0119jingji.mp3
|
গেল ২০১৪ সালে চীনের শস্য উত্পাদনের পরিমাণ ছিল ৬০ কোটি ৭০ লাখ ৯৯ হাজার টন। উপাত্ত থেকে জানা গেছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চীন মোট ১ কোটি ৭১ লাখ ৪০ হাজার টন খাদ্যশস্য ও শস্যের গুঁড়া আমদানি করেছে, যা ২০১৩ সালের একই সময়ের চেয়ে ৩৩.৩ শতাংশ বেশি।
২০০৮ সাল থেকে চীন শস্যের রপ্তানিকারক বড় দেশ হতে আমদানিকারক বড় দেশে পরিণত হয়েছে। অনুমান অনুযায়ী, আগামী ২০২০ সাল নাগাদ চীনের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি হবে। এতো বেশি মানুষের খাওয়ার সমস্যার সমাধান কেবল চীনের স্থিতিশীলতার সম্পর্ক সম্পর্কিত নয়, বরং বিশ্ব খাদ্যশস্য নিরাপত্তার প্রতিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
চীনের কৃষি মন্ত্রণালয়ের মূখপাত্র বি মেই চিয়া জানান, এখন প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ২৫০ বিলিয়ন থেকে ৩০০ বিলিয়ন কেজি খাদ্যশস্য লেনদেন হয়। এ পরিমাণ চীনের মোট শস্যের চাহিদার অর্ধেকেরও কম। তিনি বলেন, "এখন ধান, গম ও ভুট্টা এ তিনটি প্রধান শস্যের আমদানির পরিমাণ কেবল চীনের অভ্যন্তরীণ উত্পাদন পরিমাণের ২.৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। চীনে যে সব শস্যের অভাব রয়েছে ভবিষ্যতে আমরা শুধু সেসব শস্যই আমদানি করবো। তবে খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ বিপুল মাত্রায় বৃদ্ধি হবে না।"
এর আগে চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর গ্রামের সমাজ ও অর্থনীতি তদন্ত বিভাগের প্রধান সোং ইয়াও চাং বলেছেন, উত্তর চীনের কিছু অঞ্চলে গুরুতর অনাবৃষ্টি হলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কারণে খাদ্যশস্যের উত্পাদন পরিমাণ স্থিতিশীলভাবে বৃদ্ধি করাও নিশ্চিত হয়েছে। তিনি বলেন, "গতবছর চীনের ইউনিট অঞ্চলের শস্য উত্পাদনের পরিমাণ এর আগের বছরের চেয়ে ০.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে চীনে টানা ১১ বছর ধরে শস্য উত্পাদনের পরিমাণ বেড়েছে।"
উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৪ সালে চীনে প্রতি হেক্টর জমিতে ৫৩৮৫ কেজি শস্য উত্পাদিত হয়েছে। যা এর আগের বছরের চেয়ে ৯ কেজি বেড়েছে। শস্য চাষের আয়তন ১১ কোটি ২৭ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর, যা এর আগের বছরের চেয়ে ৭ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর বেড়েছে।
তবে টানা ১১ বছর ধরে শস্য উত্পাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির পিছনে আরেক সত্য লুকিয়ে রয়েছে। তা হচ্ছে অতীতে শস্য উত্পাদনের চাপে চীনের মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানিসহ সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সম্পদগুলো বিরাট চাপ বহন করেছে। চীনের কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপাত্ত অনুযায়ী, চীন প্রায় বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ রাসায়নিক সার ব্যবহার করেছে। তবে উত্পাদিত শস্যের পরিমাণ কেবল বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ। ভূমিক্ষয়ের আয়তন আবাদি জমির প্রায় ৪০ শতাংশেরও বেশি। কিছু কিছু অঞ্চলের মাটি অপেক্ষাকৃত ভারী এবং দূষিত হয়েছে। পরিবেশের গুণগত মানও উদ্বেগজনক।
গত বছরের ডিসেম্বর মাসে চীনের কৃষি মন্ত্রণালয় প্রথম বার 'চীনের আবাদি জমির গুণগত মান সংক্রান্ত ইস্তেহার' প্রকাশ করেছে। এতে গুণগত মানের ভিত্তিতে চীনের আবাদি জমিকে দশটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে মধ্য ও নিম্নমানের আবাদি জমি ছিল ৮ কোটি ৮৫ লাখ হেক্টর, যা চীনের আবাদি জমির মোট আয়তনে প্রায় ৭০ শতাংশে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের চাষ বিষয়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান চেং ইন দে বলেন,"যদি আবাদি জমির মান ০.৫ শতাংশ উন্নতি হয়, তাহলে ১০০ বিলিয়ন কেজি উত্পাদনের ক্ষমতা বাড়বে। আমাদের শস্য উত্পাদনের টেকসই উন্নয়নের জন্য বলিষ্ঠভাবে সমর্থন করা হবে।"
চেং ইন দে জানান, ভবিষ্যতে চীনে জৈব সবুজ সম্পদ প্রয়োগের হার আরো বাড়বে। এর ফলে ২০২০ সাল নাগাদ প্রাণীর মল ও জৈব সার ব্যবহারের হার ৬০ শতাংশে পৌঁছানো সম্ভব হবে। এভাবে আবাদি জমিতে অম্ল হওয়া, লবণাক্ত হওয়া ও ভারী ধাতু দুষণসহ নানা সমস্যা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ২০০৯ সালে চীন 'অর্থনীতি বৃদ্ধি নিশ্চিত করার পাশাপাশি আবাদি জমি রক্ষা করার' কৌশল উত্থাপন করেছে এবং আবাদি জমি রক্ষা করার জন্য সবচেয়ে কড়া ব্যবস্থা চালু করেছে। যাতে ১২ কোটি হেক্টর আবাদি জমি কখনো কমানো না হয়।
আবাদি জমি রক্ষা করার জন্য কিছু দিন আগে চীনের ভূমি ও সম্পদ মন্ত্রণালয় আর কৃষি মন্ত্রণালয় যৌথভাবে 'আরো ভালোভাবে চিরস্থায়ী মৌলিক কৃষি জমি চিহ্নিত করা সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি' জারি করেছে। এ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, শহরাঞ্চলের কাছের এলাকা ও সড়কের আশেপাশে এলাকাসহ ভালো আবাদি জমি চিরস্থায়ী মৌলিক কৃষি জমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রথমে আবাদি জমির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১০ কোটি ৪০ লাখ হেক্টর মৌলিক কৃষি জমিকে নিঁখুতভাবে চিহ্নিত করা হবে। তারপর দু'বছরের মধ্যে সারা চীনের চিরস্থায়ী মৌলিক কৃষি জমি নির্ধারণ কাজ সম্পন্ন করা হবে।
চীনের ভূমি ও সম্পদ মন্ত্রী চিয়াং দা মিং বলেন, "জাতীয় শস্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মূল ব্যবস্থা হচ্ছে আবাদি জমি রক্ষা করা। চলতি বছর সার্বিকভাবে চিরস্থায়ী কৃষি জমি নির্ধারণের কাজ করা হবে। মৌলিক কৃষি জমি নির্ধারণের পর কেউ তা দখল করতে পারবে না। নিয়ম লঙ্ঘনকারীদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।"
তথাকথিত চিরস্থায়ী মৌলিক কৃষি জমি মানে বিশেষ করে সংরক্ষিত জাতীয় পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ মানের আবাদি জমি অর্থাত চিরস্থায়ী মৌলিক কৃষি জমি অন্য কাজের জন্য কোনভাবে দখল করতে দেবে না চীন সরকার।
কৃষি মন্ত্রী হান ছাং ফু বলেন, "দুটি মৌলিক নীতি দৃঢ়ভাবে রক্ষা করতে হবে। প্রথম হচ্ছে ১২ কোটি হেক্টর আবাদি জমি ভালোভাবে রক্ষা করতে হবে। দ্বিতীয় হচ্ছে বিদ্যমান মৌলিক কৃষি জমির আয়তন কমানো যাবে না।"
কৃষির টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং চীনের খাদ্যশস্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য চলতি বছর চীন সরকার আলুকে কৃষি অবকাঠামো সুবিন্যাস করার প্রধান বিকল্প পণ্য হিসেবে গণ্য করেছে। আলু চীনের চতুর্থ প্রধান খাদ্যে পরিণত হতে পারে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের চাষাবাদ বিষয়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপপ্রধান বান ওয়েন বো বলেন, "আলু প্রধান খাদ্য হওয়া মানে আলুকে প্রক্রিয়াকরণের পর চীনাদের অভ্যস্ত পাউরুটি, মানথাও ও নুডুল্সের মতো প্রধান খাদ্যে রূপান্তর করা। যাতে আলুকে অপ্রধান খাদ্য থেকে প্রধান খাদ্যে তুলে আনা সম্ভব হয়।"
আলুকে প্রধান খাদ্যে রূপান্তর করার কৌশল হচ্ছে চীনের খাদ্য নিরাপত্তা কৌশলের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। যুগের উন্নয়নের সাথে সাথে চীনাদের খাবার কাঠামো পরিবর্তন হচ্ছে। এর কারণে আগামী দিনের অপেক্ষাকৃত এক লম্বা সময়ে চীনের খাদ্য চাহিদা প্রবৃদ্ধির প্রবণতা বজায় থাকবে। যদিও গম, ধান ও ভুট্টা- এ তিনটি প্রধান খাদ্যের উত্পাদনের পরিমাণ বহু বছর ধরে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আবাদি জমির পানি সম্পদ আর চাষের কার্যকারিতার নানা প্রভাবের কারণে ভবিষ্যতে এ তিনটি প্রধান খাদ্য উত্পাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে ব্যয় আরো বাড়বে। সুতরাং কৃষি মন্ত্রণালয় আলুকে তিনটি প্রধান খাদ্যের সম্পূরক খাদ্য হিসেবে তুলে এনেছে এবং ধাপে ধাপে তাকে চতুর্থ প্রধান খাদ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে।
উপ-কৃষিমন্ত্রী ইয়ু সিন রোং বলেন, "আলু শীত, খরা ও অনুর্বর পরিবেশ সহ্য করতে পারে। বিশেষ করে দক্ষিণ চীনে শীতকালে কৃষি জমিতে যখন ফসল খালি থাকে, তখন আলু চাষ করা যায়। ফলে আলু চাষ করার সুপ্তশক্তি অনেক। তথ্য অনুসারে, এক হেক্টর জমিতে ১ লাখ ২০ হাজার কেজি আলু উত্পাদিত করা সম্ভব হয়। কিন্তু এখন চীনে আলুর গড় উত্পাদনের পরিমাণ মাত্র এক হেক্টর ১৫ হাজার কেজি।"
জানা গেছে, চীনে আলু উত্পাদনের হার ব্যাপক পরিমাণ বৃদ্ধির অবকাশ রয়েছে। আলুর পুষ্টিকর মূল্য অনেক বেশি। যার কারণে আলু উত্পাদনের মাধ্যমে দেশের অধিবাসীদের খাবারের কাঠামো উন্নত করা সম্ভব। গম, ধান ও ভূট্টার তুলনায় আলুতে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় শর্করা, প্রোটিন ও খাদ্য বিষয়ক ফাইবার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়াও গম এবং ধানের মধ্যে না থাকা ক্যারোটিনও আলুর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে।
ইয়ু সিন রোং আরো বলেন, "আমরা আলু চাষের আয়তন, ইউনিট অঞ্চলের উত্পাদনের মান, মোট উত্পাদন পরিমাণ আর প্রধান খাদ্য জাতীয় পণ্য উত্পাদনের পরিমাণ সবক্ষেত্রেই লক্ষ্যনীয় অগ্রগতি অর্জনের প্রচেষ্টা চালাবো। আলুর মত প্রধান খাদ্য জাতীয় পণ্যকে জনসাধারণের দৈন্দিন জীবনের প্রধান খাবারের অন্যতম হিসেবে গড়ে তুলবো।"
এদিকে গত বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির গ্রামীণ কার্য সম্মেলনে জোরালো ভাষায় বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে চীনে খাদ্য উত্পাদনের পরিমাণ স্থিতিশীল করা, প্রবৃদ্ধির অবকাঠামো নিশ্চিত করা এবং শস্যের গুণগত মান উন্নত করা হবে। এছাড়াও কৃষকদের আয় বৃদ্ধির উপায় আবিস্কার করার পাশাপাশি খাদ্য উত্পাদনের পরিমাণ ৫৫০ বিলিয়ন কেজির বেশি নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকদের আয় বৃদ্ধির হার ৭.৫ শতাংশের বেশি বজায় রাখা হবে। কৃষি উন্নয়ন সংখ্যা বৃদ্ধি থেকে সংখ্যা ও মান উভয় ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করা হবে। (ইয়ু/মান্না)
| ||||