Web bengali.cri.cn   
২০১৩ সালে চীন-আফ্রিকার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং সহযোগিতা একবিংশ শতাব্দীর এক লক্ষণীয় উদাহরণ
  2014-01-13 18:49:00  cri


২০১৩ সাল বিশ্ব অর্থনীতির স্থায়ী নিম্ন প্রবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে চীন ও আফ্রিকার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক অব্যাহতভাবে তাদের উন্নয়নের ধারাকে বজায় রেখেছে। দু'পক্ষের মধ্যে আস্থা, বিশ্বাস ও সহযোগিতার ভিত্তি আরো মজবুত, প্রবল ও সুদৃঢ় হয়েছে।

২০১৩ সালে চীন ও আফ্রিকার উর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পারস্পরিক সফর খু্‌ব ঘন ঘন হয়। সি চিন পিং ২০১৩ সালের মার্চ মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট নিয়োগ হওয়ার পর প্রথম সফর বেছে নিয়েছিলেন আফ্রিকা। তিনি তাঞ্জানিয়া সফরকালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, চীন অব্যাহতভাবে আফ্রিকার উন্নয়নে সাহায্য করবে।

সি চিন পিং বলেন, "চীন আফ্রিকান দেশগুলোর সঙ্গে কৃষি ও নির্মাণ শিল্পসহ নানা ক্ষেত্রের পারস্পরিক উপকারিতামূলক সহযোগিতা জোরদার করবে, আফ্রিকান দেশগুলোর সম্পদের উন্নয়নে সাহায্য করবে, আফ্রিকার স্বতন্ত্র উন্নয়ন আর টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নে সাহায্য করবে।"

তাছাড়া চীনের জাতীয় গণ কংগ্রেসের চেয়ারম্যান চাং দে চিয়াং, উপপ্রধানমন্ত্রী লিউ ইয়ান তুং ও ওয়াং ইয়াং প্রমুখ চীনের জাতীয় নেতাবৃন্দ পর পর আফ্রিকা সফর করেন। নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট গুডলাক জোনাথেন, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনয়াত্তা, জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট ম্যাকেল সাতা, ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী হাইলেমারিয়াম দেসালেগ প্রমুখ আফ্রিকান দেশগুলোর নেতারা যথাক্রমে চীন সফর করেন। পারস্পরিক সফরের মাধ্যমে চীন ও আফ্রিকার ঐতিহ্যিক মৈত্রী আরো সুসংহত হয়, রাজনৈতিকভাবে পারস্পরিক আস্থা আরো জোরদার হয়, চীন ও আফ্রিকার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার টেকসই উন্নয়নের জন্য ভিত্তি স্থাপন হয়।

চীন ও আফ্রিকার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা বলতে গেলে 'চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা ফোরাম' না বললে হবে না। এ ফোরাম হচ্ছে বর্তমানে চীন ও আফ্রিকার মধ্যকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বহুপক্ষীয় সহযোগিতা ব্যবস্থা। ২০১২ সালের জুলাই মাসে চীন ও আফ্রিকার সহযোগিতা ফোরামের পঞ্চম মন্ত্রী পর্যায়ের অধিবেশন পেইচিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে চীন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে চীন ও আফ্রিকার তিনটি সহযোগিতা ব্যবস্থা উত্থাপন করেন, এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বিনিয়োগ ও অর্থ সংগ্রহ ক্ষেত্রের সহযোগিতা সম্প্রসারণ করা, আফ্রিকার উন্নয়ন সংক্রান্ত সাহায্যদান বাড়ানো এবং আফ্রিকার একত্রীকরণ নির্মাণকাজ সমর্থন করা।

চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকা বিভাগের সমন্বয় অফিসের উপপ্রধান চেন হাও জানান, এ তিনটি ব্যবস্থা ২০১৩ সালে সবই স্থিতিশীলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। তিনি বলেন, "বিনিয়োগ ও অর্থ সংগ্রহ ক্ষেত্রের সহযোগিতা সম্প্রসারণ খাতে চীন ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা সবই সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। স্বাক্ষরিত ঋণদান চুক্তি মূলত: অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষি, নির্মাণ শিল্প আর মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন খাতের প্রকল্পগুলো। আফ্রিকার উন্নয়ন সাহায্যদান ক্ষেত্রে ২০১৩ সালে চীনের দেয়া আফ্রিকার সাহায্যদান কৃষি দৃষ্টান্ত কেন্দ্র, 'আলোক অভিযান' কর্মসূচি, 'আফ্রিকার প্রতিভা পরিকল্পনা' সহ নানা প্রকল্প সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার একত্রীকরণ নির্মাণ খাতে চীন ও আফ্রিকা নিবিঢ় সহযোগিতা করে আফ্রিকার বহুজাতিক ও আন্তঃআঞ্চলিক অবকাঠামো নির্মাণ আর আফ্রিকার বাণিজ্যিক সহজায়ন ক্ষেত্রে অনুকূল ও গভীর আলোচনা হয়েছে।"

বাণিজ্য হচ্ছে চীন ও আফ্রিকার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। ২০১৩ সালে চীন সফররত বহু আফ্রিকান দেশের নেতৃবৃন্দ চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দেন।

নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট গুডলাক জোনাথেন ২০১৩ সালের জুলাই মাসে চীন সফরকালে বলেন, "সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দু'দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রের সহযোগিতা নিরন্তরভাবে জোরদার হয়েছে। এখন দু'পক্ষের বার্ষিক বাণিজ্যিক পরিমাণ ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। চীন হচ্ছে নাইজেরিয়ার বর্তমান প্রথম বাণিজ্যিক অংশীদার।"

আগস্ট মাসে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনয়াত্তা ১০০ জন নিয়ে গঠিত এক বড় প্রতিনিধি দল নিয়ে চীন সফর করেন। এ প্রতিনিধি দলের মধ্যে রয়েছেন কেনিয়ার পররাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীসহ প্রায় দশ জন মন্ত্রী, সে দেশের বিনিয়োগ ব্যুরোসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আর অর্থ ও শিল্প খাতের বহু নামকরা প্রতিনিধি। সফরকালে কেনয়াত্তা বলেন, "আমার এবারের চীন সফরের উদ্দেশ্য হচ্ছে কেনিয়া ও চীনের জনগণের মধ্যকার ঐতিহ্যবাহী অংশীদারিত্বের সম্পর্ক গভীরতর করা। এ সফর কেবল চীন ও কেনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং চীন ও আফ্রিকার সঙ্গেও সম্পর্কিত। আমার এ সফর ঠিক চীন ও কেনিয়ার সম্পর্কোন্নয়ন, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা ঘনিষ্ঠ হওয়ার সন্ধিক্ষণে হয়েছে। সুতরাং এ সুযোগে আমরা একসাথে আন্তরিকভাবে পারস্পরিক উপকারিতা ও উভয়ের জয়লাভের সহযোগিতার সুযোগ খুঁজবো। তাহলে আমাদের দেশ, সরকার, শিল্পপ্রতিষ্ঠান আর জনসাধারণ আরো ভালোভাবে টেকসই ও দ্রুত উন্নয়ন অন্বেষণের প্রয়াসে অংশ নিতে পারবে।"

এখন চীন হচ্ছে কেনিয়ার প্রথম বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের উত্স স্থান আর দ্বিতীয় বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০১২ সালে চীন ও কেনিয়ার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক পরিমাণ ২৮০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। চীন ও নাইজেরিয়া, চীন ও কেনিয়ার বাণিজ্যিক পরিমাণ বৃদ্ধি হচ্ছে চীন ও আফ্রিকার বাণিজ্যিক লেনদেনের একটি ক্ষুদ্র চিত্র।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকা বিভাগের সম্বন্বয় বিষয়ক অফিসের উপপ্রধান চেন হাও জানান, ২০১৩ সালের জানুয়ারী থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চীন ও আফ্রিকার বাণিজ্যিক পরিমাণ ১৭২.৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, এর আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫.৫ শতাংশ বেশি। এর পাশাপাশি, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের কাঠামো ধাপে ধাপে সুবিন্যস্ত হয়েছে। আফ্রিকায় চীনের রপ্তানীকৃত পণ্যগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধেক হচ্ছে প্রযুক্তির মান আর সংযোজিত মূল্য অপেক্ষাকৃত উচ্চতর যন্ত্রপাতি ও বৈদ্যুতিক সামগ্রী এবং উচ্চ ও নতুন প্রযুক্তিগত পণ্য। আফ্রিকার ইস্পাতজাত দ্রব্যও চীনের বাজারে প্রবেশ করেছে। ইথিওপিয়া, বেনিন আর বুরুন্ডি সহ চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত আফ্রিকার স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ৯৫ শতাংশ আমদানিকৃত পণ্যের ওপর চীন শূন্যশুল্ক সুবিধা দিয়েছে। এটা বলিষ্ঠভাবে আফ্রিকার পণ্য চীনে রপ্তানি করার পথ সুগম করেছে।

বাণিজ্য ছাড়া বিনিয়োগও চীন ও আফ্রিকার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের অভ্যন্তরীণ শিল্প কাঠামোর সুবিন্যাস আর আফ্রিকার শিল্পায়ন ও নগরায়ন প্রক্রিয়ার দ্রুত হওয়ার সাথে সাথে অধিক থেকে অধিকতর চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান আফ্রিকায় গিয়ে বিনিয়োগ করে এবং কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। চেন হাও বলেন, ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আফ্রিকায় চীনের অ-আর্থিক খাতের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমাণ ২৫৪ কোটি মার্কিন ডলার, এর আগর বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭১.৬ শতাংশ বেশি।

চেন হাও বলেন, "এখন চীন আফ্রিকায় মোট ২০০০টি বিভিন্ন ধরণের বিনিয়োগ বিষয়ক শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছে। তা কৃষি, অবকাঠামো, প্রক্রিয়াকরণ ও নির্মাণ, সম্পদ উন্নয়ন, অর্থ, বাণিজ্য, রিয়্যাল এস্টেট সহ নানা ক্ষেত্রে জড়িত। চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয়ভাবে স্থানীয়করণ উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা মোট ৮০ হাজার স্থানীয় কর্মী নিযুক্ত করেছি। সরকারি পর্যায়ে আমরা চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আফ্রিকায় বিনিয়োগের উত্সাহ দেয়ার জন্য নানা ব্যবস্থা চালু করেছি। যেমন আমরা চীন-আফ্রিকা উন্নয়ন তহবিল, আফ্রিকার মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠান উন্নয়ন সংক্রান্ত বিশেষ ঋণদান প্রতিষ্ঠা করেছি। আফ্রিকায় চীন-আফ্রিকা অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ সব ব্যবস্থা চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আফ্রিকায় বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।"

আফ্রিকায় বিনিয়োগ সম্প্রসারণের পাশাপাশি চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয়ভাবে আফ্রিকার বিদ্যুত, জ্বালানি, পরিবহন আর জীবিকাসহ নানা ক্ষেত্রের অবকাঠামো নির্মাণকাজেও অংশ নিয়েছে এবং লক্ষণীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০১৩ সালের জুন মাসে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী হাইলেমারিয়াম দেসালেগন চীন সফরকালে বলেন, "এখন ইতিওপিয়া সহ অনেক আফ্রিকান দেশ চীনের আর্থিক সমর্থন আর চীনের প্রকল্প কোম্পানির সাহায্যে সম্পূর্ণ নতুন রূপে পরিণত হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে আফ্রিকান দেশগুলোর বাণিজ্য অগ্রসর করবে এবং বাহির ও অভ্যন্তরে আরো বড় একত্রীকরণ বাজার গড়ে তোলার সহায়তা করবে।"

আসলে পারস্পরিক উপকারিতা ও উভয় পক্ষের জয়লাভের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত চীন ও আফ্রিকার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা কেবল আফ্রিকার গণ জীবিকা আর অর্থনৈতিক বহুবিধ উন্নয়ন ঘটিয়েছে তা নয়, বরং চীনের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্যও বলিষ্ঠ সমর্থন যুগিয়েছে। আফ্রিকা চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশী ঠিকাদারি প্রকল্পের দ্বিতীয় বাজারে পরিণত হয়েছে।

চেন হাও জানিয়েছেন, ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো আফ্রিকায় মোট ৪৭.০১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ঠিকাদারি প্রকল্প স্বাক্ষর করেছে, এটা এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন ও আফ্রিকার সম্পর্কের নিরন্তর উন্নয়নের সাথে সাথে দু'পক্ষের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা আর বিনিময় আরো গভীর ও সম্প্রসারিত হবে। (ইয়ু)

মন্তব্য
লিঙ্ক