Web bengali.cri.cn   
সংস্কারের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের ভাবনা
  2014-01-20 18:30:29  cri


তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে দ্রুতগতির প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর চীনের অর্থনীতি কাঠামো, প্রবৃদ্ধির পদ্ধতি, শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নের ভারসাম্যহীনতাসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে এবং দিনে দিনে তা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সীমাবদ্ধ করেছে। সদ্যসমাপ্ত ২০১৩ সালে চীন সরকার সংস্কার জোরদার করার মাধ্যমে বাজারের প্রাণশক্তিকে উদ্দীপ্ত করেছে। চীনের অর্থনীতি আবার সুষ্ঠু ও টেকসই উন্নয়নের পথে প্রবেশ করেছে।

২০১৪ সালকে চীনের অর্থনীতিতে সার্বিক ও জোরালো সংস্কার সূচনার বছর বলা হচ্ছে। এ বছর চীনের অর্থনীতি কীভাবে বিকশিত হবে?

গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় অর্থনীতি বিষয়ক কর্মসম্মেলনে ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সারসংকলন করা হয় এবং ২০১৪ সালের অর্থনৈতিক কাজের মোট প্রয়োজন ও প্রধান কর্তব্য উত্থাপিত হয়।

চলতি বছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রসঙ্গে চীনের কেন্দ্রীয় অর্থ ও অর্থনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালক লিউ শু ওয়েই বলেন, "আমি মনে করি, চলতি বছর চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬.৫ থেকে ৭ শতাংশ। কারণ এখন চীনের জি.ডি.পি যথেষ্ঠ বড়। আগের মতো অতি দ্রুতগতির প্রবৃদ্ধি-হার বজায় রাখার জন্য তা উপযুক্ত হবে না।"

কৃষি খাতে চীনের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান -- নতুন ভরসা গ্রুপের বোর্ড চেয়ারম্যান লিউ ইয়োং হাও লিউ শু ওয়েইয়ের মতো চলতি বছরের জন্য একই রকমের প্রবৃদ্ধি-হার অনুমান করেছেন। তিনিও মনে করেন, এ বছর চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬ থেকে ৭ শতাংশ। তিনি বলেন, "এখন অনেক খাতে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি। তাছাড়া বিশ্ব অর্থনীতি এখনো সমন্বয়ের পর্যায়ে আছে। চীনের বিনিয়োগ, ভোগ ও রপ্তানি খাতে কিছু মাত্রার চাপ আবির্ভূত হয়েছে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে জি.ডি.পির ব্যাপক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। ফলে ৬ থেকে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি-হার বজায় রাখা সম্ভব হলে তা পৃথিবীর মধ্যে দ্রুত-গতির প্রবৃদ্ধি থাকবে।"

পঁয়ত্রিশ বছর আগের তুলনায় চীনের অর্থনীতির আকার ১৪২ গুণ বেড়েছে। শহরাঞ্চলের অধিবাসীদের আয় ৭১ গুণ বেড়েছে এবং কৃষকদের মাথাপিছু নিট আয় ৫৯ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিনিয়োগ ও রপ্তানির ওপর নির্ভর করে চীন বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক সত্তায় পরিণত হয়েছে। চীনা জনগণের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত হয়েছে।

তবে অতীতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পদ্ধতি বর্তমান চীনের জন্য নানা চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। বৈশ্বিক আর্থিক সংকট বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর প্রভাব ফেলেছে। চীনও এর ব্যতিক্রম নয়। বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের কারণে বিদেশের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় চীনের রপ্তানি-প্রবৃদ্ধি সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হয়েছে। এর পাশাপাশি চীনের অতিরিক্ত উত্পাদন সামর্থ্যের সমস্যাও আবির্ভূত হয়েছে। তাছাড়া ঘন ঘন দেখা দেওয়া কুয়াশা চীনের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার এক প্রধান উপাদানে পরিণত হয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পদ্ধতি পরিবর্তন করা এবং সার্বিক ও জোরালো সংস্কার করা এখন চীনের মতৈক্য।

সংস্কার মানে পুরোনো ব্যবস্থা ও জিনিস বদলানো, পুরোনো উত্পাদনের সম্পর্ক আর উপরি কাঠামো আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে সুবিন্যাস করা। বিগত ৩০ বছরেও বেশি সময়ে চীনের অর্থনীতির টেকসই ও দ্রুত বিকাশ হয়েছে। এর মূল কারণ ছিল সংস্কার। ভবিষ্যতেও চীনের অর্থনীতির টেকসই ও সুষ্ঠু উন্নয়ন বজায় রাখতে চাইলে সংস্কারের ওপর নির্ভর করতেই হবে।

চীনের জাতীয় গণকংগ্রেসের অর্থ ও অর্থনীতি কমিশনের সাবেক উপপ্রধান হো ছিয়াং বলেন, "আমরা আয়বন্টনে সংস্কার আনবো, যাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আয় বৃদ্ধি পায় এবং পরোক্ষভাবে চীনের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ে। তাছাড়া, আমরা শুল্কখাত সংস্কার করবো। বিশেষ করে, বিক্রয় করের পরিবর্তে মূল্য সংযোজন কর নেওয়া হবে। এটা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অনুকূল হবে।"

উল্লেখ্য, মূল্য সংযোজন কর আর বিক্রয় কর হচ্ছে চীনের দুটি প্রধান কর। আর্থিক খাতের ভাষ্যকার ইয়ে থান মনে করেন, বিক্রয় করের পরিবর্তে মূল্য সংযোজন কর নেওয়া চীনের অর্থনীতির রূপান্তরের জন্য সহায়ক হবে। তিনি বলেন, "জোরালোভাবে 'বিক্রয় করের পরিবর্তে মূল্য সংযোজন কর নেওয়া' এবং এ ব্যবস্থাকে চীনের কর আদায় খাত সংস্কারের প্রধান দিক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সেবা ও ভোগ খাতের উন্নয়ন। ভবিষ্যতে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি হচ্ছে ভোগ ও সেবামূলক খাতের সম্প্রসারণ। চীনের কিছু বৃহত্ আকারের শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক পরিসেবা এবং পণ্য স্থানান্তরের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য 'বিক্রয় করের পরিবর্তে মূল্য সংযোজন কর নেওয়া' হচ্ছে এক সুখবর।"

বৈদেশিক বাণিজ্য হচ্ছে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়ার গতানুগতিক চালিকাশক্তির অন্যতম। চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় ভবিষ্যতেও বৈদেশিক বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাবে।

২০১৩ সালের প্রথম নয় মাসে চীনের আমদানি ও রপ্তানির মোট পরিমাণ তার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে রপ্তানির পরিমাণ ১.৬১৪ ট্রিলিয়ন ডলার, যা তার আগের বছরের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি। আর আমদানির পরিমাণ ১.৪৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা তার আগের বছরের চেয়ে ৭.৩ শতাংশ বেশি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অনুমান, ২০১৩ সালে বৈশ্বিক বাণিজ্যের পরিমাণ ২.৫ থেকে ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সে তুলনায় চীন বৈদেশিক বাণিজ্যে যে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, তা সহজ ব্যাপার নয়।

এখন চীন অতীতের পণ্য রপ্তানির বৃহত্ দেশ থেকে পুঁজি রপ্তানির বড় দেশে রূপান্তরিত হচ্ছে। বাণিজ্যিক সুযোগ খুঁজতে দিন দিন আরো বেশি চীনা শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিদেশে যাচ্ছে এবং সক্রিয়ভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নিচ্ছে। ২০১২ সালে চীনের প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৮৭.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ১৭.৬ শতাংশ বেশি। চীন প্রথম বার বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক বিনিয়োগকারী দেশে পরিণত হয়েছে।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১৮তম জাতীয় গণকংগ্রেসের তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে 'বিদেশ থেকে আমদানি' এবং 'বিদেশে যাওয়া' – এ দুটি বিষয়কে আরো ভালোভাবে সমন্বিত করার কথা বলা হয়। এ থেকে প্রতিপন্ন হয় যে, চীন বিদেশে বিনিয়োগের পরিমাণ আরো বাড়াবে।

বৈদেশিক বিনিয়োগ নীতি সুসম্পন্ন করার জন্য চীন সরকার অর্থ, কর ও বিমাসহ নানা ক্ষেত্রের আনুষঙ্গিক নীতি সুসম্পন্ন করবে এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে চীনের মুদ্রা রেনমিনপিতে বিদেশে বিনিয়োগ করার সমর্থন যোগাবে। অনুমান করা হচ্ছে, আগামী পাঁচ বছরে বিদেশে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে এবং ওই সময় চীন ১০ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করবে।

রাশিয়ার বিজ্ঞান একাডেমির দূরপ্রাচ্য গবেষণালয়ের উপপ্রধান মনে করেন, "চীন বৈদেশিক বিনিয়োগ সম্প্রসারণের নীতি কার্যকর করলে তা কেবল চীনের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির জন্য অনুকূল হবে তা নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্যও চালিকাশক্তি সৃষ্টি হবে।"

২০১৪ সাল হচ্ছে চীনের ১৮তম জাতীয় গণকংগ্রসের তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের পর চীনের সার্বিক ও জোরালো সংস্কারের প্রথম বছর। এ বছরটি নিঃসন্দেহে অসাধারণ হবে। চীনের অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। (ইয়ু/এসআর)

মন্তব্য
লিঙ্ক