চীনের মূলভূখণ্ডে বিনিয়োগকারী তাইওয়ানী ব্যবসায়ীরা মনে করেন, মূলভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে নিজেদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত একদম সঠিক।
তাইওয়ানের অ্যাডভানটেক কোম্পানি লিমিডেটের প্রধান ব্যবস্থাপক চেন সুন লাং ১৯৯৯ সালে প্রথম বারের মতো চিয়াংসু প্রদেশের খুনশান অর্থনৈতিক উন্নয়ন অঞ্চল পরিদর্শনের সময় সেখানে তাঁর কোম্পানির বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তি উত্পাদন-পার্ক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। খুনশানের আইনগত ও প্রশাসনিক পরিবেশ আর সরকারের ব্যবস্থাপনা চিন্তাধারা তাঁকে আকর্ষণ করে।
চেন সুন লাং বলেন, "প্রথম কারণ হচ্ছে শাংহাইয়ের হোংছিয়াও বিমানবন্দর থেকে খুনশানের দূরত্ব গাড়িতে মাত্র এক ঘন্টার। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে এখানকার সরকার প্রত্যয়ী, যা বলে তা করে। আমরা স্থানীয় অবস্থা না জানলেও অসুবিধা হয় না। কারণ স্থানীয় সরকার আইনগত ব্যবস্থাপনা করে। তা ছাড়া, স্থানীয় সরকার নানা উপায়ে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকে সহায়তা করে। সেকারণে আমরা খুনশান বাছাই করেছি।"
দশ-বারো বছর পর আজকে খুনশানে অ্যাডভানটেক কোম্পানির উত্পাদন-পার্ক অনবরত সম্প্রসারিত হচ্ছে। চেন সুন লাং এখানে বিশ্বের বৃহত্তম শিল্পজাত কম্পিউটারের নকশা ও উত্পাদনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছেন। এখন এ কোম্পানি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়াসহ ১৮টি দেশের ৩৯টি শহরে শাখা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছে এবং ৮০টিরও বেশি দেশে এর এজেন্ট আছে।
চীনের মূলভূখণ্ড হচ্ছে বিশ্বের ইলেকট্রনিক দ্রব্যের প্রথম বৃহত্ উত্পাদন-স্থান আর ভোগ্যপণ্য-বাজার। সুতরাং অ্যাডভানটেক কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বহু স্থানে বলেছেন, এ কোম্পানির লক্ষ্য হচ্ছে চীনের মূলভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বের বাজারে প্রবেশের প্রচেষ্টা চালানো। এটা এ কোম্পানির আন্তর্জাতিকীকরণ প্রক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এখন অ্যাডভানটেক কোম্পানির মোট ৫ হাজার কর্মী আছে। খুনশান উত্পাদন-পার্কে এর কর্মীর সংখ্যা ২ হাজার ৩ শ'রও বেশি।
খুনশান উত্পাদন-কেন্দ্রের কারখানা পরিদর্শনকালে দেখা যায় দুপুরবেলায় সেখানকার অনেক জায়গায় কর্মী নেই। চেন সুন লাং বলেন, দুপুরের খাবারের পর কর্মীদের যথাযথ বিশ্রামের সময় লাগে। অ্যাডভানটেক কোম্পানি কর্মীদের জন্য অত্যন্ত সুস্থ কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, "আমাদের ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি অন্য কারখানার মতো না। কাজের সময় আমরা যত্নের সাথে কর্মীদের দেখাশোনা করি। যেমন তাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা, কাজের পর তাদের আধ্যাত্মিক জীবন - আমরা সব বিবেচনা করি। প্রতি বছর আমরা বিভিন্ন অঞ্চলে কমপক্ষে বিশ থেকে ত্রিশটি পর্যটন দল পাঠাই। বিশেষ করে বসন্তকাল ও শরত্কাল প্রায় প্রতি সপ্তাহে আমাদের কর্মীদের নিয়ে গঠিত পর্যটক দল বিভিন্ন অঞ্চলে যায়।"
খুনশান অর্থনৈতিক উন্নয়ন অঞ্চলে তাইওয়ানী ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে। কেবল দু'তিন বছরের মধ্যে খুনশানে তাইওয়ানের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দু'-তিন হাজার থেকে বেড়ে বর্তমানে ৪ হাজার ২ শ' ৮৮টি হয়েছে।
তাইওয়ানের চাং সিন রবার গ্রুপের উত্পাদন ও গবেষণা-কেন্দ্রও খুনশানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চাং সিন গ্রুপের অধীনস্থ ম্যাক্সিস টায়ার হচ্ছে বর্তমানে বিশ্বের সেরা দশটি টায়ার ব্র্যান্ডের অন্যতম।
পণ্যের মান আর প্রতিযোগিতা-শক্তি ভালোভাবে নিশ্চিত করার জন্য চাং সিন রবার গ্রুপ খুনশানে এশিয়ার বৃহত্তম বিশ্বমানের পেশাগত টায়ার পরীক্ষা-রানওয়ে নির্মাণ করেছে। চাং সিন টায়ার চীন কোম্পানির মহাব্যবস্থাপকের বিশেষ সহকারী চেন ইয়াও দে বলেন, সুন্দরভাবে বিভিন্ন দেশের বাজারে প্রবেশের জন্য টায়ার-পরীক্ষা মাঠের নকশায় উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
চেন ইয়াও দে বলেন, "পরীক্ষা-মাঠ বিটুমিন দিয়ে তৈরি। তবে পিচঢালা রাস্তার সঙ্গে এর পার্থক্য আছে। যেমন এখানে জার্মানির এক্সপ্রেস সড়কপথের মতো পিচঢালা রাস্তা আছে। বেলজিয়ামের টালি দিয়ে তৈরি রাস্তা আছে। রাস্তা বসানোর সময় ভিন্ন কোণ, ভিন্ন দিক রাখা হয়েছে। বিশেষ করে রাস্তার মোড় পার হওয়ার জন্য বিশেষ নকশা করা হয়েছে।"
ম্যাক্সিস টায়ার দীর্ঘকাল ধরে জেনারেল মোটরস, পুজো (Peugeot), নিশান ও ছাংআন ফোর্ডসহ দেশি-বিদেশি বিখ্যাত মোটর কোম্পানিগুলোতে টায়ার সরবরাহ করে। বিশ্বের ২০ লাখ গাড়ি ম্যাক্সিস টায়ার কারখানায় উত্পাদিত টায়ার ব্যবহার করে।
মাক্সিস কোম্পানি মোটরগাড়ি, হালকা ট্রাক, সাইকেল, বালিয়াড়ি গাড়ি, ট্রেইলার আর ঘাসকাটা যন্ত্রসহ বিভিন্ন গাড়িতে ব্যবহৃত টায়ার উত্পাদন করে। এ কোম্পানির পণ্য বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হয়। বিশ্বে তার কর্মীর সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি।
প্রাকৃতিক সম্পদ, শ্রমশক্তি, প্রযুক্তি, অর্থ ও বাজারসহ নানা দিক থেকে তাইওয়ানের তুলনায় মূলভূখণ্ডের স্পষ্ট প্রাধান্য আছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১২ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত মূলভূখণ্ড তাইওয়ানী ব্যবসায়ীদের মোট ৮৭ হাজার ২৮টি প্রকল্পে অনুমোদন দিয়েছে, যেগুলোতে অর্থের সংশ্লিষ্টতা ৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। (ইয়ু/এসআর)
| ||||