২০১৩ সালের শেষ নাগাদ পর্যন্ত চীনে মোট গাড়ির সংখ্যা ছিল ১৩ কোটি ৭০ লাখ। ২০ লাখের বেশি গাড়ি আছে এমন চীনা শহরের সংখ্যা আটটি। রাজধানী পেইচিংয়েই আছে ৫০ লাখেরও বেশি গাড়ি। চীনে গাড়িশিল্পের দ্রুত উন্নয়নের পাশাপাশি তেলসম্পদের ঘাটতি, পরিবেশ দূষণসহ বিভিন্ন সমস্যাও দেখা দিয়েছে।
২০১২ সালে চীন 'জ্বালানি সাশ্রয় এবং নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ির শিল্প উন্নয়ন পরিকল্পনা (২০১২-২০২০)' গ্রহণ করেছে। এতে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে বিদ্যুত্চালিত গাড়ির শিল্প উন্নয়নের কৌশলের কথা।
আসলে গত শতাব্দীর ৮০'র দশক থেকে চীনে বিদ্যুত্চালিত গাড়ির গবেষণাকাজ শুরু হয় এবং ২০০৮ সালে পেইচিং অলিম্পিক গেমস চলাকালে প্রথমবারের মতো নিজস্বভাবে উত্পাদিত ৫০০টি বিদ্যুত্চালিত গাড়ি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়। ২০১০ সালে শাংহাই বিশ্ব মেলা চলাকালে এক হাজারেরও বেশি নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ি বিশ্বমেলার উদ্যানে যাতায়াত করতো। ২০১১ সালে শেনচেন আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের গেমস চলাকালে সাংগঠনিক কমিটি দুই হাজারের বেশি নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ি ব্যবহার করেছে।
উল্লিখিত অঞ্চলসমূহে নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ি ব্যবহার ছাড়া, চীনের বাজারের ক্রেতাদের কাছে বিদ্যুত্চালিত গাড়ির আবেদন কেমন?
তিন বছর আগে, হাংচৌর মি: ফেং এক আকস্মিক সুযোগে বিদ্যুত্চালিত গাড়ির সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি বলেন, "তেলচালিত গাড়িতে একশ কিলোমিটার যেতে ৮ থেকে ১০ লিটার তেল লাগে, প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ইউয়ান ব্যয় হয়। কিন্তু বিদ্যুত্চালিত গাড়িতে একশ কিলোমিটার যেতে ১০ ইউয়ানেরও কম খরচ হয়। যদি আমি বিদ্যুত্চালিত গাড়ি চালিয়ে এক হাজার কিলোমিটার বা দশ হাজার কিলোমিটার যাই, তাহলে অনেক খরচ বেঁচে যায়।"
তখন বিদ্যুত্চালিত গাড়ির দাম ছিল দুই লাখ ইউয়ান। রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি ছাড়া ক্রেতাকে এক লক্ষাধিক ইউয়ান গুনতে হয়। তার মানে, দামের দিক থেকে সাধারণ মোটর গাড়ির তুলনায় বিদ্যুত্চালিত গাড়ির কোনো আলাদা সুবিধা নেই। কিন্তু মিঃ ফেং তেলের খরচ বিবেচনা করে বিদ্যুত্চালিত গাড়ি কেনার সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। তবে গাড়ি কেনার কিছুদিন পর তাকে কিছু নতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "আশি কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বে গেলে কোন সমস্যা হবে না। আরো দূরে যেতে চাইলেই সমস্যা, বিদ্যুত্চালিত গাড়িতে করে যাওয়া যাবে না। কারণ, গাড়ির বিদ্যুত সংরক্ষণের ক্ষমতা সীমিত।"
প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে বিদ্যুত্চালিত গাড়ি খুব বেশি দূর যেতে পারে না। মি: ফেং বলেন, "বর্তমানে অনেক জায়গায় গাড়িতে বিদ্যুতের চার্জ দেওয়া যায় না। আপনি যদি দূরের কোনো গন্তব্যে যেতে চান, তবে এক্সপ্রেস সড়ক বা অন্য রাজপথে গাড়িতে বিদ্যুতের চার্জ দেওয়ার কোনো সুবিধা পাবেন না। অথচ তেলচালিত গাড়ির জন্য আপনি প্রায় সবখানেই পাবেন ফিলিং স্টেশান। বিদ্যুত্চালিত গাড়ি নিয়ে ফিলিং তেলের স্টেশনে গেলে কোন কাজ হয় না।"
বর্তমানে চীনের বাজারে বিদ্যুত্চালিত গাড়ি চার্জ করার দুটি পদ্ধতি আছে। আপনি ব্যাটারি বদলে নিতে পারেন বা ব্যাপারি চার্জ করতে পারেন। মি: ফেংয়ের গাড়ির ব্যাটারি চার্জ করতে হয়। তাই তিনি গাড়ি কেনার পর সমস্যায় পড়লেন। কারণ, যেমনটি তিনি বলেছেন, তেল স্টেশনে তাঁর গাড়ি চার্জ করার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া, তাঁর বাসস্থানের আশেপাশেও বিদ্যুত্চালিত গাড়ি চার্জ করার বিশেষ স্থান নেই।
অবশ্য মিঃ ফেংয়ের কপাল ভালো। তাঁর অফিসের ভূগর্ভস্থ পার্কিং এলাকায় বৈদ্যুতিক সকেট আছে। তিনি সেখানে তাঁর গাড়ির ব্যাটারি চার্জ করতে পারেন। প্রায় তিন বছর ধরে বিদ্যুত্চালিত গাড়ি ব্যবহারের অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে মিঃ ফেং বললেন, "এখন ক্রেতারা বিদ্যুত্চালিত গাড়ি কেনার আগ্রহ কম দেখাচ্ছে। প্রযুক্তিগত নানান সমস্যার কারণেই আসলে খুব কম লোক বিদ্যুত্চালিত গাড়ি কিনছেন।"
বিদ্যুত্চালিত গাড়ি খাতে কেন্দ্রীয় প্রযুক্তির তেমন লক্ষণীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। গাড়ি খুব বেশি দূরে যেতে পারে না এবং এর দাম অপেক্ষাকৃত বেশি। গাড়ির ব্যাটারি চার্জ করার স্থাপনার অভাব রয়েছে। এ সব কারণে ভোক্তারা বিদ্যুত্চালিত গাড়ি কেনার ব্যাপারে কম আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এশীয় নির্মাণ শিল্প সমিতির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লো জুন এ প্রসঙ্গে বলেন, "২০০৯ সাল থেকে চীনে জ্বালানি সাশ্রয়ী গাড়ি এবং নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ি চালু হওয়ার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে যে, বাজারের প্রতিক্রিয়া তেমন ভালো নয়। এখন পর্যন্ত তথাকথিত নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ির মোট সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। আমরা মনে করি, এর মূল কারণ হচ্ছে এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়নি; বিশেষ করে বিদ্যুত্চালিত গাড়ি খাতে।"
বিদ্যুত্চালিত গাড়ি জনপ্রিয় গড়ে তোলার জন্য ২০১৩ সালের নভেম্বরে চীনের অর্থ মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, শিল্প ও তথ্যায়ন মন্ত্রণালয়, উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশন যৌথভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ি জনপ্রিয় করে তোলার প্রস্তাব পর্যালোচনা করে সেগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে এবং চীনের ২৮টি শহর ও অঞ্চলকে প্রথম কিস্তিতে নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ি জনপ্রিয় করে তোলার পরীক্ষামূলক শহর হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।
নতুন প্রস্তাব অনুসারে, ব্যাটারি সম্পূর্ণভাবে চার্জ করার পর ৮০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার যেতে পারে, এমন একটি বিদ্যুত্চালিত গাড়ির জন্য ৩৫ হাজার ইউয়ান পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হবে এবং ব্যাটারি সম্পূর্ণভাবে চার্জ করার পর ১৫০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার যেতে পারে, এমন একটি বিদ্যুত্চালিত গাড়ির জন্য ৫০ হাজার ইউয়ান পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়া হবে। কিন্তু বর্তমানে এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা সহজ নয়। বিদ্যুত্চালিত গাড়িশিল্পে কর্মরত ফেং ইয়েন চিয়ে বলেন, (রেকর্ডিং-৭)
"বিদ্যুত্চালিত গাড়ি এখন কেবল শহরাঞ্চলের রাস্তায় ব্যবহার করা যায়; তেলচালিত গাড়ির মতো এটি নিয়ে সারা দেশের নানা জায়গায় যাওয়া যায় না।"
প্রথম দফায় নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ি ব্যবহারের পরীক্ষামূলক শহরগুলোর অন্যতম হচ্ছে হাংচৌ। ২০১১ সালের প্রথম দিক থেকে বিদ্যুত্চালিত গাড়ি ট্যাক্সি খাতে ব্যবহার করা শুরু হয় এ শহরে। এখন হাংচৌয়ের নতুন জ্বালানি ট্যাক্সি লিমিটেড কোম্পানির ৫০০টি বিদ্যুত্চালিত ট্যাক্সি আছে। এ কোম্পানি হচ্ছে চীনে বৃহত্তম বিদ্যুত্চালিত ট্যাক্সি কোম্পানি।
হাংচৌতে বিদ্যুত্চালিত ট্যাক্সিগুলো ব্যাটারি বদলানোর স্টেশনে গিয়ে সরাসরি ব্যাটারি পরিবর্তন করতে পারে। ব্যাটারি পরিবর্তন করতে কর্মীদের মাত্র ৫ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু সমস্যা আছে এখানেও। ব্যাটারির চাহিদা সরবরাহের তুলনায় বেশি।
বিদ্যুত্চালিত ট্যাক্সি জনপ্রিয় করে তোলার কার্যক্রম শুরুর প্রথম দিকে ব্যাটারি বদলানো স্টেশনে যথেষ্ট পরিমাণ ব্যাটারি থাকতো। তবে সময়ের সাথে সাথে বিদ্যুত্চালিত ট্যাক্সির সংখ্যা বাড়লেও, ব্যাটারি বদলানোর জন্য স্টেশনের সংখ্যা তার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়েনি। ফলে দেখা দিয়েছে ব্যাটারির ঘাটতি। রাস্তায় ট্যাক্সিগুলো মাঝেমধ্যেই অচল হয়ে পড়ছে, ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে।
উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৩ সালের শেষ নাগাদ পর্যন্ত হাংচৌ বিদ্যুত্ সরবরাহ কোম্পানি মোট ৭২৩টি বিদ্যুত্চালিত গাড়ির জন্য মোট ৫ লাখ ৪০ হাজার বার ব্যাটারি পরিবর্তন করেছে। এ গাড়িগুলো মোট ৩ কোটি কিলোমিটার দূরত্ব চলেছে। প্রতিটি গাড়ি প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব চলেছে।
২০০৯ সাল থেকে চীন বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ি উত্পাদনকারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তবে প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে চীন এখনো গাড়ি উত্পাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দেশে পরিণত হতে পারেনি। আগামী দশ বছর চীনের গাড়ি বাজার অব্যাহতভাবে দ্রুত উন্নয়নের পর্যায়ে থাকবে। বিদ্যুত্চালিত গাড়ি খাত এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও, ভবিষ্যতে চীনের গাড়ি শিল্পে নেতৃত্ব করবে—এমন আশা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা। (ইয়ু/আলিম)
| ||||