অনেক অনেক বছর আগে উত্তরের পাহাড় ঘেরা রাজ্যে ছিল এক রাজা। তার ছিল সাত রাণী। রাজার এই বিশাল রাজ্যে কোনো কিছুরই অভাব নেই। কিন্তু রাজার মনে কোনো সুখ ছিলনা। কারণ একে একে সাত সাতটি রাণী গ্রহণ করলেও তার কোনো সন্তান নেই। কেবল একটি ছেলে সন্তানের জন্য যখন যে যা বলছে রাজা তাই করছে। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হচ্ছে না। অবশেষে এক গুণী সাধুর কথা অনুযায়ী গভীর ঘন জংগলের ঠিক মাঝখানের একটি বিশাল আমগাছ থেকে সাতটি পাকা আম এনে রাণীদের খাওয়ানো হয়। কিছুদিন পর সাত রাণী দেখল তাঁরা সবাই গর্ভবতী। মহা আনন্দে তারা এই ঘটনা রাজাকে বলে আর তাতে রাজার খুশী যেন আর ধরে না। রাজ্য জুড়ে মহাভোজের আয়োজন করা হলো, নৃত্য, গীত বাদ্যে মাতহারা হয়ে উঠলো যেন সারা রাজ্যবাসী। রাজা এই খুশীতে একদিন শিকারে যায় এবং গভীর বনের মাঝে এক অপরূপা সুন্দরীকে দেখতে পায়। রাজা তাকে দেখেই মুগ্ধ হয় এবং তাকে নিয়ে প্রাসাদে ফিরে আসে এবং কিছুদিন পর রাজা এই কন্যাকেও বিয়ে করে ফেলে।
রাজা নতুন রাণীকে পেয়ে এতটাই আত্মহারা যে সে যা বলতো রাজা তাই সরল বিশ্বাসে করতো। নতুন রাণীর প্রতি তীব্র ভালবাসা দিনে দিনে যেন আরও গভীর হতে থাকে। কিন্তু রাজা গুণাক্ষরেও টেল পেল না যে, এই নতুন রাণী আসলে মানুষ না, সে একটা রাক্ষসী। ছদ্মবেশ ধরে এখানে পড়ে আছে আর সময় বুঝে সে তার কার্য হাসিল করবে। একদিন নতুন রাণী রাজাকে একান্তে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল-
ন. রাণী: তুমি আমাকে কি সত্যিই ভালবাস, না কি তোমার সাত স্ত্রীকে বেশি ভালবাস?
রাজা: কেন তুমি এ প্রশ্ন করছ? আমি অবশ্যই তোমাকে খুব ভালবাসি তবে আমার সাত স্ত্রীকেও আমি ভালবাসি।
ন. রাণী: তুমি যদি আমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালবেসে থাকো তাহলে তুমি আমাকে প্রমাণ দাও।
রাজা: কি প্রমাণ চাও বল, তুমি যা চাইবে আমি তাই তোমাকে প্রমাণ করে দেখাবো।
ন. রাণী: সত্যি বলছ তো?
রাজা: হ্যাঁ আমি তিন সত্যি করে বলছি, যে প্রমাণ চাইবে তাই আমি করব।
ন. রাণী: তাহলে তুমি তোমার সাত স্ত্রীকে মেরে দূর পাহাড়ের গুহায় ফেলে দিয়ে আস। তুমি যদি এই প্রমাণ দিতে পার তাহলে বুঝবো তুমি সত্যি আমাকে ভালবাস আর তখন আমিই তোমাকে ছেলে সন্তান আর গভীর ভালবাসা দিয়ে তোমাকে চির সুখী করে রাখবো।
রাজা: কি বলছো তুমি নতুন রাণী! এ কি করে সম্ভব? তাছাড়া সাত রাণী এখন গর্ভবতী আর অল্প কিছুদিন পরেই তাদের সন্তান হবে। এই অবস্থায়.. না তা হয় না, তুমি তোমার কথা ফিরিয়ে নিয়ে অন্য কোনো প্রমাণ চাও তো বল, আমি করবো, কিন্তু আমি এটা করতে পারবো না।
ন.রাণী: ঠিক আছে, তুমি তোমার শপথ ভঙ্গ করতে চাও তো কর, কিন্তু আমি আমার কথা ফিরিয়ে নিতে পারি না, তাই আমিই চলে যাব দূর পাহাড়ের গুহায় আর সেখানে আমি আমাকে মেরে ফেলব।
রাজা: না রাণী তুমি এটা করো না। হায় তুমি আমাকে এ কোন পরীক্ষায় ফেললে। ঠিক আছে আমি যখন কথা দিয়েছি তখন তাই হবে।
এই বলে রাজা তার কথা মতো মন্ত্রী ডেকে আদেশ প্রদান করলো যে, দূর পাহাড়ের গুহাতে নিয়ে সাত রাণীকে মেরে রেখে আসতে হবে। মন্ত্রী তার আদেশ পালন করলো বটে কিন্তু গুহার কাছে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে বলল যে, 'আপনারা আজ থেকে এখানেই থাকবেন, যেভাবে পারেন বেঁচে থাকুন, আমার হুকুম ছিল আপনাদের মেরে ফেলার, কিন্তু আমি তা করতে পারলাম না। আপনাদের আগত সন্তানদের তাকিয়ে আমি এ কাজ করতে পারলাম না। আমি চললাম'। এই কথা বলে মন্ত্রি ফিরে যায়। এরপর সেখানে সাত স্ত্রীর জীবনে নেমে আসে মহা দূর্যোগ। আলো, খাদ্য, পানীশূন্য এই গুহায় বেঁচে থাকা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে ওঠে। অন্ধকারে তাদের দৃষ্টিশক্তিও হারিয়ে ফেলে। তার ওপর একে একে ছয় সন্তান জন্ম নেয় কিন্তু খাদ্যের অভাবে সবাই মারা যায়। সবশেষে ছোটরাণীর সন্তান হয়। সাতরাণী ভাবল এই একটি সন্তানই এখন একমাত্র ভরসা। এই ছেলেটিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হলে সেই হয়তো একদিন আমাদেরকে এখান থেকে উদ্ধার করবে। এই ভেবে সাত রাণী তাদের বুকের দুধ আর কুড়িয়ে পাওয়া যা কিছু সম্ভব খাওয়া যায় সব কিছুই খাইয়ে কোনো রকমে ছেলেটিকে বাঁচিয়ে রাখে। শুধু তাইনয় দিনে দিনে ছেলেটি সুন্দর, সু-স্বাস্থ্য আর প্রবল সাহসী, যেন সত্যিই রাজকুমার হয়ে উঠল। বছর গড়িয়ে ছেলেটির বয়স প্রায় ষোল বছর হলো।
এদিকে সেই রাজার আনন্দ রাজ্যের আনন্দ চিরদিনের ন্যায় হারিয়ে যায়। যেন এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। রাক্ষসী রাণী প্রতিরাতে তার স্বমূর্তি ধারণ করে চুপি চুপি বের হয়ে সামনে হাতি, ঘোড়া আর মানুষ যা পায় তাই একটা একটা করে খেয়ে আবার প্রাসাদে ফিরে আসে। আর দিনের বেলা ভাল মানুষ হয়ে থাকে।
এদিকে সেই যুবক ছেলে, সাতমা তার নাম রাখে শোভন, সে মায়েদের কাছ থেকে সব ঘটনা শুনতে পায়। এরপর সে বাবার ওপর প্রতিশোধ নিতে ঐ প্রাসাদে এসে একজন ভৃত্য হিসেব চাকরিতে যোগ দেয়। অবশ্য এই ঘটনা মায়েরা কিছুই জানতে পারে না। বাবার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে এসে সে দেখলো যে বাবা সত্যিই অসহায় এবং চিরদুঃখী একজন মানুষ। রাক্ষুসী রাণীই এই দুঃখ দুর্দশার জন্য দায়ী। তাকে যে করে হোক শায়েস্তা করতে হবে। এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে ভৃত্য হয়ে বাবাকে চরম সেবা করে, প্রতিদিন সন্ধ্যার আগেই সে প্রাসাদ ছেড়ে চলে যায় যাতে রাক্ষসী রাতে তাকে খেতে না পারে। আর যাবার আগে বাবাকে খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে বিছানার পাশে একগুচ্ছ ফুলের তোড়া রেখে চলে যায়। রাক্ষসী বুঝলো এই ছেলে অত্যন্ত চালাক আর সাহসী, একে শায়েস্তা করা সহজ হবে না। কেননা রাতের আগেই সে প্রাসাদ ছেড়ে চলে যায়। তাই নতুন ফন্দি এঁটে রাণী রাজাকে বলল-
রাণী: স্বামী, স্বামীগো, আমার বুকের ভিতরে কলিজার মধ্যে ভীষণ অসুখ দানা বেধেছে। আমি বোধহয় আর বেশিদিন বাঁচবো না গো। তোমার আদরের সাহসী ভৃত্য যদি সাত সাগর তেরনদীর ওপারে আমার যে বুড়িমা আছে, তার কাছ থেকে বার হাত কাঁকুড়ের তের হাত লম্বা বিচি এনে দিতে পারে তাহলে আমি সুস্থ্য হয়ে উঠব।
রাজা: কি বলছো রাণী! ওইটুকু ছেলে ও কিভাবে সেখানে যাবে আর তোমার ওষুধ আনতে পারবে?
রাণী: ঠিক আছে, তাহলে আর কি, বসে বসে তোমার চোখের সামনে আমি মরতে থাকি, আর সেটা তুমি দেখতে থাকো। আমার প্রতি এই তোমার ভালবাসা!
রাজা: না না লক্ষীটি রাগ করো না। আচ্ছা দেখি ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করে, ও যেতে রাজি কিনা।
এই বলে রাজা শোভনকে ডেকে রাণীর জন্য ওষুধ আনতে হুকুম করে। আর রাক্ষস রাণী তাকে ডেকে একটি চিরকুট হাতে ধরিয়ে বলে যে, 'এই চিরকুটটি বুড়ি মাকে দিলে সে ঠিক বুঝে যাবে যে কি করতে হবে। এটি তাকে দিয়ো'। এরপর শোভন বহু কষ্টে ঠিকানামত রাক্ষস রাজ্যের সাগরের এপারে এসে পৌছায়। এবারে সে রাক্ষসের দেয়া চিরকুটটি খুলে দেখলো সেখানে লেখা রয়েছে- "বুড়িমা এই নাও তোমার জন্য কত স্বাদের একটা জলখাবার পাঠালাম, বেশ মজাকরে খেয়ো কিন্ত"। শোভন আগেই অনুমান করেছিল যে রাক্ষস এরকমই কিছু করবে। এরপর সে চিঠিটি ছিড়ে ফেলে দেয়। সাতমায়ের দুধ খাওয়া ছেলের শরীরের জোর যেমন, গলার শক্তিও তেমন। সে এবারে সমূদ্রের এপার থেকে জোরে ডাক দিয়ে বলল- 'দিদিমা মা মা, ও ও ও দি দি মা, কোথায় তুমি, আমি তোমার নাতী বলছি, তোমার মেয়ে মরতে বসেছে তার জন্য ওষুধ নিতে এসেছি, তাড়াতাড়ি আমাকে সাগরের ওপারে নিয়ে যাও'।
বলামাত্র সাগরের ওপার থেকে সাঁই সাঁই করে বুড়ি রাক্ষসটি উড়ে চলে আসলো আর নাতিকে নিয়ে আবার ওপারে চলে গেলো।
শোভন: কইগো দিদিমা তুমি খুশি হওনি আমি তোমার নাতি এসেছি তোমার সাথে দেখা করতে?
রাক্ষস বুড়ি: খুশী বলে খুশী তোকে এই প্রথম দেখলাম, তুই আমার একমাত্র নাতি। বল তুই কি চাস? যা চাবি তাই পাবি।
শোভন: দিদি মা বার হাত কাকুড়ের তের হাত বিচি কি তুমি জানো দিদিমা? এটা খেলে নাকি আমার মা বেঁচে যাবে।
রাক্ষস বুড়ি: ওরে আমার সোনারে,ওরে আমার মানিকরে আয় তোকে আরেকটু আদর করে নেই। আয় ঐ যে ঘরের কোনে রাখা আছে যত খুশী তোর দরকার নিয়ে যা। এই নে এইটা সবচেয়ে ভাল কাকুড়, এটা খাইয়ে তোর মাকে ভাল করগে যা। সত্যিই একটা কলিজার টুকরা তুই আমার।
শোভন: দিদিমা, শরীর টা কেমন যেন করছে আমি একটু বিশ্রাম নিতে চাই। আজ না হয় এখানে থাকি, কাল সকালে যাবো।
রাক্ষস বুড়ি: আচ্ছা ঠিক আছে তোর যা ইচ্ছে তাই কর। তুই ওই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পর যা।
শোভন: দিদিমা এই দেয়ালে ঝোলানো রয়েছে মোটা দড়ি আর মুগুরের মতো দেখতে ওগুলো কি?
বুড়ি: ওগুলো দিয়েই তো আমি সাগর পাড় হই। মুগুর আর দড়ি হাতে করে যখনই সাগর পারে গিয়ে বলবে যে- "হেই শক্ত মুগুর,লম্বা দড়ি ওরে, দেনা আমায় সাগর পার করে" ওমনি হুস করে সাগরের ওপারে নিয়ে যাবে।
শোভন: বাহ! খুব মজার তো, আচ্ছা দিদি মা ঐ যে ঘরের কোনে ছোট্ট খাঁচায় একটি সবুজ পাখি রয়েছে, ওই পাখিটির নাম কি?
বুড়ি: দাদা ভাই ওই পাখির নাম তো কোনো মানুষকে বলতে নেই। কিন্তু তোকে তো বলতে পারি, তুই আমার দাদাভাই। ওটা একটা বিশেষ পাখি, ওই পাখিটার মধ্যেই রয়েছে তোর মায়ের প্রাণপাখী। পাখিটা মরেগেলেই কেবল তোর মা মরে যাবে।
এভাবে শোভন রাক্ষস বুড়ির কাছ থেকে সব কিছু শুনে নেয়। খাঁচার পাখিটি চুরি করে সুযোগ বুঝে বুড়ির শিখিয়ে উপায় সমুদ্র পাড় হয়ে সোজা রাজ প্রাসাদে ফিরে আসে। এদিকে রাজ্যজুড়ে হাহাকার, মহামারি যেন আরও বেড়েই চলেছে। দলে দলে মানুষ এসে রাজার কাছে নালিশ করতে লাগল যে, কোথা থেকে এক বিশাল দৈত্যাকার পাখি প্রতিদিন উড়ে এসে মানুষ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কোনো ভাবেই তাকে মারা যাচ্ছে না বা ধরাও যাচ্ছে না। হুজুর এই মহা বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করুন। আমাদের বাঁচান, হুজুর।
এই অবস্থায় শোভন সবার মাঝে দাড়িঁয়ে বলে উঠলো 'আমি জানি কিভাবে পাখিটাকে মারতে হবে। তবে এই কাজটি করার সময়ে রাণীকে আপনার পাশে থাকতে হবে'। কথামত রাজা রাক্ষস রাণীকে ডেকে তার পাশে দাঁড় করালো।
এরপর শোভন যেইমাত্র খাঁচাটি বের করল, ওমনি রাক্ষস রাণী তা দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। শোভন বলল- ' এবারে দেখুন মহারাজা, কোন পাখি আপনার রাজ্যের প্রজা আর প্রাণীদের খেয়ে সাবার করছে'। এই বলে যেইমাত্র খাঁচা থেকে পাখিটি বের করে একটি পা ছিড়ে ফেলল অমনি রাক্ষস রাণীরও একটি পা খসে পড়ল। এবারে শোভন পাখিটার গলা টিপে পাখিটাকে মেরে ফেললে অমনি রাক্ষস রাণীও মরে পড়ে থাকে মেঝেতে।
সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ছেলেটির দিকে। এবার শোভন তাঁর সাতমায়ের নিদারুণ দুঃখের কাহিনী খুলে বলল সবাইকে। ততক্ষণে রাজার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে বুক ভিজে যায়। রাজা ছুটে গিয়ে শোভনকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
এরপর রাজা তাঁর ছেলে শোভন আর মন্ত্রী পাইক পেয়াদা নিয়ে চলে যায়, আর সাথে নিয়ে যায় সেই বৃদ্ধ সাধুকে যে সন্তান হবার উপায় বলে দিয়েছিল। পাহাড়ের গুহার কাছাকাছি পৌঁছালে জন কোলাহল শুনে সাত রাণী আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। কিন্তু ছেলে শোভন গিয়ে সাতমাকে বলে যে আমি ফিরে এসছি আর বাবাকেও সাথে এনেছি। একথা শুনে অন্ধ হয়ে যাওয়া সাত রাণী হাতরাতে হাতরাতে গুহা থেকে বের হয়। এই দৃশ্য দেখে রাজা আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। তীব্র অনুশোচনা আর অনুতাপে পুড়তে থাকে তার মন। ঠিক এই সময় সেই সাধু এসে সাত স্ত্রীর চোখে হাত বুলিয়ে দিলে তারা আবার দৃষ্টি শক্তি ফিরে পায়। এরপর শুরুহলো তাদের মহামিলন। রাজা তার রাণীদের প্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু ততক্ষণে রাজ্যজুড়ে আবার সেই আনন্দের ঝরনা ধারা বইতে শুরু করে দেয়। প্রাণ ভয়ে যারা পালিয়ে গিয়েছিল সবাই ফিরে আসে রাজ্যে। আনন্দ রাজ্য আবার তার আগের রূপে ফিরে পেল। আবার বাগানে ফুল ফুটল আর পাখি গাইল গান।
| ||||