পদ্মা সেতু: বাংলাদেশের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক
2022-06-26 20:06:40

প্রমত্তা পদ্মার বুকে বাংলাদেশের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ২৫ জুন, ২০২২। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সড়কপথে যুক্ত হলো রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বাদবাকি অংশের সঙ্গে। এ দিন আনুষ্ঠানিকভাবে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের যোগাযোগের ইতিহাসে রচিত হয় একটি বড় মাইলফলক। গোটা বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আসে অবিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে। ২৬ জুন পদ্মা সেতু দিয়ে শুরু হয়েছে যান চলাচল।

স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ সেতু শুধু একটি সেতু নয়, শুধু ইট-সিমেন্ট-কংক্রিটের কাঠামো নয়, এ সেতু আমাদের অহংকার আমাদের গর্ব; সক্ষমতার, মর্যাদার প্রতীক। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণে পাশে থাকার জন্য দেশের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান বাংলাদেশের সরকার প্রধান। গৌরবের এ দিনটির সাক্ষী হতে লাখ লাখ মানুষ জড়ো হন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতাকে ঘিরে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য যথার্থ- পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতু নয়, শুধু ইট-সিমেন্ট-কংক্রিটের স্থাপনা নয়- নানা কারণে এটি বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-অনুভূতির, সুখ-দুঃখ এবং জীবন-জীবিকার সঙ্গে জড়িত।

প্রমত্তা পদ্মা দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলকে গোটা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল পূর্বাপর। এর ফলে অর্থনৈতিকভাবে যতটা অগ্রগতি হবার কথা সেটি হয়নি ওই অঞ্চলে। পদ্মা পাড়ি দিতে ফেরি পারাপারে দীর্ঘ সময় এবং ভোগান্তি ছিল এর মূল কারণ। শুধু তো ভোগান্তি নয়, পদ্মায় ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় থেকে অনেক রোগীর মৃত্যুর করুণ কাহিনীও আমাদের জানা।

এ সব বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এক পর্যায়ে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে গেলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ণ হয়। যদিও পরবর্তীতে কানাডার আদালতে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

পদ্মা সেতু আদৌ নির্মিত হবে কি-না এমন প্রশ্ন যখন সবার মনে তখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসী সিদ্ধান্ত নেন- নিজেদের অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে বাংলাদেশ। তখন দেশেরই অনেক বিজ্ঞজন এতবড় মেগা প্রকল্প নিজেদের অর্থায়নে করা সমর্থন করেননি। কিন্তু সকল বিরোধিতা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত জাতিকে উপহার দিয়েছেন বহুকাঙ্খিত পদ্মা সেতু।

পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্ত ও তার সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রশংসার জোয়ারে ভাসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঘোর সমালোচকেরাও তাঁর সাহস ও প্রজ্ঞার প্রশংসা করছেন আজ। বাস্তবিক পক্ষে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতার প্রমাণ রেখেছেন। এটি সন্দেহাতীতভাবে আমাদের জন্য গৌরবের ও মর্যাদার। এটি অর্থায়ন থেকে বিশ্ব ব্যাংকের সরে যাওয়ার অসম্মানের জবাবও বটে।

পদ্মা সেতুর মূল সেতু নির্মাণ, নদী শাসন ও রেল প্রকল্পে কাজ করছে চীনের তিনটি প্রতিষ্ঠান। তাই বাংলাদেশের প্রধান উন্নয়ন সহযোগী চীনও এ গৌরবের অংশীদার।

ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং পদ্মা সেতু উদ্বোধন প্রসঙ্গে বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ বাংলাদেশ এমন সেতু নির্মাণ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় ছিল। তারপরও বাংলাদেশের মানুষ তাঁদের স্বপ্ন অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আজ, সেতুটি শুধু বাস্তবায়নই হয়নি, বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে এর শতভাগ নির্মিত হয়েছে। সেতুটি তার কাছে সাহসের একটি প্রতীক।

ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাস এক বিবৃতিতে পদ্মা সেতুকে বাংলাদেশের নেতৃত্বের একটি বড় উদাহরণ হিসেবে অভিহিত করেছে। এমনকি যে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে গিয়েছিল তারাও আজ বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাচ্ছে পদ্মা সেতুর জন্য। উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে আগামী দিনগুলোতে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টের মার্সি টেম্বল। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও পদ্মা সেতুকে বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক বলে অভিহিত করছে।

প্রশংসা-নিন্দা ছাড়িয়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দুয়াল খুলে দেবে পদ্মা সেতু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন তার ভাষণে বলেছেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলেরে মানুষের অর্থনৈতিক ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেবে এ সেতু। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প-কারখানা হবে, লোকজনের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। এতে শুধু দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল নয় গোটা দেশেরই অর্থনীতিতে বড় সুফল আসবে।

বিভিন্ন গবেষণা বলছে, বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু যেমন দেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচনা করেছে, তেমনি পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি বয়ে আনবে।   আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কানেক্টিভিটি উন্নত হওয়ার কারণে প্রতিবছর দক্ষিণাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২.৫ শতাংশ এবং জাতীয় পর্যায়ে জিডিপি বাড়বে ১.২৬ শতাংশ হারে। রেললাইন চালু হলে জিডিপিতে আরও ১ শতাংশ যুক্ত হবে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তঃআঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটরযান চুক্তির বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই সেতুর ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, সেতুর দুই ধারে রেল সংযোগ, ট্রান্সএশিয়ান হাইওয়ে ও রেলসংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে পদ্মা সেতু।

মাহমুদ হাশিম

ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।