|
আলিম: হ্যা সুবর্ণা, আমি চীনের বসন্ত উত্সব সম্পর্কে শুনেছি এবং বাংলাদেশে বসে টেলিভিশনে বসন্ত উত্সবে সচিত্র প্রতিবেদনও দেখেছি। তবে, নিজের চোখে দেখলাম এই প্রথম। আমারতো ভীষণ ভালো লেগেছে। আসলে, উত্সবমুখর মানুষের মুখ হচ্ছে পৃথিবীর সবচে সুন্দর দৃশ্য; তা সে যে ধর্ম বা গোত্রেরই হোক না কেন। চীনাদের চোখে-মুখে আমি যে আনন্দের আভা দেখেছি, তা আমার কাছে অপরিচিত নয়। বাংলাদেশের মানুষ যখন পহেলা বৈখাশের দিন বা ঈদের দিনে আনন্দ-উত্সবে মেতে ওঠে, তখন তাদের চোখে-মুখেও ফুটে ওঠে ওই একই রকমের আনন্দআভা। এ এক চমত্কার দৃশ্য; স্রষ্টার এক আশ্চর্য সৃষ্টি। আর হ্যা, বসন্ত উত্সব সম্পর্কে আমি আগে থেকেই জানি। মুসলমানদের ঈদ-উল-ফিতর বা খ্রীষ্টানদের 'বড়দিনের' মতো বসন্ত উত্সব হচ্ছে চীনাদের সবচেয়ে বড় বাত্সরিক উত্সব। চীনের ঐতিহ্যবাহী রীতি অনুসারে, বসন্ত উত্সব চীনের চান্দ্রবর্ষের শেষ মাসের ২৩তম দিন থেকে শুরু করে নতুন বছরের প্রথম মাসের ১৫তম দিন অর্থাত্ লন্ঠন উত্সব পর্যন্ত স্থায়ী হয়। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চলে এ-উত্সব। তবে, এক্ষেত্রে পুরনো বছরের শেষ দিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন---এই দুই দিন হচ্ছে সবচে গুরুত্বপূর্ণ।
সুবর্ণা: আপনি ঠিকই বলেছেন, আলিম ভাই। তবে, কালের আবর্তে পড়ে, বসন্ত উত্সবের রীতিনীতিতে কিছু পরিবর্তন এসেছে; উত্সব পালনের কায়দা-কানুনেও এসেছে পরিবর্তন। যেটি পরিবর্তন হয়নি, তা হচ্ছে চীনা নাগরিকদের জীবনে বসন্ত উত্সবের গুরুত্ব এবং আবেদন। সাধারণত উত্সবের তৃতীয় দিন থেকে মন্দির মেলা শুরু হয়; লোকজন আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে মন্দির মেলায় গিয়ে বিভিন্ন বিনোদনপ্রকল্প উপভোগ করে এবং কেনাকাটা করে। আমি সেই ছোটবেলা থেকেই মন্দির মেলায় যাই। সে এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। তবে, বর্তমানে পেইচিং-য়ে লোকসংখ্যা বেড়েছে, মন্দির মেলায় প্রচণ্ড ভীড় হয়। ভীড়ের কারণে প্রতিবছর মেলায় যাওয়া হয় না।
আলিম: চীনের বসন্ত উত্সবের মন্দির মেলা সম্পর্কে আমরা আপনার কাছ থেকে আরো অনেক তথ্য শুনবো। তবে, তার আগে একটা গান শুনতে চাই। গানটিও কিন্তু ওই 'মন্দির মেলা' নিয়েই। গানের কথাগুলো বাংলা করলে মোটামুটি এমন দাঁড়াবে: মন্দির মেলায় ভীড় লেগেই থাকে/ চারিদিক সরগরম, সবাই আসে তা উপভোগ করতে/ ঢাক-ঢোল আর করতালের ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়/ এ-শব্দ শুনে মন খুশিতে উদ্বেলিত হয়...
সুবর্ণা: বসন্ত উত্সবের মূল অংশ হচ্ছে মন্দির মেলা। পেইচিংয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা ধরনের মন্দির মেলা দেখা যায়। মন্দির মেলার সাথে প্রাচীন চীনের মন্দির ও ধর্মীয় বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। প্রাচীনকালে চীনের তুংহান রাজবংশ আমলে চীনে বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তার লাভ করে। একই সময়কালে তাও ধর্মও জনগণকে প্রভাবিত করতে থাকে। দুটি ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যে যখন তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে, ঠিক তখনই থাং ও সোং রাজবংশ সবচে সমৃদ্ধ সময় পার করছিল। তখন মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নাচ, অপেরাসহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক কর্মসূচি যোগ করার প্রবণতা দেখা দেয়। বসন্ত উত্সবের মন্দির মেলাও আসলে এভাবেই এসেছে।
আলিম: কথিত আছে, প্রাচীনকালের পেইওয়ে রাজবংশ আমলে অর্থাত্ ৪৮৫ সালে চীনের রাজধানী হোনান প্রদেশে লুওইয়াং নামের একটি শহর ছিল। সেখানে বৌদ্ধ ধর্মের সন্ন্যাসীরা গৌতম বুদ্ধের মুর্তি নিয়ে সুন্দর রঙয়ের গাড়িতে করে শহর ও গ্রামে শোভাযাত্রা করতো। এ-ধরণের ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে 'শহর পরিক্রমা' বলে ডাকা হতো। তা ছাড়া, তারা মন্দিরে নিয়মিতভাবে বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করতেন এবং ধর্মশাস্ত্র পাঠ করে গৌতম বুদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন।
সুবর্ণা: ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর, মন্দির মেলা ব্যবসায়ীদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারা এ-ধরণের মেলা থেকে মুনাফা করার চিন্তা করেন এবং অধিকহারে মেলার আয়োজন এবং মেলায় নানাবিধ বিনোদনের ব্যবস্থার প্রচলন ঘটান। প্রাচীনকালে মন্দির মেলার আরেকটি নাম ছিল 'মন্দির বাজার'; সেটি ছিল চীনের বাজার সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চীনের বিভিন্ন অঞ্চলের মন্দির মেলায় সেসব অঞ্চলের সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষণীয়। যেমন, পেইচিংয়ের মন্দির মেলায় 'কাগজের মাছ' ও 'কাগজের চক্র' থাকতেই হবে।
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |