Web bengali.cri.cn   
দ্রুত বিকশিত হচ্ছে চীনের দ্রুতগতির রেলপথ ব্যবস্থা
  2014-05-26 18:59:49  cri


দ্রুত বিকশিত হচ্ছে চীনের দ্রুতগতির রেলপথ ব্যবস্থা। আর এর সাথে পাল্লা দিয়ে কমছে দেশটির এক স্থান থেকে অন্য স্থানের এবং এক শহর থেকে অন্য শহরের দূরত্ব। তা ছাড়া, বদলে যাচ্ছে জনগণের জীবনযাত্রাও।

২০১২ সালের ডিসেম্বরে রাজধানী পেইচিং থেকে কুয়াংচৌ পর্যন্ত ২২৯৮ কিলোমিটার দ্রুতগতির রেলপথ চালু হয়। এখন দ্রুতগতির ট্রেনে এই দুই শহরের মধ্যে যাতায়াত করতে মাত্র ৮ ঘন্টা সময় লাগে, যেখানে আগে সময় লাগতো প্রায় ৩০ ঘন্টা! আগে যারা বিমানে এ দুই শহরের মধ্যে যাতায়াত করতেন, তাদের অনেকেই এখন ট্রেনে আসা-যাওয়া করছেন। মাদাম লোংকে প্রায়শই পেইচিং ও কুয়াংচৌর মধ্যে যাতায়াত করতে হয়। তিনি এ প্রসঙ্গে বললেন, "বিমানে গেলে প্রথমে বিমান বন্দরে যেতে এক ঘন্টা সময় লাগে, তারপর বিমান বন্দরে এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়, বিমান আকাশে থাকে আরো আড়াই ঘন্টা। তারপর বিমান থেকে নেমে লাগেজ নিতে নিতেও বেশ খানিকটা সময় ব্যয় হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ছয়-সাত ঘন্টার মামলা। তাই, আমি এখন রেলপথেই যাতায়াত করতে পছন্দ করি। সময় প্রায় একই লাগে। রেলগাড়িতে সবসময় ফোনও ব্যবহার করা যায়।"

থিয়েনচিনে কর্মরত মি: শু'র বাড়ি শাংহাইতে। তিনি প্রায়ই শাংহাই–থিয়েনচিন যাতায়াত করেন। আগে শাংহাই যেতে তার ১৫ ঘন্টা সময় লাগতো। ২০১১ সালে পেইচিং থেকে শাংহাইগামী দ্রুতগতির ট্রেন চলাচল শুরু হবার পর থেকে তিনি মাত্র সাড়ে পাঁচ ঘন্টায় থিয়েনচিন থেকে শাংহাইয়ে যেতে পারছেন। তিনি বলেন, "এখন সময় আরো ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আবহাওয়া রেলগাড়ির চলাচলের ওপর তেমন প্রভাব ফেলে না। তা ছাড়া, বিমানের তুলনায় রেলগাড়িতে ভ্রমণ অধিক আরামদায়ক।"

চীনের প্রথম দ্রুতগতির রেলপথ হচ্ছে ১৯৯৯ সালে নির্মিত ছিনহুয়াংতাও থেকে শেনইয়াংগামী রেলপথ। ২০১৩ সালের শেষ নাগাদ পর্যন্ত চীনের দ্রুতগতি রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল ১১ হাজার ২৮ কিলোমিটার, যা বিশ্বের মোট দ্রুতগতির রেলপথের প্রায় অর্ধেক। বর্তমানে নতুন করে আরও ১২ হাজার কিলোমিটার দ্রুতগতির রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। চীনের দ্রুতগতির রেলপথে ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি পরীক্ষা করা হয়েছে ঘন্টায় ৪৮৬.‌১ কিলোমিটার। তবে, বাস্তবে এ গতি উঠেছে ঘন্টায় ৩৮০ কিলোমিটার।

চীনের যোগাযোগ ও পরিবহন সমিতির নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান ওয়াং দে রোং চীনে দ্রুতগতির রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিকশিত হওয়া দেখছেন খুব কাছ থেকে। গত শতাব্দীর ৮০'র দশক থেকে এ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত চীনের অর্থনীতি দ্রুত উন্নত হয়েছে। এ সময় সড়কপথ, নৌপথ আর বেসামরিক বিমান চলাচল দ্রুত বিকশিত হয়েছে; দ্রুতগতিতে এগিয়েছে অবকাঠামো নির্মাণকাজ। কিন্তু ওই সময়টায় রেলযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে খুবই মন্থর গতিতে। সেই সময়টায় চীনের রেলপথের দৈর্ঘ্য মাত্র ২২ হাজার ১০০ কিলোমিটার বৃদ্ধি পায়; এক্ষেত্রে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ১.৬৮ শতাংশ। ওয়াং দে রোং বলেন, "চীনের অর্থনীতি একদিকে দ্রুত উন্নত হয়েছে; টেকসই আর স্থিতিশীল হয়েছে এবং অন্যদিকে পরিবহন খাতে চাহিদা নিরন্তরভাবে বেড়েছে। কিন্তু এসময় রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আশঙ্কাজনকভাবে পিছিয়ে ছিল। ফলে, দেশের পরিবহন খাতের সার্বিক সামর্থ্য আশানুরূপ ছিল না। তাই, রেলযোগাযোগ খাতে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা ছিল একটি অনিবার্য ব্যাপার।"

চীন একটি জনবহুল দেশ। এখানে সম্পদ সীমিত। বেসামরিক বিমান চলাচল ব্যবস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের বিপুল পরিবহন-চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দেওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৫০ হাজার মানুষের জন্য একটি বিমান আছে। চীনে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য একটি বিমান তৈরি করলেও, প্রতি বছর ১৩০ কোটি টন অশোধিত তেল দরকার। কিন্তু চীনে অশোধিত তেলের প্রমাণিত মজুদের পরিমাণ মাত্র ২০ কোটি টন। তা ছাড়া, চীনের মধ্য-পূর্বাংশের শহরাঞ্চলে প্রতি বর্গকিলোমিটারে চার শতাধিক লোকের বাস। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব মাত্র ৩৬ জন। ফলে দ্রুতগতির রেলপথের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা ছাড়া চীনের সামনে বিকল্পও নেই।

ওয়াং দে রোং বলেন, "একেক দেশের পরিবহন ব্যবস্থা একেক রকম। রাষ্ট্রের চাহিদা, সামর্থ্য ও শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার ওপর এটি নির্ভর করে। এ কারণেই চীনের পরিবহন-ব্যবস্থা উন্নয়নের পদ্ধতি ইউরোপীয় বা আমেরিকান দেশগুলোর মতো হতে পারে না। দ্রুতগতির রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে চীনের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হয়েছে। এর ফলে দেশটির মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে বাকি বিশ্বের দূরত্ব প্রকারান্তরে কমে গেছে; যাতায়াতের ব্যয়ও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।"

২০০৪ সালের জানুয়ারিতে চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ প্রথম 'মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি রেলপথ নেটওয়ার্ক পরিকল্পনা' অনুমোদন দেয় এবং ঘোষণা করে যে, দেশে দ্রুতগতির ট্রেনের জন্য ১২ হাজার কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। তত্কালীন উপ-রেলমন্ত্রী ওয়াং চি কুও বলেছিলেন, চীনের দ্রুতগতির রেলপথ বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির ভিত্তিতে নির্মাণ করতে হবে; রেলপথ নির্মাণের প্রযুক্তিগত প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং দ্রুতগতির রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগাতে হবে।

চীনের রেলপথ গ্রুপের ১৫ ব্যুরোর উপ-প্রধান ব্যবস্থাপক সি চোং ওয়েই মনে করেন, বিদেশের উন্নত প্রযুক্তির ভিত্তিতে গবেষণা চালিয়ে চীনের বাস্তব অবস্থার সাথে মানানসই দ্রুতগতির রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তিনি সড়ক ও সেতু নির্মাণের উদাহরণ টেনে বলেন, "আমরা অনেক পরিশ্রম করেছি; নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছি। বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। উপযুক্ত সিমেন্টের জন্য আমরা জার্মান উপকরণ নিয়ে গবেষণা করে অবশেষে চীনের বাস্তব অবস্থার উপযোগী উপকরণ আবিষ্কার করেছি।"

আসলে সি চোং ওয়েই ও তাঁর প্রযুক্তিবিদরা যে সমস্যা মোকাবিলা করেছেন, তা চীনের দ্রুতগতির রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার গোটা প্রক্রিয়ার একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।

উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১০ সাল পর্যন্ত চীনের উহান থেকে কুয়াংচৌগামী রেলপথ নির্মাণের সময় ৯৪৬টি পেটেন্ট করা হয়েছে এবং ঘন্টায় ৩৫০ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম রেলগাড়ি, ইঞ্জিন এবং গতিরোধক ব্যবস্থাসহ নয়টি কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি ও দশটি আনুষঙ্গিক প্রযুক্তি আয়ত্ত করা হয়েছে।

চীনের রেলপথ গ্রুপের সেতু ব্যুরোর উপ-প্রধান ব্যবস্থাপক ওয়েন উ শোং বলেন, "আমরা চারটি প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছি। এগুলো হচ্ছে: নতুন উপকরণ, নতুন কাঠামো, নতুন সরঞ্জাম এবং নতুন শিল্পকৌশল। প্রতিটি সাফল্যের মেধাস্বত্ব আমাদের নিজের। এ পর্যন্ত আমরা সাতটি জাতীয় প্রযুক্তির জন্য পেটেন্ট আবেদন করেছি।"

দিন দিন বিকশিত হতে থাকা চীনের দ্রুতগতির রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা একদিকে যেমন চীনাদের জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে, তেমনি জাগিয়ে তুলছে বিদেশিদের আগ্রহও। এরই মধ্যে চীনের সাথে লাওস, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশের রেল খাতে সহযোগিতা-স্মারক বা চুক্তি হয়েছে। কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। চীন মিয়ানমার, পোল্যান্ড, ভারত ও মধ্য-এশীয় দেশগুলোর সাথে রেল খাতে সহযোগিতা করার ব্যাপারেও মতৈক্যে পৌঁছেছে। ২০১৩ সালের নভেম্বরে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খে ছিয়াং রোমানিয়ায় মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করার সময় হাঙ্গেরি ও সার্বিয়ার নেতাদের সঙ্গে দেশ দুটিতে রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। সে বছর ৪ থেকে ১১ মে পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী লি খে ছিয়াং ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা ও কেনিয়া সফর করার সময় চীনের সাথে নাইজেরিয়ার পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সে চুক্তির আওতায় দেশটির উপকূলীয় রেলপথ নির্মাণ-কাঠামো নির্মিত হবে। এ চুক্তির আর্থিক মূল্য ১৩১০ কোটি মার্কিন ডলার। সে সময় লি খে ছিয়াং বলেছিলেন, চীন আফ্রিকায় দ্রুতগতির রেলপথ গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবে এবং আধুনিক দ্রুতগতির রেলপথ নির্মাণ প্রযুক্তি আফ্রিকান জনগণের সঙ্গে ভাগাভাগি করবে। (ইয়ু/আলিম)

মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040