

বাংলাদেশ ইকোনোমিস্ট ফোরাম-বিইএফ নামে অর্থনীতিবিদদের নতুন একটি সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়েছে শনিবার। এ উপলক্ষে দেশিবিদেশি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের নিয়ে দুদিনব্যাপী সম্মেলনের আয়োজন করে সংগঠনটি। 'ভিশন ২০৩০: বহুদলীয় গণতন্ত্রে অর্থনৈতিক নীতি ও কৌশল প্রণয়নের রূপরেখা' শীর্ষক সম্মলনটি শেষ হয় রোববার।
সম্মেলনে উদ্বোধনী অধিবেশন ও বিভিন্ন সেশনে অংশ নেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসীউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান, সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দীন আহমেদ, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ মাইকেল লিপটন, যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের মরগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক এম জি কিবরিয়া, বিশ্বব্যাংকের লিড অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাসান জামান, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি মহিউদ্দিন আলমগীর ও পলিসি রিসার্স ইন্সটিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ।
সম্মেলনে দেশিবিদেশি বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করেন। তুলে ধরেন সীমাবদ্ধতার কথাও। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে এবং একে এগিয়ে নিতে করণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন প্রস্তাব ও পরামর্শ তুলে ধরেন।
যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ মাইকেল লিপটন উদ্বোধনী অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে আশাব্যঞ্জক অভিহিত করে তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সমীহ করার মতো বিষয়। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ ভালো অগ্রগতি লাভ করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তবে, এখনো দেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ দরিদ্রদশায় রয়ে গেছে- একথাও স্মরণ করিয়ে দেন। কৃষি, খাদ্য এবং জন্মনিরোধে বাংলাদেশ সাফল্য উল্লেখযোগ্য বলে মনে করেন মাইকেল লিপটন। কারণ এ তিনটি বিষয় অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত। তবে, পুষ্টি এবং শিশু মৃত্যুহার রোধে বাংলাদেশকে আরো অনেক করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, প্রতিবছর এক শতাংশ হারে কৃষি জমে কমে যাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও অধিক জনসংখ্যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বড় অন্তরায়। এজন্য নতুন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলারও পরামর্শ দেন ব্রিটিশ এই অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, আমরা বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স আয় করলেও তা আমাদের কাছে বিনিয়োগযোগ্য মূলধন হিসেবে আসে না। অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য প্রবাসী বাংলাদেশীদের মেধাকেও পুঁজির মতো ব্যবহারে ওপর জোর দেন তিনি। অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
পলিসি রিসার্স ইন্সটিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ 'প্রবৃদ্ধির উৎসের সন্ধানে' এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি মহিউদ্দিন আলমগীর '২০৩০ সালকে সামনে রেখে মধ্য আয়ের ফাঁদ ও কর্মহীন প্রবৃদ্ধি এবং উত্তরণের উপায়' শীর্ষক প্রবন্ধে, সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অবকাঠামোর অভাবকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন। সাদিক আহমেদ তার প্রবন্ধে বলেন, ২০২১ সালের মধ্য মধ্য আয়ের দেশ হতে হলে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে আড়াই হাজার ডলার। প্রবৃদ্ধির বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে তা অর্জন সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি লাভ করলেও পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের তুলনায় তা অনেক কম। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ১৯৭৪ সালে মালয়েশিয়ার মাথাপিছু আয় যখন ৭০০ ডলার, দক্ষিণ কোরিয়ার ৪৮০ ডলার, চীনের ১৬০ ডলার তখন বাংলাদেশের ছিল ১০০ ডলার। ২০১২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ২২ হাজার ৬৭০ ডলারে, মালয়েশিয়ার ৯ হাজার ৮২০ ডলারে আর চীনের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৭২০ ডলারে। এসময়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় মাত্র ৮৪০ ডলারে। বাকি তিনটি দেশ উচ্চ ও মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। মূলধন পুঁঞ্জিভূত করতে না পারা, শিক্ষা ও দক্ষ শ্রমশক্তির ঘাটতিই অন্য দেশগুলো থেকে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার কারণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলদেশের আর্থিক খাত ভালভাবেই কাজ করছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার তদারকি কর্মকাণ্ড জোরদার করেছে। কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বরাবরের মতোই অগ্রাধিকার দিয়ে যাবে বলে জানান গভর্নর।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত দাবি করেন রাজনৈতিক অস্থিশীলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হচ্ছে। তবে বেসরকারি বিনিয়োগ নিয়ে বরাবরের মতোই হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি। কৃষিজমি রক্ষা ও যথাযথ ব্যবাহার নিশ্চিত করতে পারাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ বলে স্বীকার করেন অর্থমন্ত্রী। জানান, সরকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাকাকে সচল রাখতে মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দেবে।
মাহমুদ হাশিম, ঢাকা থেকে।

| ||||



