0105pandian.mp3
|
২০১৪ সালে চীনের অর্থনীতিতে ভালোভাবেই পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। 'নতুন স্বাভাবিক অবস্থা'-র ধারণাও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধারণা ২০১৫ সালে চীনের অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। সুপ্রিয় শ্রোতা, শুনুন এ বিষয়ের ওপর একটি প্রতিবেদন।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত চীনের কেন্দ্রীয় অর্থনীতি বিষয়ক কার্য-সম্মেলনে অর্থনীতির এই 'নতুন স্বাভাবিক অবস্থা'র ধারণা ব্যাখ্যা করা হয়। সম্মেলনে চীনের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ লি ই নিং উল্লেখ করেন, 'নতুন স্বাভাবিক অবস্থা' অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুণগত মান এবং কাঠামো বিন্যাসের ওপর গুরুত্বারোপ করে। তিনি মনে করেন, ভবিষ্যতে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণাও বদলে যাবে। তিনি বলেন, "প্রথমত, অর্থনীতির কাঠামো জিডিপির মোট পরিমাণের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, রপ্তানি ও আমদানির ধারণা পরিবর্তন করতে হবে; রপ্তানি যত বেশি হবে ততই ভালো—এমন ধারণা আজকাল আর গ্রহণযোগ্য নয়। তৃতীয়ত, উচ্চ কর্মসংস্থানের সাথে উচ্চ বিনিয়োগের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই; চতুর্থত, উচ্চ সুদের হার দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা না-ও যেতে পারে; পঞ্চমত, যে-কোনো শিল্পের ক্ষেত্রে এ কথা উপলব্ধি করতে হবে যে, বাজার সৃষ্টি করা যায় এবং বাজার কখনো স্থবির হয় না।"
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখন অর্থনীতিতে বিরাজমান 'নতুন স্বাভাবিক অবস্থা'কে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হবে, যাতে চীনের অর্থনীতি সুস্থ ও টেকসই উন্নয়নের পথ ধরে সামনে এগিয়ে যেতে পারে।
'নতুন স্বাভাবিক অবস্থা'-য় ২০১৪ সালে চীনের অর্থনীতিতে বেশ কয়েকবার হ্রাস-বৃদ্ধি দেখা গেছে। বিগত ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চীনের অর্থনীতি উচ্চ বৃদ্ধির গতি বজায় রাখে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে বিস্ময়ের জন্ম দেয়। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল তুলনামূলকভাবে কম। অনেক বিশেষজ্ঞ অনুমান করছেন, ২০১৪ সালে চীনের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হবে প্রায় ৭ শতাংশ।
চীনের আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একাডেমির বিশ্ব অর্থনীতি গবেষণালয়ের পরিচালক চেন ফেই ইং এ প্রসঙ্গে বলেন, "জিডিপি চীনের কাছে এখনো গুরুত্বপূর্ণ সূচক। চীনের বিভিন্ন কর্মসূচি ও পরিকল্পনার কেন্দ্রীয় লক্ষ্য হচ্ছে অর্থনীতির উন্নয়ন। অর্থাত অর্থনীতির উন্নয়ন এখনো গুরুত্বপূর্ণ। তবে বর্তমানে আর জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য আগের মতো পরিবেশ ও জনতার স্বার্থ উপেক্ষা করে কেবল কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধিকে মুখ্য গণ্য করা হয় না। আমরা টেকসই ও নিম্ন কার্বনভিত্তিক উন্নয়ন চাই। তা না-হলে আমাদের মূল সমস্যার সমাধান হবে না।"
এর পাশাপাশি, চীনে ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া সহজতর এবং এ ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বাজার অর্থনীতির উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। এটি চীনের অর্থনীতির উন্নয়নে নতুন প্রাণশক্তিও যুগিয়েছে বলা চলে। ২০১৪ সালে চীনের বিদেশে বিনিয়োগ নীতিতে বড় পরিবর্তন ঘটে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিভাগের উপপ্রধান ফাং ওয়েই বলেন, "২০১৩ সালে বিদেশে মোট ৬৬০৮টি চীনা বিনিয়োগ প্রকল্প অনুমোদিত হয়। কিন্তু সংশোধিত বিধি অনুসারে এগুলোর মধ্যে কেবল ৩০টি প্রকল্প অনুমোদন করাই যথেষ্ট। বাকি ৯৯ শতাংশ প্রকল্প নথিভুক্তই থাকবে।"
২০১৪ সালে চীনের আর্থিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন নানা মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। নভেম্বরে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবার সুদের হার কমায়। এতে শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঁজি সংগ্রহ ব্যয় হ্রাস পায়। দেশে ও বিদেশের অর্থবাজার এবং সাধারণ মানুষের জীবিকার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাতের ওপরও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
সুদের হার হ্রাসসহ অন্যান্য নয়া উপাদানের প্রভাবে চীনের শেয়ার বাজার ২০১৪ সালের শেষ দিকে ৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। শেয়ার বাজারের প্রবৃদ্ধির দিক দিয়ে এসময় চীন ছিল বিশ্বে প্রথম স্থানে। এসময় চীনের শেয়ার বাজারের মোট পরিমাণ জাপানকে ছাড়িয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বড় শেয়ার বাজারে পরিণত হয়।
২০১৪ সালে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংস্কার প্রক্রিয়া আরো জোরদার করা হয়। এসময় অনেক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে মিশ্র মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়। চীনের পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প গোষ্ঠী এবং ২৫টি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তির মাধ্যমে এবছর মোট ১০,০০০ কোটি ইউয়ান সংগ্রহ করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে 'কিউকিউ', হাইয়ার ও হুইইউয়ানসহ ১১টি বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান।
চীনের পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প গোষ্ঠীর তথ্য মুখপাত্র লিউ দা ফেং বলেন, "চীনের পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প গোষ্ঠী তার মূল্য নির্ধারণ করেছে এবং ৭০ শতাংশ শেয়ার নিজের কাছে রেখে বাকি ৩০ শতাংশ বাজারে বিক্রি করেছে। এভাবে পুনর্বিন্যাসের পর প্রতিষ্ঠানটি মিশ্র মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।"
২০১৪ সালে চীনের অনলাইন বাণিজ্যও ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে। অনলাইন শিল্প-প্রতিষ্ঠান 'আলিবাবা' সাফল্যের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। আলিবাবা এবছর বাজার মূল্যের হিসেবে বিশ্বের বৃহত্তম অনলাইন শিল্প-প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। অনলাইন বাণিজ্য ২০১৪ সালে চীনের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২০১৪ সালে চীনে আয়োজিত 'এপেক' সম্মেলনে চীনের উত্থাপিত 'এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অবাধ বাণিজ্য অঞ্চল' সংক্রান্ত রোড ম্যাপ গৃহীত হয়। চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী কাও হু চেন এ প্রসঙ্গে বলেন,"রোড ম্যাপের মাধ্যমে এপেক 'এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অবাধ বাণিজ্য অঞ্চল' প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে মৌলিক নীতি এবং কার্য-পরিকল্পনা নির্ধারণ করেছে। এটা এপেকের ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।"
২০১৪ সালে চীনের মুদ্রা রেনমিনপি'র আন্তর্জাতিককরণ প্রক্রিয়াও ধাপে ধাপে এগিয়ে গেছে। 'ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড' কৌশল সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্য নতুন সুযোগ বয়ে আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৫ সালে চীনে সংস্কার প্রক্রিয়া আরো জোরদার হবে। 'নতুন স্বাভাবিক অবস্থা'র সাথে খাপ খাইয়ে চীনের অর্থনীতি সুষ্ঠুভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে বলেও তারা বিশ্বাস করেন। (ইয়ু/আলিম)
| ||||