমকারী বৈশিষ্ট্য কাশি কমায় এবং প্ল্যাটিকোডন রুট ফুসফুস থেকে কফ বের করে দিতে সাহায্য করে।

আকুপাংচার: নিউমোনিয়ার আকুপাংচার চিকিৎসা ফুসফুস, রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা এবং শরীরের ‘ছি’ ভারসাম্য সম্পর্কিত বিন্দুগুলোকে ফোকাস করে। এটি কাশি, বুকে চাপ অনুভব এবং শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গগুলো উপশম করতে সাহায্য করতে পারে।

মক্সিবাস্টন: নিউমোনিয়ার চিকিৎসার জন্য বুক ও পিঠের বিন্দুতে মোক্সা প্রয়োগ করা হয়। এ চিকিৎসা ফুসফুসের চাপ কমাতে, শ্বাসযন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়াতে এবং রোগজীবাণু বের করে দিতে সাহায্য করে।

ডায়েট থেরাপি: নিউমোনিয়ার উপসর্গ উপশমে সাধারণত উষ্ণ, পুষ্টিকর খাবার ও পানীয় গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে স্যুপ, ঝোল, ভেষজ চা, এবং ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ খাবার যেমন ফল, শাকসবজি ও চর্বিহীন প্রোটিন অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এসব খাবার ফুসফুসের সুস্থতায় সমর্থন যোগায় এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়।

বিশ্রাম ও মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনা: পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনা নিউমোনিয়ার টিসিএম চিকিৎসার একটি অপরিহার্য উপাদান। বিশ্রাম শরীরকে শক্তি সঞ্চয় করতে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। এছাড়া ধ্যান, ছিকং বা থাইচির মতো মানসিক চাপ কমানোর কৌশলগুলো সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও রোগ নিরাময়ে সহায়তা করতে পারে।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

দক্ষিণ চীনের সামনের সারির স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান শেনচেন গণহাসপাতাল

চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় কুয়াংতুং প্রদেশের প্রাণবন্ত শহর শেনচেন অবস্থিত শেনচেন গণহাসপাতাল। প্রায় আট দশক আগে ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালটি এ অঞ্চলের চিকিৎসাসেবা ও উদ্ভাবনের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। একটি সমৃদ্ধ ইতিহাসের অধিকারী এই প্রতিষ্ঠানটি অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যসেবা চাহিদা মেটাতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, গবেষণা ও সেবার একটি অসাধারণ সমন্বয় ঘটিয়েছে।

প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার বর্গমিটার এলাকা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত ৩ হাজার শয্যার এ হাসপাতালে কাজ করেন প্রায় ১ হাজার জ্যেষ্ঠ পেশাদারসহ ৫ হাজারের বেশি কর্মী। তাদের মধ্যে রয়েছেন ২২ জন ডক্টরাল সুপারভাইজার রয়েছে এবং ১৫৭ জন মাস্টার্স সুপারভাইজার। এখানে বছরে ভর্তি করা হয় প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার রোগী আর বহির্বিভাগ থেকে চিকিৎসা দেওয়া হয় প্রায় ৩৫ লাখ রোগীকে।

শেনচেন গণহাসপাতালে বর্তমানে দুটি জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ক্লিনিক্যাল বিভাগ রয়েছে। এগুলো হলো শ্বাসযন্ত্র ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন এবং জেনারেল সার্জারি। পাশাপাশি এখানে রয়েছে ৭টি প্রাদেশিক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ক্লিনিক্যাল বিভাগ -- জেনারেল সার্জারি, থোরাসিক সার্জারি, ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, নিউরোলজি, কার্ডিওভাসকুলার মেডিসিন এবং রেনাল সার্জারি।

হাসপাতালটি বিশ্বের বিভিন্ন বিখ্যাত চিকিৎসা ও চিকিৎসাশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিতভাবে পেশাদার ও প্রযুক্তি কর্মী পাঠায় প্রশিক্ষণ দিতে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ও নিউ ইয়র্ক কর্নেল প্রেসবিটারিয়ান হসপিটাল, হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল, ক্লিভল্যান্ড মেডিকেল সেন্টার, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি এবং জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন ও এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি, জার্মানির ইউনিভার্সিটি হসপিটাল অব রেজেনসবার্গ, সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হসপিটাল, হংকংয়ে ইউনিভার্সিটির প্রিন্স অব ওয়েলস হসপিটাল, কুইন মেরি হসপিটাল, পিকিং ইউনিয়ন মেডিকেল কলেজ হসপিটাল, সিচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েস্ট চায়না হসপিটাল এবং চীনের গণমুক্তি ফৌজের জেনারেল হসপিটাল।

 

#হারবাল_হিলিং

চন্দ্রমল্লিকা একটি উচ্চমানের ভেষজও

চন্দ্রমল্লিকা একটি অতি পরিচিত ফুল। তবে এই ফুলের খ্যাতি তার সৌন্দর্যের জন্য যতটা, তারচেয়ে বেশি তার ভেষজ গুণের কারণে। জানিয়ে দিচ্ছি চন্দ্রমল্লিকার ভেষজ গুণ সম্পর্কে:

প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়ে: চন্দ্রমল্লিকায় ফ্ল্যাভোনয়েড ও অন্যান্য বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ রয়েছে, যেটি প্রদাহের বিরুদ্ধে কাজ করে। চন্দ্রমল্লিকায় চা পান করলে বা এর নির্যাস গ্রহণ করলে শরীরে বাত বা অন্যান্য প্রদাহ কমে।

 

রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়: চন্দ্রমল্লিকা ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ, যা সামগ্রিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। তাই নিয়মিত ক্রাইস্যান্থেমাম চা সেবনে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হয় এবং সংক্রমণের ঝুঁকি কমে।

চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করে: চন্দ্রমল্লিকা চা শরীরে শীতল প্রভাব আনে বলে বিশ্বাস করা হয়। তাই ক্লান্ত চোখে প্রশান্তি আনতে এবং চোখের ওপর চাপ কমাতে এটি ব্যবহৃত হয়। এতে রয়েছে লুটেইন ও জেক্সানথিনে মতো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা চোখকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং ম্যাকুলার ক্ষয় থেকেও রক্ষা করে।

যকৃতকে সুস্থ রাখে: চন্দ্রমল্লিকা বিষাক্ত পদার্থ থেকে লিভারকে রক্ষা করে। এটি লিভারের কার্যকারিতা উন্নীত করতে, বিষাক্ত পদার্থ বের দেওয়ার প্রক্রিয়া উন্নত করতে এবং টক্সিন বা অ্যালকোহল সেবনের কারণে সৃষ্ট ক্ষতি থেকে লিভারকে বাঁচাতে ব্যবহৃত হয় প্রাচীন কাল থেকে।

 

 ‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।