Web bengali.cri.cn   
কনেহীন বিয়ে
  2013-03-04 17:43:55  cri

 অন্যদিনের মতো সেদিন দুপুরে শহরের একটি নামি রেঁস্তোরার প্রথম তলায় পরিবেশিত বিশেষ স্বাদের একটি খাবার খেতে ভোজন রসিকদের উপচে ভরা ভিড় লেগেছিল। তিলধরারও যেন কোনো জায়গা নেই তবু গো-গ্রাসে স্বাদের খাবারটি কোনো রকম গলদকরণ করতে সবাই ব্যস্ত।

এরকম একটি ব্যতিব্যস্ত জনাকীর্ণ পরিবেশে বেশ পরিপাটি আর জাঁকজমক পোশাকে গলায় সুন্দর নেকটাই পড়া এক সুদর্শন ছেলে রেঁস্তোরায় প্রবেশ করে এক কোণায় চুপকরে দাঁড়িয়ে থাকে। বেশ মনোযোগ সহকারে ভোজনরত সকল রসিকজনদের দেখছেন। কিছুক্ষণ পর হাতে একটি মাইক্রফোন নিয়ে বলা শুরু করলেন- "দয়া করে সবাই একটু চুপ করুন। আমি আপনাদের কিছু বলতে চাই"

খাবার সময়ে কারো কি ভাষণ, বক্তব্য শোনার আগ্রহ থাকে, তাও যদি হয় অপরিচিত কোনো লোক। যাহোক ছেলেটিকে আবারও একবার ঘোষণা করতে হলো যেন সবাই একটু সময়ের জন্য শান্ত থেকে তাঁর কথা শোনে। অবশেষে বেশ কিছুক্ষণ পর রেঁস্তোরা একটু শান্ত হয়ে এলো। খাবার খেতে থাকা মানুষগুলো খানিকটা বিরক্তি আর চোখে বড় বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে তাকিয়ে আছে ঐ ছেলেটির দিকে। সবার একটাই জিজ্ঞাসা যে, এ ছেলে কি করতে চায়, আর কেনোই বা সে তাদের চুপ থাকতে বলছে?

ছেলেটি এবারে মাইক্রফোনে গলা পরিষ্কার করে ইতস্তত স্বরে বলেছে, "আসলে আজ দুপুরে আমি আপনাদের সবাইকে বিশেষ স্বাদের খাবারটি খেতে এই ভোজসভায় নিমন্ত্রণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তাড়াহুড়া করে প্রস্তুতি নিতে পারি নি। এজন্য আমি দুঃখিত তবে আমি আপনাদের সবাইকে এক কাপ আঙুর ফলের ওয়াইন খাওয়াতে চাই। আপনারা আমার এই সামান্য ইচ্ছাটি গ্রহণ করলে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো" তারপর তিনি পরিবেশকদেরকে প্রতিটি খাবার টেবিলে এক বোতল আঙুর ফলের ওয়াইন দিতে বলে। এই ঘটনায় খাবার খেতে আসা লোকজন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়, কিছু বলার ভাষা খুঁজে না পেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ছেলেটির দিকে।

ছেলেটিও এবার বেশ একটু লজ্জা পেল এবং বিনয়ী অবনত কন্ঠে সে ঘোষণা করলো, "আজ আমার বিয়ে। গতকাল রাতেই মাত্র সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাবা, মা ও আত্মীয়স্বজন সবাই অন্য অঞ্চলে আছে। এই অল্প সময়ে তারা এ বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারছে না। তাই আপনারা সবাই এখন আমার সম্মানিত অতিথি।"

এ কথা শুনে রেঁস্তোরার সকল মানুষ বেশ আনন্দিত হলো। যদিও এই ছেলেকে তারা কখনোই দেখেনি বা তার সম্পর্কে এতটুকুও জানেনা, তবু সবাই হাতের কাপ তুলে একযোগে শুভেচ্ছা, আর অভিনন্দন জানায়। ছেলেটিও এই আন্তরিক অভিনন্দনের প্রত্যুত্তরে মৃদু হেসে তাঁর হাতে রাখা পেয়ালার সবটুকু ওয়াইন একবারে খেয়ে ফেললো।

"বিয়ে না হয় বুঝলাম কিন্তু কনে কোথায়?" কেউ কেউ বেশ আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করে।

এবারে ছেলেটি দরজার দিকে হাত দেখায়। সবাই দেখতে পায় যে, সাদা স্কার্ট পড়ে একটি মেয়ে প্রবেশ করছে। মেয়ের পরনে বিয়ের কোনো পোশাক নেই এমন কি মুখেও নেই কোনো প্রসাধনের ব্যবহার। মুখে খানিকটা হাসি মাখা থাকলেও তা বিয়ের কনে হিসেবে যে আনন্দ চিত্ত, লজ্জাবনত বিনম্র অভিব্যক্তি থাকতে হয় তার বিন্দুমাত্র এই মেয়েটির মধ্যে নেই। "আসলে তিনি হচ্ছেন আমার কনের সহকর্মী বন্ধু এবং তার মিতকনে।" ছেলেটি এই বলে মেয়েটিকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে যে, "আজ কনে আসবে না।"

এ কী ব্যাপার? কনে আসবে না? তাহলে এটা কী করে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়? উপস্থিত সকলে যেন বোকা বনে গেলে। কেউ কেউ এবার তাদের বিরক্তি প্রকাশ করে বলেই ফেলল, "তুমি কি আমাদের সাথে মসকরা করছো? কনে ছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠান! এ কি করে সম্ভব? "

ছেলেটি এবারও তার ঠোটের কোনে ছোট্ট হাসিটি রেখেই বিনম্র ভাবে বলছে- "সে মানে আমার হবু স্ত্রী হাসপাতালের একজন নার্স। আমরা পরিকল্পনা করেছি, আগামী বছরের জাতীয় দিবসে বিয়ে করবো। কিন্তু কিছু দিন আগে সে হাসপাতালে একজন রোগীর সেবা করার পর সেও অসুস্থ হয়ে পড়ে। গতকাল বিকেলে পরীক্ষা করার পর জানা গেল যে সেও মরন ব্যাধি সার্স রোগে আক্রান্ত হয়েছে। আপনারা তো জানেন এ রোগে আক্রান্ত হলে তার পরিণতি কি হবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। সে এখন হাসপাতালের একটি কক্ষে সম্পূর্ণ একা আর নিঃসঙ্গ যাপন করছে। তাই গতকাল রাতেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিয়ের অনুষ্ঠানটি আজ হবে।"

"তাহলে তুমি কেন তার জন্য অপেক্ষা করছো না, কেন তাঁর সেবা করছো না?" কেউ কেউ প্রশ্ন করে। "কেন অপেক্ষা করবো?" ছেলেটি বলছে, "আমি তাকে জানাতে চাই, নিঃসঙ্গ ওয়ার্ডের বাইরে তার জন্য যে অপেক্ষা করছে সে বন্ধু নয়, তার স্বামী।"

এই কথা বলে ছেলেটি পকেট থেকে হালকা গোলাপী বর্ণের একটি অলংকার বাক্স থেকে গভীর মমতা আর ভালবাসার সাথে একটি আংটি বের করে মিতকনের হাতে দিয়ে বলল-"আমার হয়ে তুমি তাকে বলো, আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। কারণ আমি নিজের হাতে তাকে এই আংটি পড়াতে পারছি না।"

এই অভাবনীয় হৃদয়বিদারক ঘটনাটি শুনে রেঁস্তোরার সবাই যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। দশ বারো সেকেন্ড যেন ঠায় নিশ্চুপ থাকে সবাই। হঠাত্ কেউ একজন যেন দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়, ওমনি গোটা রেঁস্তোরায় হাততালির ঢেউ শুরু হয়ে যায়। আর তা চলে অনেকক্ষণ, অবিরাম।

একবছর পর একই রেঁস্তোরায় বিয়ের এক বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে তারা আরেকটি ছোট আকারের ভোজসভার আয়োজন করে। সেখানে একজন অতিথি মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, "ওয়ার্ডে যখন একা থাকতে তখন তুমি প্রতিদিন কী ভাবতে?" মেয়েটি উত্তরে বলল, "আমি ভাবতাম, আমি অবশ্যই ভাল হয়ে বাইরে যাবো আর আমার স্বামীর সাথে থাকবো সারা জীবন, এই ছোট্ট সুন্দর শহরে। কারণ এ শহরেই হয়েছে আমার প্রথম প্রেম আর ভালবাসার ঘর।"

মন্তব্য
লিঙ্ক