বেইজিংয়ে ক্রীড়াশিক্ষার মান উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ
2024-06-10 15:30:13

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের বিভিন্ন এলাকার প্রাথমিক স্কুল ও মাধ্যমিক স্কুলে ক্রীড়াশিক্ষার ওপর বেশি করে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অতীতে কেবল ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা, পরীক্ষায় অর্জিত স্কোর বা ফলাফলের ওপর নজর রাখতেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও পিতামাতারা। ফলে, অনেক বাচ্চা ছোটবেলা থেকে খেলাধুলার অভাবে দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী হতো। তাদের পক্ষে খেলাধুলা লিখিত পরীক্ষার চেয়েও কঠিন ব্যাপার ছিল।

২০২১ সাল থেকে চীনের বিভিন্ন এলাকায় ‘দ্বৈত হ্রাস নীতি’ চালু করা হয়। এর ফলে স্কুল থেকে দেওয়া নিয়মিত হোমওয়ার্কের পরিমাণ অনেক কমে যায়। পাশাপাশি, স্কুলের বাইরে চীনা ভাষা, গণিত বা ইংরেজি ভাষাসহ বিভিন্ন বিষয়ের কোচিংও অনেক হ্রাস পায়। এই দ্বৈত হ্রাস নীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য আরও বেশি সময় ও সুযোগ বের করা। নিয়মিত খেলাধুলা ও শরীরচর্চা তাদের সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান হয়ে গড়ে উঠতে সাহায্য করছে।

রাজধানী বেইজিংয়ের বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলে বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে বাচ্চাদের শরীরচর্চায় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এখন রাজধানীতেও বাচ্চাদের ক্রীড়াশিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বাচ্চারাও খেলাধুলার প্রতি আগের তুলনায় বেশি আগ্রহী হয়েছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা বিভিন্ন স্কুলে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে একটু আলোচনা করবো।

চীনের শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার-কার্যক্রম চালু হবার পর, প্রতিদিন একটি ক্রীড়া ক্লাস থাকছে। স্কুলশেষেও বাচ্চাদের জন্য থাকছে খেলাধুলার আরও সুযোগ-সুবিধা। বেইজিং মহানগরের ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষা ও উন্নয়নের ওপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখানে প্রতিদিন শিক্ষার্থীরা কমপক্ষে এক ঘন্টা শরীরচর্চার সময় পায়। বিভিন্ন স্কুলে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর সুফল ইতোমধ্যেই পেতে শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা; তাদের মুখে হাসি ফুটেছে।

বস্তুত, ২০২১ সালে বেইজিং মহানগর শিক্ষা কমিটি ‘বাধ্যতামূলক শিক্ষায় ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য পর্যালোচনা প্রস্তাব’ গ্রহণ করে। এতে ক্রীড়া-পরীক্ষার স্কোর ৪০ থেকে ৭০-এ উন্নীত করা হয় এবং সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার স্কোর মাধ্যমিক স্কুলের চূড়ান্ত পরীক্ষার স্কোরের সাথে যোগ করার নিয়ম চালু হয়। নিয়ম অনুসারে, বিভিন্ন শ্রেণীর ক্রীড়া-পরীক্ষার জন্য ৪০ নম্বর ও ফাইনাল পরীক্ষার জন্য ৩০ নম্বর থাকবে। আগে, ফাইনাল পরীক্ষায় ৮টি বিভিন্ন ক্রীড়া অন্তর্ভুক্ত ছিল। সংস্কারের পর এখন তা উন্নীত হয়েছে ২২টিতে। শিক্ষার্থীদেরকে এই ২২টি ক্রীড়ার মধ্যে ৪টি বাছাই করতে হবে এবং সেসব বিষয়ে ক্রীড়া-পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে।

বিভিন্ন শ্রেণীর ক্রীড়া-পরীক্ষার স্কোর হিসাব করা সংশ্লিষ্ট সংস্কার কার্যক্রমের একটি বড় বৈশিষ্ট্য। এমন সংস্কারের পর, প্রাথমিক স্কুল থেকে ক্রীড়া-পরীক্ষার স্কোর হিসাব করা শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীরা শারীরিক পরীক্ষায় ভালো করলে শতভাগ নম্বর পেতে পারে। এমন উত্সাহব্যাঞ্জক পদ্ধতির কারণে, বর্তমানে প্রাথমিক স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রীরা শরীরচর্চার অভ্যাস তৈরিতে উত্সাহিত হচ্ছে এবং পিতামাতার সহায়তায় বাচ্চাদের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহও বেড়েছে। এ সম্পর্কে বেইজিং মহানগরের শিক্ষা কমিটির জনৈক কর্মী বলেন, বাচ্চাদের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহকে সম্মান দিতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার পাশাপাশি, ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত প্রাধান্য আর পার্থক্যসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করতে হবে।

নতুন পরীক্ষাব্যবস্থার ভিত্তিতে, বেইজিংয়ের বিভিন্ন স্কুলে ক্রীড়া ক্লাসও সংস্কার করা হয়েছে। টানা ৩ বছরের প্রচেষ্টায়, বিভিন্ন স্কুলের ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের প্রাণবন্ত খেলাধুলা দেখা যাচ্ছে; তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটছে; এবং শরীরচর্চার অভ্যাসও গড়ে উঠছে।

পরিসংখ্যান অনুসারে, গত ৩ বছর ধরে, বেইজিংয়ের মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক অবস্থা অব্যাহতভাবে উন্নত হয়েছে। ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত, বিভিন্ন মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্য-পরীক্ষায় অনেকের অবস্থা চমত্কার এবং ২০২৩ সালে শারীরিরভাবে শ্রেষ্ঠ অবস্থায় পৌঁছানো ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২০২১ সালের চেয়ে ৬ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৩ সালে বেইজিংয়ের মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের মায়োপিয়ার হার ২০২২ সালের চেয়ে ১ শতাংশ কমেছে। তাই বলা যায়, নতুন ক্রীড়াব্যবস্থার কারণে, ছাত্রছাত্রীরা খেলার মাঠে যাওয়ার সুযোগ অনেক বেশি পাচ্ছে এবং পিতামাতারা বাচ্চাদের শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষার ওপর আরও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

প্রতিদিন বিকেল সাড়ে তিনটায় বেইজিংয়ের বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলের ক্লাস শেষ হয়। তখন থেকে ক্রীড়াশিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট স্কুলের প্রেসিডেন্টের উত্সাহে, ছাত্রছাত্রীদের খেলাধুলা ও শরীরচর্চা শুরু হয়। প্রতিদিন খেলাধুলার বিষয় আলাদা এবং ক্রীড়া সরঞ্জামের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। বেইজিংয়ের বিভিন্ন এলাকায় ক্রীড়া সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতির ধরন ভিন্ন। এভাবে প্রত্যেক বাচ্চা তাদের প্রিয় খেলা বেছে নিতে পারে এবং শরীরচর্চার সুযোগ পায়।

বেইজিংয়ের বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে প্রতিদিন এক ঘন্টার মতো শরীরচর্চা ও খেলাধুলার জন্য বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। ভোরবেলার দৌড়ানো, প্রতিটি ক্লাসের মাঝখানে হালকা ক্রীড়া ও অ্যারোবিকসে অংশগ্রহণের সুযোগ, পারিবারিক শরীরচর্চা ও শারীরিক ফিটনেস পরীক্ষাসহ, বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্কুলের করিডারে, বাসার লিভিং রুমে, স্কুল থেকে বাসায় যাওয়ার পথসহ বিভিন্ন এলাকায় বাচ্চাদের জন্য শরীরচর্চার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। বিষয়টা দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে।

এর পাশাপাশি, বেইজিং মহানগরে টানা কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন স্কুলে ক্রীড়া ক্লাসের পরীক্ষামূলক সংস্কার-কার্যক্রম চালু হয়েছে। স্কুলগুলো নিজেদের প্রাধান্য ও সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে, ক্রীড়া ক্লাসের সংস্কার করেছে। ফলে, সেসব স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক অবস্থার মান উন্নত হয়েছে; ক্রীড়া ক্লাসের শিক্ষার মান বেড়েছে; এবং ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজনসহ বিভিন্ন খাতে নতুন অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।

বেইজিং সিছেং এলাকায় ‘স্কুলে দড়ি লাফ’ প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়। এই প্রতিযোগিতা চলে প্রতিটি ক্লাসে। পরিবারের অন্য সদস্যদেরকেও এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়। বেইজিংয়ের হাইতিয়ান এলাকায় প্রতিবছর স্কুলে ফুটবল প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়। মিইয়ুন এলাকায় টানা ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের দৌড়ের চর্চা চালু আছে। এখন প্রতিদিন একসাথে দৌড়ানো স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত চর্চার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ইয়ানছিং এলাকার ৪০টি মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলে ফুটবল খেলার প্রশিক্ষণ কোর্স চালু হয়েছে। সেখানে বিশেষ ফুটবল দলও রয়েছে।

বেইজিং চিংইউয়ান স্কুলের খেলার মাঠে ছাত্রছাত্রীরা বর্গাকারে দাঁড়িয়ে সংগীতের তালে তালে শরীরচর্চা করে। মাঝে মাঝে তারা সংগীতের ছন্দের তালে তালে দৌড়ায়। ক্লাসের বিশ্রামের সময় এমন পদ্ধতিতে শরীরচর্চা তাদের মনে ওপর চাপ কমায় এবং এটি শারীরিক ও মানসিক অবস্থার সমন্বয়ে সহায়ক। স্কুলের ক্রীড়া দলের শিক্ষক ফেং সুয়ে ছাও তা-ই মনে করেন।

বাচ্চাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং তাদের  আনন্দময় পরিবেশে বড় হতে দেওয়া প্রত্যেক বাবা-মার মনের চাওয়া। বর্তমানে স্কুলগুলোতে ক্রীড়াশিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এক অংশে পরিণত হয়েছে। ক্রীড়ার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের শরীরের অবস্থা উন্নত হয় এবং তাদের বহুমুখী দক্ষতারও উন্নয়ন ঘটে।

এ সম্পর্কে বেইজিং শিক্ষা কমিটির জনৈক কর্মী বলেন, বাচ্চারা বড় হওয়ার পর একজন শিক্ষক, ডাক্তার, বিজ্ঞানী বা সাধারণ কর্মী হতে পারে; তবে, তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সব ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য ভালো হলে যেকোনো চ্যালেঞ্জ বা সমস্যা মোকাবিলা করা তাদের জন্য সুবিধাজনক হবে।

চলতি বছর বেইজিং মহানগরের বিভিন্ন মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলে ফুটবলসহ বিভিন্ন খেলাধুলার প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হবে। এমন উদ্যোগ বাচ্চাদের শরীরচর্চার পাশাপাশি, প্রতিযোগিতা ও সংগ্রামের চেতনার প্রতিও আগ্রহী করে তুলবে।  তাঁরা সহপাঠীদের সাথে প্রচেষ্টা চালিয়ে, নিজেদের মধ্যে দলগত মনোভাব ও সম্মিলিত সম্মানবোধ গড়ে তুলতে পারবে।

বিভিন্ন খেলাধুলার জনপ্রিয়তা বাড়ানো ক্রীড়াশিক্ষার আরেকটি লক্ষ্য। জানা গেছে, বেইজিং মহানগরে স্কি ও বরফের সাথে জড়িত ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট স্কুলের সংখ্যা ২০০টি; ফুটবলসংশ্লিষ্ট স্কুলের সংখ্যা ৩৭১টি; অলিম্পিক-সংশ্লিষ্ট পরীক্ষামূলক স্কুলের সংখ্যা ১৯৯টি; মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলে অলিম্পিক খেলোয়াড় দলের সংখ্যা ৫৬টি। বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে উচ্চমানের ক্রীড়া দল গঠনে উত্সাহ দেয় বেইজিং পৌর সরকার, যাতে শিক্ষার্থীদের জন্য আরও বড় ক্রীড়া প্ল্যাটফর্ম প্রদান করা যায়।

বস্তুত, খেলাধুলা শুধু স্কুলে নয়, বরং বিভিন্ন পরিবার ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে আগের তুলনায় অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। বেইজিং তাশিং এলাকায় পরিবার, স্কুল ও সমাজকে যুক্ত করে, জাতীয় ফিটনেস পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে; পিংকু এলাকায় পরিবারে সদস্যদের একসাথে ৫ কিলোমিটার দৌড়ানোর প্রতিযোগিতা চালু হয়েছে। এখন রাস্তায় ও আবাসিক কমিউনিটিতে বাচ্চাদের ও বাবা-মায়েদের একসঙ্গে শরীরচর্চার দৃশ্য বেশি দেখা যায়। এটি সবার শারীরিক অবস্থার উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য সহায়ক। বাচ্চাদের মানসিক অবস্থাও আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ক্রীড়া পারিবারিক সম্পর্কও ঘনিষ্ঠতর করছে।

গত কয়েক বছরের সংস্কারের পর একথা এখন বলা যায় যে, বেইজিংয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের স্কুলে ক্রীড়ার ওপর যথেষ্ঠ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে, ছাত্রছাত্রীদের সঠিক চর্চা আর যথেষ্ঠ সময় নিয়ে খেলাধুলা করার দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার। ভবিষ্যতে পরিবার, সমাজের বিভিন্ন মহল ও স্কুলের সহযোগিতায়, ক্রীড়ার মান উন্নয়ন প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করেন বেইজিং শিক্ষা কমিটির কর্মকর্তারা। খেলাধুলা মনের উদ্বেগ কমায় এবং স্বাস্থ্যকর চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। তাই, একে গুরুত্ব দেওয়া যুক্তিযুক্ত।

(সুবর্ণা/আলিম/রুবি)