‘ Days and Nights in Wuhan’ শীর্ষক মহামারী প্রতিরোধবিষয়ক প্রথম প্রামাণ্য চলচ্চিত্র
2021-02-09 13:29:02

‘ Days and Nights in Wuhan’ শীর্ষক মহামারী প্রতিরোধবিষয়ক প্রথম প্রামাণ্য চলচ্চিত্র_fororder_wuhan

আজ চীনা পঞ্জিকা অনুযায়ী ২০২০ সালের শেষ দিন। চীনাদের রীতিনীতি অনুযায়ী, দূর-দূরান্তে অবস্থিত যে কোনো মানুষ, আজকের এই দিনে জন্মস্থানে ফিরে আসেন ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হন। তবে বন্ধুরা, এ বছরটি অন্যান্য বছরের চেয়ে বিশেষভাবে আলাদা। গোটা চীনে নভেল করোনাভাইরাস মহামারী মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও কিছু কিছু জায়গায় মহামারীর প্রভাব বজায় রয়েছে। তাই, এ বছর বিভিন্ন প্রদেশ ও শহর কর্তৃপক্ষ ‘সেলিব্রেট ইন প্লেস’ বা ‘জন্মস্থানে ফিরে না-গিয়েও বসন্ত উৎসব উদযাপন’ করার পরামর্শ দিয়েছে। এ অবস্থায় এবারের বসন্ত উৎসবের ছুটিতে সিনেমা হলে বা বাসায় বসে ছবি উপভোগ করা— খুব ভালো একটি পদ্ধতি হয়ে উঠেছে।

 

গত বছরের বসন্ত উৎসবের আগে উহান শহরে মহামারীর প্রাদুর্ভাব চীনাদের জীবনকে বিশৃঙ্খল করে দিয়েছিলো। বছরব্যাপী পরিশ্রমের পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসছে। আজ সব চীনা মানুষের পুনর্মিলনের এই দিনে আমরা একসঙ্গে উহানের মহামারী প্রতিরোধবিষয়ক একটি তথ্যচিত্রের ওপর নজর দেবো। এই তথ্যচিত্রটির নাম হলো ‘ Days and Nights in Wuhan’।

 

গত বছর বসন্ত উৎসবের আগ্‌ দিয়ে চীনের উহান শহরে মহামারীর প্রকোপ দেখা দেয়। চীনা চান্দ্র পঞ্জিকার ২০২০ সালের শেষ দিনটির প্রাক্কালে উহান শহরটিকে গোটা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। সে সময় ওই শহর থেকে বের হওয়ার বা শহরটিতে প্রবেশের সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর দীর্ঘ ৭৬ দিন লকডাউনে অবরুদ্ধ ছিল বিশাল উহান শহর। উহানের ৭৬টি দিন ও রাত, তথা চীনের ৭৬টি দিন ও রাত, অসংখ্য মানুষ উহানের মহামারীর ওপর নজর দেন। চীনের মহামারী পরিস্থিতি নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। সে সময়ের কথা আমরা কোনোদিন ভুলব না।

 

২০২০ সালের শুরুতে নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সম্মুখ সারি ও প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে উহান গোটা চীন তথা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কষ্টার্জিত এ বিজয়ের জন্য উহানবাসী ও সেখানে সাহায্য করতে ছুটে যাওয়া চীনের বিভিন্ন জায়গার স্বাস্থ্যকর্মীরা বিশাল ত্যাগ স্বীকার করেন এবং অবদান রাখেন। বিভিন্নভাবে মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের পরিশ্রম একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। মহামারী প্রতিরোধবিষয়ক ‘ Days and Nights in Wuhan’ নামে চীনের প্রথম তথ্যচিত্র এটি।

 

চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশনের চলচ্চিত্র চ্যানেলের উদ্যোগে নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘ Days and Nights in Wuhan’ গত ২২ জানুয়ারি মুক্তি পায়। এতে মহামারী প্রতিরোধের ফ্রন্ট লাইনে কাজ করা স্বাস্থ্যকর্মী, কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত রোগী ও স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর ফোকাস করা হয়। উহানে মহামারী প্রাদুর্ভাবের সময় স্বাস্থ্যকর্মী ও সাধারণ মানুষ দিন-রাত অন্যদের সাহায্য করেছিল। এসব সত্য ও মনোমুগ্ধকর গল্প প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। মহামারী মোকাবিলায় জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনযাত্রা এতে বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে।

 

‘ভালোবাসা ও জীবন-মৃত্যু’ হলো চলচ্চিত্রের চিরন্তন বিষয়। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বরা অনেক ক্ল্যাসিকাল শিল্পকর্ম সৃষ্টি করে থাকেন।

‘Days and Nights in Wuhan’ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে এই থিমটিকে কেন্দ্র করে সহজ শুটিংয়ের মাধ্যমে খুঁটিনাটি নানা বিষয় তুলে ধরা হয় এবং উষ্ণ ও মনোমুগ্ধকর সংগীতের মাধ্যমে দর্শকদের হৃদয়ে প্রকৃত অনুভূতি সৃষ্টি করা হয়। এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে ‘ভালোবাসা ও জীবন-মৃত্যু’ সম্পর্কে প্রতিটি মানুষের অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে।

 

‘ Days and Nights in Wuhan’ প্রামাণ্যচিত্রের প্রথমেই শোনা যায়, শিশু কণ্ঠে কবিতা পড়ার আওয়াজ। একটি শিশুর কণ্ঠ রেকর্ডারে বাজছে। হাসপাতালের আইসিইউ বা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে থাকা বৃদ্ধ দাদা তার নাতির কবিতা পড়া শুনছেন। শুধু তাই নয়, রেকর্ডারের কথায় নিজের জীবন ও মনের ইচ্ছার কথাগুলো দাদাকে জানাচ্ছে শিশুটি। এই রেকর্ডার হলো তার ‘অডিও ডায়রি’। তার কয়েকটি রেকর্ডিং গোটা প্রামাণ্যচিত্র-জুড়ে রয়েছে এবং এর মাধ্যমে ভালোবাসা ও আশার স্বপ্ন বিস্তৃত হয়েছে।

 

প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে দেখা যায়- স্বাস্থ্যকর্মীরা নিকট আত্মীয়ের মতো প্রতিটি রোগীর দেখভাল করছেন। লি ছাও নামে একজন রোগীর আশাব্যঞ্জক দৃষ্টিভঙ্গি ও হাস্য-রসিকতা, সাধারণ স্বেচ্ছাসেবকের গল্প-সহ বিভিন্ন দৃশ্য-বিন্যাস ভালোবাসার উষ্ণতা প্রকাশ পেয়েছে।

 

এই প্রামাণ্যচিত্রে দুটি মৃত্যুর ঘটনা রয়েছে। যা দেখে দর্শকেরা নিজেদের কান্না ধরে রাখতে পারেনা না। প্রথমে আমরা দেখি যে, সু চিয়ে নাম একজন হেড নার্স  হাউমাউ করে লাশবাহী গাড়ির পিছনে ছুটছেন। তিনি তার বাবাকে একবার শেষ দেখা দেখতে চান।
দ্বিতীয় এক দৃশ্যে দেখা যায়, নার্স প্রতিরোধক বেড়ার এক পাশ থেকে অন্যদিকে দাঁড়ানো নিহত রোগীর আত্মীয়স্বজনকে মৃতদেহ রিলিজ-সংক্রান্ত কাগজপত্র দিচ্ছেন। তাদের কথোপকথন খুব সহজ। কিন্তু, তা শুনে মানুষের হৃদয় ও চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে।

 

বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এ দু’টি জায়গা ঠিক কী কারণে দর্শকদের মনে গভীর দুঃখের অনুভূতি তৈরি করে! কারণ, এতে মহামারীর সময় উহান শহরের অধিবাসীদের ওপর আঘাত ও কষ্টের বাস্তব চিত্র উদঘাটিত হয়েছে। প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে দেখানো মৃত্যুগুলো ছিল জীবনের খুব কাছাকাছি ঘটনা। কষ্ট মনে চাপা দিয়ে রেখে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টা করলে সবাই সুখে থাকতে পারবে- এমন বাস্তবতা এই চলচ্চিত্রে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

 

‘ Days and Nights in Wuhan’ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে জীবনের ওপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। রোগীদের সুস্থ হওয়া, হাসপাতালে নবজাতকের জন্মগ্রহণ— এসব বিষয় প্রাণবন্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে। মহামারীর সময় যেসব শিশু উহানের হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেছিল, তাদেরকে আরো বেশি যত্ন নেওয়া হয়। মহামারীর ধারাবাহিক মৃত্যুর সময় শিশুদের জন্মগ্রহণ ও তাদের যত্ন নেওয়া— এই প্রামাণ্যচিত্রে বিশেষ অর্থ যোগ করেছে।

 

প্রামাণ্যচিত্রের শেষে দেখা যায়, পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে বসে খাবার খাচ্ছে। তাদের পিছনের টেবিলে মৃত আত্মীয়স্বজনের ছবি রাখা হয়েছে। এক-একটি পরিবারে ভাইরাসের ভয়াবহ ছোবলে প্রাণহানির চিত্র এর মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। যারা বেঁচে থাকার সৌভাগ্য পেয়েছেন, তারা অবশ্যই তাদের জীবন সামনের দিকে এগিয়ে নেবেন। এটাই চীনাদের অপরাজেয় চরিত্র ও অদম্য জীবনীশক্তির বৈশিষ্ট্য।

উল্লেখ্য, ‘ Days and Nights in Wuhan’ প্রামাণ্যচিত্রে উহানের মহামারী প্রতিরোধ-কাজের পাশাপাশি ধারণ করা হয়েছিল। প্রামাণ্যচিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত শুটিং গ্রুপের সদস্যরা মহামারী প্রতিরোধের প্রথম সময় ক্যামেরা নিয়ে রাস্তায় বা হাসপাতালে ছুটোছুটি করেছেন, তারা অ্যাম্বুলেন্সের পাশে বা আইসিইউতে চিত্রগ্রহণ করেছেন, তারা স্বাস্থ্যকর্মী বা রোগীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। দ্রুততার সঙ্গে রোগীদের উদ্ধার করা, দারুণ উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করা, ইচ্ছা না থাকলেও প্রিয়জনের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া, নতুন প্রজন্মের জন্মগ্রহণ করা— এসব নানা বিষয় ক্যামেরার মাধ্যমে ধারণ করা হয়েছে।

 

এরকম অনেকগুলো ‘প্রথম বিষয়’ তুলে ধরা হয়েছে এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে। এর মাধ্যমে প্রামাণ্যচিত্রটিতে অনেক মূল্যবান উপাদান ও বাস্তব চিত্র যুক্ত হয়েছে।

এতে তুলে ধরা সত্য বিষয়গুলো অন্যান্য ফিচার ফিল্মে দেখা যায় না। প্রামাণ্যচিত্রের চরিত্রগুলোর মুখে সেসব বিচিত্র ও প্রাণবন্ত বাস্তব অভিব্যক্তি অন্য কোনো শ্রেষ্ঠ অভিনেতা অভিনেত্রী হয়তো অভিনয়ের মাধ্যমে কখনও তুলে ধরতে পারবেন না।

 

উহানের অবিস্মরণীয় দিন ও রাত শেষ হলেও তথ্যচিত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন ঘটনা আমাদের স্মৃতিকে নাড়া দিয়ে যায়। দর্শকেরা বারবার দেখতে পান যে, প্রতিবন্ধকতার সামনেও সাধারণ মানুষের বীরত্ব আমাদের বিপুল উৎসাহ যোগায়।

 

(লিলি/তৌহিদ/শুয়ে)