‘ঘুরে বেড়াই’ পর্ব- ৩৯
2023-10-10 19:19:47

এবারের পর্ব সাজানো হয়েছে   

১। টানা ৮ দিনের ছুটিতে চাঙ্গা চীনের পর্যটন খাত  

২। দর্শনার্থীদের আগ্রহের কেন্দ্রে কাশগরের ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য

৩। বেইজিংয়ের বেল টাওয়ার ও ড্রাম টাওয়ার  

 

বিশ্বব্যাপী অপরূপ সৌন্দর্যের চাদর বিছিয়ে রেখেছে বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি। কতো-শতো দেশ, কতো সংস্কৃতি, কতো ভাষা, কতো পেশা,.... কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতি কিংবা সময়ের টানাটানিতে দেখা হয় না, ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’ 

‘একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশির বিন্দু...’সেই অদেখাকে দেখাতেই আমাদের আয়োজন "ঘুরে বেড়াই"।

দেশ-বিদেশের দর্শনীয় স্থান, সেখানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, এবং সেই স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অর্থনীতি নিয়ে আমাদের অনুষ্ঠান ‘ঘুরে বেড়াই’।  

ঘুড়ে বেড়াই অনুষ্ঠানের ৩৯তম পর্ব আজ। আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি, আফরিন মিম।    

১। টানা ৮ দিনের ছুটিতে চাঙ্গা চীনের পর্যটন খাত

 

২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত ছিল চীনের মধ্য শরত ও জাতীয় দিবসের ছুটি। এবারের ছুটি ছিল চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে টানা দীর্ঘতম সরকারি ছুটি। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা ঘুরতে আসেন এই অঞ্চলে।

 

আট দিনের এই দীর্ঘ ছুটি মানুষের ভ্রমণের উৎসাহ পুনরুজ্জীবিত করে এবং তাদের বিভিন্ন অবকাশ কার্যকলাপে নিযুক্ত হতে সক্ষম করে। এ সময়টাতে পুরোদমে চাঙ্গা হয়ে উঠে পর্যটন এবং ভোগ।

 

চীনের সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয় বলছে, এই বছরের মধ্য-শরৎ উৎসব এবং জাতীয় দিবসের ছুটিতে চীন জুড়ে মোট ৮২৬ মিলিয়ন অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭১ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি।

 

জাতীয় অভিবাসন প্রশাসন-এনআইএ বলছে, মধ্য-শরৎ উৎসব ও জাতীয় দিবসের ৮ দিনের ছুটিতে ১১.৮ মিলিয় আন্তঃসীমান্ত ভ্রমণ হয়েছে। এনআইএ’র তথ্য অনুসারে, প্রায় ৫.৮৭ মিলিয়ন ট্রিপ ইনবাউন্ড বা অভ্যন্তরমুখী এবং প্রায় ৫.৯৫ মিলিয়ন আউটবাউন্ড বা বহির্মুখী ট্রিপ ছিল।

 

দৈনিক প্রবেশ এবং প্রস্থান ভ্রমণের গড় সংখ্যা প্রায় ১.৪৮ মিলিয়নে পৌঁছেছে, যা ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় ২.৯ গুণ বেড়েছে।

 

চিয়াংসু প্রদেশের হুয়াইআন গ্রন্থাগারে জাতীয় দিবসের ছুটিতে সাহিত্যপ্রেমীদের ঢল নামে। চমৎকার শৈলীর নকশা এবং সাজসজ্জার সাথে মিশ্রিত এই গ্রন্থাগারটি নতুন খোলা হয়েছে। অল্প সময়েই সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে পরিদর্শনযোগ্য হয়ে উঠেছে এটি। কারণ এর সৌন্দর্য সবাইকে খুব আকর্ষণ করে।

 

এর নকশার নান্দনিকতা এবং নিমগ্ন পড়ার স্থানগুলোর মিশ্রণ বইয়ের দোকানটিকে শহরের একটি নতুন পর্যটন চুম্বক আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠতে উৎসাহিত করেছে। তাই জাতীয় দিবসের ছুটির সময় দল বেঁধে ছুটে আসছেন অনেকে। বই পড়ার থেকেও এখানে এসে ঘুরে দেখতে পছন্দ করছেন তারা। এটিকে বাস্তব জীবন থেকে পালাতে একটি আশ্রয়স্থলের মতো মনে করছেন কেউ কেউ।

 

বেইজিং, সাংহাই এবং হাংচৌর মতো শীর্ষস্থানীয় গন্তব্যস্থল থেকে শুরু করে সিনচিয়াংয়ের উরুমুছির মতো উত্তর-পশ্চিমের শহর পর্যন্ত, এমনকি সারাদেশের রিসোর্টগুলোতে পর্যটকে কানায় কানায় পূর্ণ ছিলো।

 

দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সিচুয়ান প্রদেশে, ছুটির প্রথম ছয় দিনে প্রায় ৩ কোটি মানুষ ভ্রমণ করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২শ’ শতাংশ বেশি।

 

টানা আটদিনের ছুটিতে চাঙ্গা হয়েছে চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল ম্যাকাওয়ের পর্যটন খাত। ছুটির এই সময়ে এ অঞ্চলের পর্যটন গন্ত্যবগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ১৬ হাজার দর্শনার্থী ভ্রমণ করেছে, যা গেল বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ দশমিক ৬ গুণ বেশি।

 

ম্যাকাও পুলিশের দেওয়া তথ্য বলছে, এই ছুটির দিনগুলোতে মোট ৯ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি দর্শনার্থী ভ্রমণ করেছে, যা গেল বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি।

 

পর্যটন বাজারকে আরও বৈচিত্র্যময় করার জন্য এবার বিশেষ উদ্যোগ নেয় ম্যাকাও। এছাড়া ১অক্টোবর ৩১তম ম্যাকাও আন্তর্জাতিক আতশবাজি প্রদর্শন প্রতিযোগিতারও আয়োজন করে ম্যাকাও।

 

প্রতিবেদন- আফরিন মিম

সম্পাদনা- মাহমুদ হাশিম

 

২। দর্শনার্থীদের আগ্রহের কেন্দ্রে কাশগরের ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য

সারাদিন উত্তাপ ছড়ানোর পর সূর্য পূর্ব থেকে পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে গেলে শীতল বাতাসের সঙ্গে সন্ধ্যা নামে। আর এ শীতল বাতাস দিনের প্রখর তাপকে ভুলিয়ে দেয় নিমিষেই। এভাবেই শুরু হয় চীনের উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল সিনচিয়াংয়ের থারিম বেসিন অঞ্চলের মরূদ্যান শহর কাশগরে রাতের জীবন।

২১০০ বছরের পুরানো এ শহরটির ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য নিজ চোখে উপভোগ করতে জুলাই থেকেই আসতে থাকেন পর্যটকরা। এর ফলে শহরটিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য উইগুর ও হুই মুসলিমদের পরিচালিত গেস্টহাউস, রেস্টুরেন্ট, কফিখানা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা ভ্রমণ পিপাসুরা দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের পাশাপাশি স্থানীয়দের উষ্ণ আতিথেয়তা উপভোগ করেন। 

এমনি এক বাসভবন ‘গুলি’স হোম, যা রাতারাতি গেস্টহাউসে পরিণত হয়েছে। এ গেস্টহাউসে চা পানের সঙ্গে দর্শনার্থীরা ৮০ বছর বয়সী ইসমায়েল সাউতের সঙ্গে একজন তরুণীর ঐতিহ্যবাহী নৃত্য উপভোগ করেন।

 

২০১৭ সালে ইসমায়েলের নাতনি সালামতগুল দোতলা এ গেস্টহাউসটি শুরু করেন। বর্তমানে গেস্টহাউসটি রয়েছে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে। তার গেস্টহাউসে গড়ে প্রতিদিন ৩০০ পর্যটক আসে, যারা একসঙ্গে নাচ, খাবার খাওয়া এবং আড্ডা দিয়ে থাকেন।

৩০০ বছরের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে মাইমাইতির একটি পুরনো বাড়ির। বাড়িটির দেওয়ালে রয়েছে উইগুর পোশাক ও সাজসজ্জা সম্বলিত তরুণীদের ছবি।  ৭০০ বর্গ মিটার আয়তনের পুরো বাড়িতে রয়েছে শয়নকক্ষ, শস্যাগার এবং কার্পেট রুমসহ ২০টি কক্ষ।  স্থানীয় ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির একটি ভাল প্রদর্শনী এ বাড়িটি। পাশাপাশি বাড়িটি পর্যটকদের কাছে হয়ে উঠেছে ছবি তোলার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।

২০২০ সালে শহরটিতে ফটো ট্যুর ব্যবসার (স্থানীয় পোশাক ও মেকআপসহ ছবি তোলা) দোকান ছিল মাত্র দুটি, যা বর্তমানে বেড়ে প্রায় ২০০টি হয়েছে। কাশগরের সান সিটি ফটো-শুটিং ট্যুরের ম্যানেজার ৩৫ বছর বয়সী সং হানি ইউ। ছয় মাস আগে তিনি পুনরায় ১ হাজার ৫০০ বর্গ-মিটার থিয়েটারে ফটো-শুটিং ট্যুর ব্যবসা শুরু করেছেন, যা কোভিড-১৯ মহামারীর আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পিক টাইম বিশেষ করে, মে দিবসের মতো ছুটির দিনগুলোতে দোকানটি প্রায় ২০০ জন গ্রাহক পেয়ে থাকে। এ থিয়েটারে পোশাক, সাজসজ্জা এবং ৪০টি ফটোসহ সর্বনিম্ন অর্ডারের মূল্য ৪৯৯ ইউয়ান বা ৬৮ ডলার।

তিনি বলেন, “অসংখ্য পর্যটক কাশগর দেখতে আসছেন। ফটো-শুটিং ট্যুর ব্যবসাও প্রসারিত হয়েছে। কেননা পর্যটকরা স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী পোশাক এবং দৃশ্য পছন্দ করে।”

স্থানীয় সরকারের ওয়েবসাইটের তথ্যানুসারে, মে দিবসের ছুটির সময় সিনচিয়াং-এর অন্যতম শীর্ষ পর্যটন কেন্দ্রের তালিকায় ছিল কাশগর। প্রায় ২ লাখ ৫৫ হাজার পর্যটক এসেছিল এবারের ছুটিতে, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ১৩৬ শতাংশ বেশি।

স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলটির শীর্ষ নিউজ পোর্টাল টিএসডটসিএন এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত আগস্ট মাসে, প্রায় ১ দশমিক ২৩ মিলিয়ন দর্শনার্থী প্রাচীন এ শহরটি পরিদর্শন করেছে, যা এক মাসে প্রথমবারের মতো ১ মিলিয়ন অতিক্রম করে।

প্রতিবেদন- শুভ আনোয়ার

সম্পাদনা- আফরিন মিম

 

৩। বেইজিংয়ের বেল টাওয়ার ও ড্রাম টাওয়ার  

বেইজিংয়ের একটি বিখ্যাত পর্যটন গন্তব্য বেল টাওয়ার ও ড্রাম টাওয়ার। দুটি প্রাচীন ভবন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। এটি বেইজিংয়ের অক্ষরেখার মধ্যেই পড়েছে। প্রাচীন ঐতিহাসিক ভবনগুলো মূলত বেইজিংয়ের প্রাণকেন্দ্রে থিয়েন আনমেন চত্বর এবং ফরবিডেন সিটি বা রাজপ্রাসাদের কাছাকাছি অবস্থিত। এই এলাকাটিকে বলা হয় অক্ষরেখা। প্রাচীন শহরে নানলো কুশিয়াং হুথোংয়ের কাছে তি’য়ানমেন স্ট্রিটে ড্রাম টাওয়ার ও বেল টাওয়ার অবস্থিত।

ড্রাম টাওয়ারের ভিতরে আছে একটি বিশাল ঢোল এবং আরও কিছু ছোট আকারের ঢোল। বেল টাওয়ারে আছে বিশাল একটি ঘন্টা এবং আরও কিছু ছোট ঘন্টা। ইয়ুয়ান, মিং ও ছিং রাজবংশের শাসনামলে এই দুটি টাওয়ারের মাধ্যমে রাজকীয় ঘোষণা এবং সময়ের হিসাব রাখা হতো। প্রতি ঘন্টায় বেল টাওয়ারের ঘন্টা বাজিয়ে সময় ঘোষণা করা হতো। রাজকীয় কোন বিশেষ ঘোষণা থাকলে ড্রাম বাজানো হতো।

এখন দুটি টাওয়ারই পর্যটন স্থান হিসেবে গণ্য। প্রতিদিন সকালে ও বিকালে একটা নির্দিষ্ট সময়ে ড্রাম ও বেল বাজানো হয়। বাদকরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেন। পর্যটকরা এই দৃশ্য উপভোগ করেন।

 

ড্রাম টাওয়ার নির্মিত হয় ১২৭২ সালে। ৪৭ মিটার উচুঁ ড্রাম টাওয়ারটি দোতলা। সিঁড়ি কাঠের তৈরি। উপরের তলায় ২৪টি কাঠের তৈরি ড্রাম রয়েছে। বেল টাওয়ার ৩৩মিটার উঁচু। মধ্যযুগে বেইজিং শহরের  অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও উঁচু স্থাপনা ছিল এ দুটি টাওয়ার। বিশেষ দিনগুলোতে এখানে বিশেষ সংগীত অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হতো।

পর্যটকরা নানলোকুশিয়াং হুথোং এর সাবওয়ে স্টেশন থেকে সহজে এখানে যেতে পারবেন। পাশেই রয়েছে রেস্টুরেন্ট পাড়া। চীনের বিভিন্ন জাতির ঐতিহ্যবাহী খাদ্য পাওয়া যায় এসব রেস্টুরেন্টে। সেখানে মুসলিম রেস্টুরেন্টও রয়েছে।

বেল টাওয়ার ও ড্রাম টাওয়ারের কাছে চীনা ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পের দোকান আছে। আরও আছে প্রাচীন যুগের চীনা রিকশার আদলে বানানো সুন্দর কিছু রিকশা। পর্যটকরা এসব রিকশায় চড়ে বেড়াতে পারেন।

মধ্যযুগের চীনা নগরজীবনের আমেজ অনুভব করতে চাইলে যেতে পারেন ড্রাম টাওয়ার ও বেল টাওয়ার দেখতে।

প্রতিবেদন- শান্তা মারিয়া

সম্পাদনা- আফরিন মিম

 

 

ঘুরে বেড়াই অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও প্রযোজনা - আফরিন মিম

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী