Web bengali.cri.cn   
'চীনাদের চালের বাটি চীনাদের হাতেই রাখা উচিত'
  2014-08-12 17:54:20  cri

২০২০ সাল নাগাদ চীনের জনসংখ্যা ১৪১ কোটি হবে। এতো বিপুল মানুষের খাদ্যের সংস্থান করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ—এতে কোনো সন্দেহ নাই। আসলে, শতাধিক কোটি মানুষের এই দেশে নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যের সংস্থান করা বরাবরই সবচে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এবং এখনো আছে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত গত ১১ বছরে চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের অগ্রাধিকার তালিকার এক নম্বরে ছিল কৃষি। চলতি বছরেও কেন্দ্রীয় সরকার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিষয়টিকে সবচে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। সরকারের এ সংক্রান্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে, শিগগিরই দেশ গম ও ধান উত্পাদনের দিক দিয়ে মোটামুটি ১০০ শতাংশ আত্মনির্ভরশীল হবে। আর সার্বিকভাবে দেশ খাদ্যে ৯০ শতাংশ আত্মনির্ভরশীল হবে।

চীনের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে তা কেবল দেশটির দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য ভিত্তি স্থাপন করবে তা নয়, বরং সারা বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিশ্বে খাদ্যশস্যের উত্পাদন ৪৩ কোটি টন বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে চীনে খাদ্যশস্যের উত্পাদন বেড়েছে ১৩ কোটি ৪০ লাখ টন। অর্থাত, এ ক্ষেত্রে চীনের অবদান ৩১ শতাংশ।

২০১৩ সাল পর্যন্ত চীনে একটানা দশ বছর ধরে খাদ্য উত্পাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য ও সয়াবিনসহ সারা দেশে শস্য উত্পাদনের পরিমাণ ৬০ কোটি টন ছাড়িয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে একটি নতুন রেকর্ড। অবশ্য, এর পাশাপাশি চীনে খাদ্যশস্যের আমদানির পরিমাণও বেড়েছে। গত বছর চীন প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করেছে, যা ২০১২ সালের তুলনায় প্রায় ১০ লাখ টন বেশি।

খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি ও নগরায়নের সাথে পাল্লা দিয়ে চীনে খাদ্যশস্যের উত্পাদন অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাবে কি না, খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে কি না—এসব প্রশ্ন কেবল চীনাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা নয়, বরং গোটা বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণের বিষয়।

চীনের গ্রামাঞ্চলে অনেক কৃষক বাইরে গিয়ে কাজ করতে চায়, কিন্তু জমিতে কাজ করতে চায় না। দক্ষিণ চীনের কিছু খেতে কৃষকরা বছরে আগে যেখানে দু'বার চাষ করতো, সেখানে এখন একবার চাষ করছে।

গত শতাব্দীর ৮০'র দশকের প্রথম দিকে কৃষিক্ষেত্রে কৃষকদের সক্রিয়তা বাড়াতে চীন গ্রামাঞ্চলে পরিবারভিত্তিক যৌথ-উত্পাদন ব্যবস্থা সংস্কার করে।

সংস্কারের পর কৃষিজমিতে কৃষকদের সক্রিয়তা অভূতপূর্বভাবে বেড়েছে। খাদ্যশস্য উত্পাদনের পরিমাণও অনেক বেড়েছে। তবে ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে শহরে গিয়ে কাজ করা কৃষকদের জন্য একটি বিকল্পে পরিণত হয়। কৃষকরা শহরে যাওয়া শুরু করায় গ্রামাঞ্চলের কিছু আবাদি জমি অনাবাদি হয়ে যায়। তখন অন্য আগ্রহী কৃষক বা কৃষি সংস্থা এসব জমি ভাড়া করে চাষ করা শুরু করে।

প্রশ্ন হচ্ছে: ভবিষ্যতে কে জমি চাষ করবে? কৃষিব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে হেইলোংচিয়াং প্রদেশের সুইহুয়া শহরের মেয়র ওয়াং চিন হুই বলেন, "ভবিষ্যত কৃষিতে অবশ্যই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে এবং নতুন ধরণের বিশেষভাবে দক্ষ ও পেশাদার কৃষক তা চাষ করবে। তখন কৃষিশিল্পের কর্মী ও উত্পাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও বিক্রয়ের দায়িত্ব থাকবে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের হাতে। অল্পসংখ্যক লোক অধিকাংশ জমি চাষ করবে। অধিকাংশ লোক মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।"

উত্তর-পূর্ব চীনে অবস্থিত হেইলোংচিয়াং হচ্ছে চীনের সবচে বেশি খাদ্যশস্য উত্পাদক প্রদেশ। এ প্রদেশে চীনের মোট খাদ্যশস্যের ১০ শতাংশ উত্পাদিত হয়। ২০১৩ সালে হেইলোংচিয়াংয়ে উত্পাদিত খাদ্যশস্যের মোট পরিমাণ ছিল ৬০০০ কোটি কেজি। ২০০৭ সালের তুলনায় উত্পাদন বেড়েছে ৭৩ শতাংশ। ওয়াং চিন হুই বলেন, "ভবিষ্যতে বড় চাষী পরিবার ও পারিবারিক খামার উন্নত হবে; কৃষকদের নতুন নতুন সমবায় গঠিত হবে; নতুন ধরনের কৃষিপ্রধান সংস্থা প্রতিষ্ঠায় উত্সাহ দেওয়া হবে; প্রযুক্তিবিদরা চাষের দৃষ্টান্ত দেবেন। যেমন, ২০১৩ সালে সুইহুয়াতে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৪৩৯৫টি কৃষক সমবায়। জমি হস্তান্তরের হার ৫৫ শতাংশ। এখন পর্যন্ত এক-তৃতীয়াংশ কৃষক মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং এক-তৃতীয়াংশ কৃষকের নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে।"

ওয়াং চিন হুইয়ের কথিত 'কৃষক সমবায়' হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলে পরিবারভিত্তিক ঠিকা ব্যবস্থার ভিত্তিতে একই ধরণের কৃষিপণ্যের উত্পাদনকারী অথবা সংশ্লিষ্ট সেবার সরবরাহকারীদের দ্বারা গঠিত আর্থিক সংস্থা। 'কৃষক সমবায়' ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে, জমির মালিকানা কৃষকের হাত থেকে সমবায়ের অধীনে চলে যায়। এতে কৃষি উত্পাদন বাড়ে এবং কৃষিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।

এদিকে, চীন কঠোরভাবে আবাদি জমি রক্ষাব্যবস্থা কার্যকর করেছে। ২০০৯ সালে সরকার দেশে আবাদি জমির সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারণ করেছে ১২ কোটি হেক্টর। উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১২ সালের শেষ নাগাদ, চীনে মোট আবাদি জমি ছিল ১২ কোটি ৫০ লাখ হেক্টরেরও বেশি।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, আবাদি জমির মোট আয়তন এই নির্ধারিত সীমার নিচে না-নামলেই, ১২০ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে। তবে এ সীমা রক্ষা করা সহজ নয়। কারণ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ক্রমবর্ধমান হারে জমি চাই। ফলে, আবাদি জমি রক্ষায় চীন সরকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে।

চীনের কৃষিমন্ত্রী হান ছাং ফু বলেন, "চীন বিশ্বের দশ ভাগের এক ভাগ আবাদি জমি দিয়ে বিশ্বের এক চতুর্থাংশ খাদ্যশস্য উত্পাদন করে এবং বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশের অন্ন সংস্থান করে। এটা সম্ভব হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে এবং চীনা কৃষকদের কঠোর পরিশ্রমের ফলে। আমাদের আস্থা তিনটি ভিত্তির ওপর স্থাপিত। প্রথম হচ্ছে 'নীতি'। চীনের কেন্দ্রীয় সরকার খাদ্য উত্পাদন ও নিরাপত্তাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয় এবং এ ব্যাপারে সরকারের নিজস্ব নীতিগত অবস্থান আছে। দ্বিতীয় হচ্ছে 'বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি'। বর্তমানে কৃষিখাতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদানের হার ৫৫ শতাংশ এবং এ হার আরো বাড়বে। তৃতীয় হচ্ছে 'অবকাঠামো'। এখন আমাদের জলসেচের আওতায় থাকা জমির পরিমাণ ৫১ শতাংশ। বর্তমানে ৫৯ শতাংশ কৃষিকাজ করা হয় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে।"

একটানা দশ বছর ধরে খাদ্যশস্যের উত্পাদন বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি চীনে খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণও প্রতি বছর বেড়ে চলেছে। চীনের কৃষি ব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ সিয়াং সোং জো বলেন, (রেকর্ডিং-৭)

"আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গেলে বড় সমস্যায় পড়তে হবে। বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের কৃষি সংকুচিত হবে; বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি অব্যাহত থাকলে আমাদের কিছু পণ্যের উত্পাদন হ্রাস পাবে; এ খাতে আমাদের শিল্পের উন্নতি ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি থেমে যাবে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনিশ্চিত ও অস্থিতিশীল। যখন খাদ্যশস্যের দাম উঠানামা করবে, তখন সামাজিক সমস্যাও সৃষ্টি হবে।"

কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত চীনের কেন্দ্রীয় গ্রাম বিষয়ক সম্মেলনে চীন খাদ্যশস্যের নতুন নিরাপত্তাকৌশল উত্থাপন করেছে। আর এ কৌশলগত নীতি হচ্ছে: চীনের খাদ্যশস্যের নিরাপত্তার জন্য নিজের ওপর নির্ভর করতে হবে। কৃষিমন্ত্রী হান ছাং ফু বলেন, "চীনের ভেতরেই যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য উত্পাদন নিশ্চিত করতে হবে এবং আমদানি করতে হবে যতটুকু না-করলেই নয় ঠিক ততটুকু। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছেন, চীনাদের চালের বাটি চীনাদের হাতেই রাখতে হবে। আর আমাদের চালের বাটির মধ্যে সবচে বেশি থাকবে চীনে উত্পাদিত খাদ্যদ্রব্য।" (ইয়ু/আলিম)

মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040