এক দেশে ছিল এক রাজা। রাজার ভীষণ অসুখ। দীর্ঘ দিন থেকেই সে আর রাজ্য শাসন করে পারছে না। রাজ্যের যত ডাক্তার, হেকিম কবিরাজ আছে সবাই দলে দলে আসে আর দলে দলে ফিরে যায়- কিন্তু কেউই বলতে পারে না যে রাজার আসলে কি অসুখ হয়েছে আর কেনই বা তার রোগ ভাল হচ্ছে না। যে যত পারে ওষুধ দিচ্ছে রাজাও সে সব ওষুধ বেশ আগ্রহ ভরে গো-গ্রাসে খেয়ে নিচ্ছে কিন্তু তবুও তাঁর অসুখ ভাল হচ্ছে না কিছুতেই। ওষুধের পালা শেষ হলে এবার শুরু হয় হেকিম কবিরাজের পালা। গাছ-গাছড়া, শিকড়-বাকড়, পোকা-মাকড় যা আছে সবকিছু হয় গুড়ো করে, না হয় ভর্তা করে অথবা জ্বাল দিয়ে তেল করে খাওয়ানো হল। আবার আর একদল এসে রাজার মাথায় পানি-পট্টি, পেটে গরম সেঁক, পিঠে গরম তৈল-মর্দন করলো। তাতেও কাজ হয় না। এবারে শুরু হলো এক অদ্ভুদ চিকিত্সা- রাজার মাথা নিচে পা উপর করে খুঁটির সাথে ঝুলিয়ে রেখে নিমপাতা দিয়ে সারা শরীর ঝাড়া হলো। কিন্তু হায় সব চেষ্টা ব্যর্থ হল। অসুস্থ রাজা আর ভাল হয় কিছুতেই। এতে রাজা ভীষণ ক্ষেপে গেলো। তিনি তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে ডেকে বললেন-
রাজা: মন্ত্রী, মন্ত্রী? যাও আমার রাজ্যে যত ডাক্তার, হেকিম, কবিরাজ আছে সবাইকে একত্রিত কর।
মন্ত্রী: জী আজ্ঞে হুজুর তাই করছি, কিন্তু হুজুর সবাইকে এক সাথে করে কি করতে হবে তা তো বলেন নাই হুজুর।
রাজা: হ্যাঁ বলি নাই, কিন্তু এখন বলছি শোন, সবাইকে আগামীকাল সূর্যাস্তের মধ্যে এই রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে বলবে। কিন্তু তার আগে ওদের যতকিছু বই-পুস্তক আর ডাক্তারী-পুঁথিপত্র আছে সব কেড়ে নিয়ে জ্বালিয়ে দিবে ওদেরই সম্মুখে। আমার রাজ্যে আর কোনো ডাক্তার, হেকিম কবিরাজের দরকার নেই। যারা রাজার অসুখ ভাল করতে পারে না তাদের কাছে প্রজারা কি সেবা পাচ্ছে তা এখন হারে হারে বুঝতে পারছি। যাও যেমত বললাম, সেমত কাজ কর যাও।
মন্ত্রী: জী আজ্ঞে হুজুর, তাই আমি করছি এখুনি। কিন্তু হুজুর, সন্যাসীর মতো দেখতে এক লোক অনেকক্ষণ ধরে আপনার সাক্ষাতের অপেক্ষা করছে। সে আপনার অসুখের বিষয়ে কিছু বলতে চাইছে।
রাজা: এ্যা, সন্যাসী! হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল। ঠিক আছে যাও তাকে নিয়ে আসো দেখি সে কি বলে!
সন্যাসী: প্রণাম হুজুর।
রাজা: হ্যাঁ হ্যাঁ প্রণাম, প্রণাম, বেশ হয়েছে! এবার বাবা বেল েফল দেখি তুমি কোন মহাবিদ্যা নিয়ে এসেছো যাতে আমার অসুখ ভাল হয়ে যাবে?
সন্যাসী: আজ্ঞে মহারাজ, আমি অসুখ সারাবার একটি উপায় জানি, তবে এটি বেশ শক্ত আর কঠিন একটি উপায়। আপনারা কি সে কঠিন কাজটি করতে পারবেন?
রাজা: এ বেটা কি বলছে! আমার রাজ্যে অসম্ভব বলে কিছু নেই। নিশ্চিন্ত মনে বলে ফেলো কি করতে হবে।
সন্যাসী: হুজুর, যার মনে কোনো ভাবনা নেই, দুঃখ নেই, সব সময় আনন্দে থাকে, সব অবস্থায় সব সময়ে খুশি থাকে এমন একজন লোক খুজে আনতে হবে প্রথমে।
রাজা: তারপর, তারপর
সন্যাসী: তারপর ঐ লোকটির গায়ের একটি জামা পড়ে এবং ঐ লোকটির বিছানায় যদি আপনি একরাত্রি ঘুমাতে পারেন তাহলেই আপনার অসুখ ভাল হয়ে যাবে।
এই কথা শুনে রাজা ভাবল 'এ আর এমনকি। আমার রাজ্যে এমন কত মানুষইতো আছে যারা এরকম হাসিখুশী আর সব সময়ে আনন্দে থাকে। এত সহজ একটি উপায় থাকতে সবাই মিলে কত কি না করছিল। সব গর্ধবের দল আর কি'। এরপর রাজা তার মন্ত্রীকে ডেকে হুকুম দিল, যথাশিঘ্রই তার রাজ্য থেকে এমন একজন মানুষ খুঁজে বের করে তার গায়ের জামা আর তার বিছানা একদিনে জন্য হলেও যেন নিয়ে আসে। আর এর বিনিময়ে তাকে অনেক পুরস্কার দিতেও আদেশ প্রদান করা হয়।
রাজার আদেশ পেয়ে মন্ত্রী, উজীর, কোটাল, পেয়াদা যে যখানে আছে সবাই বের হয়ে গেল সন্যাসীর কথামতো এমন একজন মানুষ খুঁজতে। রাজ্য জুড়ে তো হই হই কান্ড পড়ে যায়। দিন নেই রাত নেই সবার যেন একটাই লক্ষ্য ভাবনা চিন্তাহীন একজন হাসিখুশী মানুষ খুঁজে বের করা। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না এমন মানুষ। তাই দেখে রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মহাক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন আর বললেন-'সবাই আস্ত অপদার্থ অকর্মণ্যের দল, আমি নিজেই এবার বের হবো আর ঠিক ঠিক এমন একজন অজানা মানুষ খুঁজে পাবই'। এই বলে মন্ত্রী নিজেই বের হয়ে খুঁজতে থাকে ভাবনা চিন্তাহীন একজন হাসি খুশী মানুষ। পথে যেতে যেতে একদিন সকালে নদীর ধারে এক জটলা দেখতে পেল। সেখানে নানা বয়সের মানুষের জটলার ঠিক মাঝখানে বেশ সৌম্য আর শুভ্র রূপের অধিকারী একজন মানুষকে দেখতে পেলো। মানুষটি নানা রকম রম্য রসের কথায় উপস্থিত সবাইকে হাসি আর আনন্দে মাতহারা করে তুলছে। শুধু তাই নয় গরিব, দুঃখী মানুষ যাকেই মনে হচ্ছে তাকে ডেকে তার খোঁজ খবর করছে আর অবলিলায় পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে দিচ্ছে হাসিমুখে। লোকটির মুখে যেন হাসি লেগেই রয়েছে সর্বক্ষণ। দেখেই মনে হচ্ছে ভাবনা চিন্তা বলে লোকটির তেমন কিছুই নেই। আনন্দ হই হুল্লোড় করেই যেন তাঁর সময়কাটে। মন্ত্রী খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলো যে লোকটি প্রতিদিন একই সময়ে এখানে আসে আর আনন্দ হইহুল্লোর করে গরীব দুঃখীদের অর্থ আর পরামর্শ দিয়ে সাহয্য করে আসছে বহু বছর ধরে। এলাকার মানুষের জানামতে এই লোকটিকে কখনোই মনখারাপ করতে বা রেগে যেতে দেখেনি কেউ। মন্ত্রী ভাবলো এই লোকটিই হচ্ছে সন্ন্যাসীর কথামত খুঁজে পাওয়া সেই মানুষ যার কাছ থেকে গায়ের জামা আর শোবার বিছানা সংগ্রহ করতে পারে। এই ভেবে তিনি লোকটির নিকট থেকে জামা সংগ্রহ করতে গিয়ে জানতে পারলো এক মহাদুঃখের কাহিনী। ঝড়ে কবলিত হয়ে নৌকাডুবিতে তাঁর স্ত্রী আর একমাত্র সন্তানের মৃত্যুপর সে প্রতিদিন নদীর পাড়ে যায় আর জীবনের এই নিদারুণ শোক আর নিঃসঙ্গতাকে ভুলিয়ে দিতেই সর্বদা হাসিখুশী থাকার চেষ্টা করছে। মন্ত্রী ভাবলেন না এ মানুষ সেই মানুষ নয় যাকে সে খুঁজছে।
এরপর আবার পথে বের হলো। অতপর সে দেখা মিলল আরেক খোশমেজাজের এক লোকের সঙ্গে যে কিনা সারক্ষণ কৌতুক, ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ আর ঠাট্টাতামাশায় মশগুল থাকে। লোকজনও তার এই কাণ্ডকারখানায় খুশী। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানাগেল যে লোকটি দিনের বেলায় যেমন ভাল মানুষ, রাতের বেলায় মাতাল হয়ে চেচামেচিতে সকলের শান্তি হারাম করে দেয়। এখানেও ব্যর্থ হলো মন্ত্রী মহাশয়। এভাবে পথে ঘুরে ঘুরে এমন মানুষের সন্ধান না পেয়ে আশা হত হয়ে যেই মুহুর্তে প্রাসাদে ফিরে যাচ্ছিল ঠিক তখন হঠাত্ এক গাছতলায় একটা পাগলা গোছের বুড়ো লোকের দেখা পেলো। লোকটার মাথাভরা চুল, মুখভরা দাড়ি, সমস্ত শরীর যেন শুকিয়ে দড়ি হয়ে গেছে। তার কাছে গিয়ে মন্ত্রী বললো-
মন্ত্রী: তুমি এতো হাসছো কেনো?
লোক: হাসবো না? পৃথিবী বনবন করে ঘুরছে, গাছের পাতা সরে সরে যাচ্ছে, মাঠে মাঠে ঘাস গজাচ্ছে, রোদ উঠছে আর বৃষ্টি পড়ছে এসব চোখের সামনে ঘটছেতো তাই দেখে হাসি পাচ্ছে।
মন্ত্রী: তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু শুধু বসে বসে হাসলে তো আর মানুষের দিন চলবে না। তোমার আর কোনো কাজ কর্ম নেই না কি?
লোক: তা কেন থাকবে না? এই যেমন ধরুন সকাল বেলা নদীর ঘাটে যাই, স্নান-টান সেরে সেখানে লোকজনের আসা যাওয়া, কথাবার্তা শুনে বেশ একটা বেলা কেটে যায়, তারপর আবার গাছতলা ফিরে আসি। যেদিন খাবার জোটে সেদিন খাই, না জোটেতো না খেয়েই ঘুমিয়েপড়ি। বেড়াতে ইচ্ছে হলে বেড়াতে যাই না হলে গাছতলায় বসেই চারপাশের কান্ডকারখানা দেখে হাসতে হাসতেই সময় পার করে দেই। বেশিকিছু ভাবনা-চিন্তা করতে হয়না কখনো, ভারি মজার না?
মন্ত্রী: আচ্ছা যেদিন খাওয়া পাওনা সেদিন কি কর?
লোক: সেদিন তো মনে করেন যে আর কোনোই সমস্যা থাকলো না। চুপচাপ মরার মত পড়ে থেকে তামাশা দেখি। বরং যেদিন খাওয়া হয় সেদিনই যত হাঙ্গামা আর ঝামেলা তৈরী হয়। এই যেমন ধরুন, ভাত মাখরে, হাঁ করোরে, মুখে খাবার ঢোকাওরে, চিবাওরে, গেলোরে তারপর আবার পানি খাওরে, হাতমুখ ধোওরে মোছরে, কত রকম কাণ্ড দেখুন দেখি। একি ভাল লাগে?
মন্ত্রী: বাহ! বাহ! দারুন তো ভাই, কেমন একটা ভাবনা চিন্তাহীন সহজ সরল জীবন। ভাই আসলে আমি তোমাকে মানে আপনার মতো একজনকেই খুঁজছি। ভাই আপনার গায়ের এক-আধখানা জামা যা পারো আমাকে দিন, ভাই এজন্য যত টাকাপয়সা চান দিবো।
লোক: আমার আবার জামা! এক লোক আমার শীতে কষ্ট হচ্ছিল দেখে একটি শাল দিয়েছিল তাও-তো ছাই এই সেদিন এক ভিখেরিকে দিয়ে দিলাম। ওকে দেখে খুব মায়া হচ্ছিল কিনা তাই দিয়ে দিয়েছি।
মন্ত্রী: কি বলছেন! এতো মহা মুশকিলের কথা। একটি জামা পাওয়া যাবে না। আচ্ছা তাহলে আপনার বিছানাপত্র কি আছে তা আমাকে দিন। আর এরজন্য যত সহস্র অর্থকড়ি চান সব দিতে প্রস্তুত আছি আমি। আপনি কোনো ভাবেই কিন্তু না বলতে পারবেন না।
লোক: না বলবো কি! আরে গত চল্লিশ বছর ধরে বিছানা জিনিষটা কি তাইতো চোখে দেখলাম না, তার আবার তোশক আর গদি।
মন্ত্রী: কি বলছেন ভাই সাহেব! জামা গায়ে দেন না, লেপ-তোশক-বিছানাও সঙ্গে রাখেন না, আপনার অসুখ বিসুখ করেনা ছাই?
লোক: অসুখ বিসুখ আবার কি ছাই! ওসব আমি বিশ্বাস করিনা আর ওসব নিয়ে ভাবিও না। যার কেবল কথায় কথায় অসুখ অসুখ করে তাদেরই খালি অসুখ করে।
এই কথা বলে আজব ধরনের মানুষটি হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। মন্ত্রী হতাশ হয়ে প্রাসাদে ফিরে যায়। এদিকে রাজা সব মন্ত্রীদের ডেকে হাজির করে জিজ্ঞাসা করলো যে সন্ন্যাসী কথামত একটি জামা সংগ্রহ করে আনতে পেরেছে কিনা। একে একে সবাই যার যার বৃত্তান্ত বললো এবং সবশেষে প্রধানমন্ত্রীও বললো তার সাথে দেখা হওয়া অদ্ভুত ধরনের মানুষটির কথা। বললো যে, হুজুর, যাও বা একজনকে পেলাম তারতো জামা বিছানা পত্র কিছুই নেই। উল্টো শীতে কষ্ট হচ্ছে দেখে একজনের কাছ থেকে পাওয়া একটি শাল সে আবার আরেক ভিখেরিকে দিয়ে দেয়। একথা শুনে প্রাসাদ জুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। সবাই রাজার আশু রোগমুক্তি না হওয়া এবং মৃত্যুর চিন্তায় বিমর্ষ হয়ে পড়লো। একে অপরের মুখের দিকে তাকায়, দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর চিরদুঃখীর চোখ দিয়ে রাজার দিকে তাকায়। সবাই যেন রাজার মৃত্যুর আগেই মরণ শোক পালন করতে শুরু করে দিয়েছে।
রাজা কিন্তু এবার একটুখানি নড়ে চড়ে বসলো। সে ভাবলো- 'আমি থাকি রাজার হালে, ভালো ভালো জিনিষ খাই দাই কোনো কিছুর অভাব নাই, আমাকে তোয়াজ করার মানুষের অভাব নাই, তবুও আমার হলো অসুখ, আর বেটা ফকির চাল চুলো কিছু নাই গাছতলা পড়ে থাকে কি খায় আর কি না খায় তার কোনো ঠিক নাই, সে কিনা বলে অসুখ টসুখ ও সবের কোনো মানে নাই, যারা কেবল অসুখ অসুখ করে তাদেরই কোনো সুখ নাই। ফকির হয়ে এক নিমিষে অসুখ উড়িয়ে দিতে পারলো, আর আমি রাজা হয়ে পারবো না? পরদিন রাজা যেন এক অন্য মানুষ এক ভিন্ন রাজা হয়ে রাজ সভায় আসলো, আর সবাইকে বললো-"যা হতভাগা মুখগুলো আমার সামনে থেকে সরে যা, যে যার কাজ করগে যা, আর যেন কোনোদিন আমার সামনে, আসে-পাশে এসে ঘোরাঘুরি আর তোষামদি করতে না দেখি। আমার অসুখ সারানোর জন্য তোদের কারোই প্রয়োজন নেই। আজ থেকে আমি রাজ সভায় বসবো, রাজ্য শাসন করবো, থাকবো সুখে নিশ্চিন্ত মনে। কেউ যদি কোনো টু শব্দটি করিস তাহলে তার মাথা উড়িয়ে দেবো"। সেই থেকে সে দেশের রাজা একজন সুখী রাজা হয়ে উঠলো।
| ||||