Web bengali.cri.cn   
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে দুর্ঘটনার প্রভাব
  2012-11-30 15:28:02  cri

সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেল তার রেশ এখনো চলছে এবং চলবে আরো অনেক দিন। রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে আশুলিয়ায় স্মরণকালের এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১১০ জন প্রাণ হারিয়েছে এবং আহত হয়েছে বহু শ্রমিক।এ ঘটনা নাড়া দিয়েছে যেমন গোটা জাতিকে, তেমনি তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক ক্রেতা এবং শ্রমিক অধিকার সংগঠন ও কর্মীদেরও। তাজরীন ফ্যাশনস নামের কারখানার ঘটনাটি এবং একই সময় ঘটে যাওয়া আরো কয়েকটি কারখানা-অগ্নিকাণ্ড সবাইকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশে কল-কারখানার শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র-নিরাপত্তা পরিস্থিতি কী।আশুলিয়ার ঘটনার তিন দিনের মধ্যে গাজীপুরের আরেকটি তৈরি পোশাক কারখানা এবং নারায়ণগঞ্জে একটি সাবান কারখানায় আগুন লাগে, যদিও ওই দুটি ঘটনায় কারোর প্রাণ যায় নি – মূলত আশুলিয়ার ঘটনা থেকে সৃষ্ট চাপের কারণে সময়োচিত এবং অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে।সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, তাজরীন ফ্যাশনসের ঘটনায় যদি যথোপযুক্ত ব্যাবস্থা নেওয়া যেত তাহলে প্রাণহানি অনেক কমানো যেত।তাই এ সম্পর্কিত সব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন কারখানার নিরাপত্তা ইস্যুটি। পাশাপাশি আছে এ ভয়াবহ ঘটনার জের হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের বাজার হারানোর শঙ্কা।

বাংলাদেশে কোনো শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে হলে কারখানা নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট আইনের বিধান প্রতিপালন করতে হয়।এর পর রয়েছে আন্তর্জাতিক পোশাক আমদানিকারকদের নিজস্ব কারখানা-নিরাপত্তা মান। তাদের কাছে পোশাক বিক্রি করতে চাইলে সে নিরাপত্তা মান বজায় রাখতে হয় কারখানায়। কিন্তু অন্য সবখানের মতো এখানেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। দুর্ঘটনাকবলিত কারখানার শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই কারখানায় শ্রমবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত হয়নি। ন্যূনতম কমপ্লায়েন্স মানা হলে একটি মৃত্যুও হতো না। কারখানার সিঁড়িগুলো বিকল্প সিঁড়ি নয়। আর জানালাগুলো বাইরের দিকে গ্রিল দিয়ে বন্ধ রাখা হয়। ধোঁয়ার কারণে অনেক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ধোঁয়া থেকে শ্রমিকদের দুই ঘণ্টা বাঁচানো সম্ভব হলে হয়তো এত মৃত্যু হতো না।

কারখানার শ্রমিকরা বলছেন, দুর্ঘটনার সময় সেটির সব গেট বন্ধ ছিল। অথচ কারখানা আইনে বিধান আছে কাজ চলা অবস্থায় কারখানার গেট বন্ধ করা যাবে না।

কারখানাটির কর্মী সৈয়দ আশরাফুল জামান বলেন, তিনি পাঁচতলায় কাজ করছিলেন। ধোঁয়ার গন্ধ পাওয়ার পর শ্রমিকরা উৎপাদন ব্যবস্থাপক জানান। কিন্তু উত্পাদন ব্যবস্থাপক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো শ্রমিকদের গালিগালাজ করে বসে কাজ করতে বলেন। এর দুই-তিন মিনিটের মধ্যে ধোঁয়ায় সারা ঘর ভরে যায়। শ্রমিকরা চিত্কার-হাহাকার শুরু করেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, কেন তাদেরকে সময়মতো বের হতে দেওয়া হলো না?

একইভাবে আগুন লাগার পর কারখানা ব্যবস্থাপকও তাঁদের বের হতে না দিয়ে বরং গালিগালাজ করেন বলে অভিযোগ করেছেন শ্রমিকরা। আরেক শ্রমিক মাহবুব আলম বলেন, যখন কোনো বিপদ আসে, বিশেষ করে আগুন লাগে, তখন কর্মকর্তারা শ্রমিকদের বেরিয়ে আসতে বাধা দেন। কারখানার ভেতরে ঢুকলে মনে হয় শ্রমিকরা কয়েদি।

কারখানার নারী শ্রমিক রোকেয়া বেগম বলেন, জীবনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে তারা কাজ করেন। শ্রমিক অধিকার কর্মীরা বলছেন, তাজরীন ফ্যাশনসের ঘটনা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটা হত্যাকাণ্ডের মধ্যে পড়ে। গোডাউন বানিয়ে শ্রমিক মারা হয়েছে।

তবে দুর্ঘটনাকবলিত কারখানার মালিকরা এখন দুর্ঘটনার দায় চাপাচ্ছেন কর্মচারীদের ওপর যারা কারখানার গেটে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন বলে বলা হচ্ছে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটা পত্রিকাকে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আগুন লাগার পর শ্রমিকেরা যখন বের হতে চাইছিলেন, তখন কয়েকজন কর্মকর্তা তাঁদের বাধা দেন বলে অনেকের বক্তব্যে এসেছে। এ কারণেই এত প্রাণহানি হয়েছে। কাজেই যাঁরা বাধা দিয়েছিলেন, তাঁদের বিচার হওয়া উচিত।

এভাবে তার দায়মুক্তির চেষ্টার বিরোধিতা করেছেন শ্রমিক এবং শ্রমিক অধিকারকর্মীরা। তারা মালিকের বিচার চেয়ে গ্রেপ্তার দাবি করেছেন। অধিকারকর্মী নাজমা আক্তার বলেন, অগ্নিকাণ্ডের সময় মধ্যম পর্যায়ের যে কর্মকর্তারা শ্রমিকদের বেরিয়ে আসতে বাধা দেন তারা কি মালিকপক্ষের বাইরে?

দুর্ঘটনার প্রভাব

এ দুর্ঘটনার পর জল্পনা-কল্পনা চলছে – তৈরি পোশাক খাতের ক্রেতারা এ ঘটনার পর কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে এবং খাতের ওপর কী প্রভাব পড়বে। দেশের বিশেষজ্ঞ ও শ্রম অধিকারকর্মীরা সতর্ক সংকেত দিয়েছেন শ্রমিকদের অধিকার অস্বীকার করে, কারখানাকে মৃত্যুকূপ বানিয়ে রেখে আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখা যাবে না।

অনেকে অবশ্য বলছেন, ভস্মীভূত কারখানার সঙ্গে সম্পর্ক আছে - কেবল এ কারণে আমেরিকার ক্রেতারা এখনই ওয়ালমার্টে কেনাকাটা বন্ধ করবে, এমন আশঙ্কা নেই। বড় বড় খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশের মতো সস্তা উত্স সহজে হাতছাড়া করতে চাইবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প ও শ্রম সম্পর্কের অধ্যাপক জেমস গ্রস রয়র্টার্সকে বলছিলেন, বেশির ভাগ মানুষই দরকষাকষি পছন্দ করে। কোন পণ্য, কারা, কিভাবে তৈরি করেছে, এসব পণ্য কেনা উচিত কি না- এসব ভাবার সময় বা ইচ্ছা তাদের নেই।

নিউ ইয়র্কভিত্তিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিনারজিস ওয়ার্ল্ডওয়াইডের কর্ণধার মুনির মাশুকুল্লাহ বলেন, এসব বাজারে ক্রেতাদের মানসিকতা হচ্ছে বেশি দাম না দেওয়া। সে কারণে আমদানিকারকরাও খরচ কমানোর রাস্তা খোঁজে। পশ্চিমা খুচরা বিক্রেতা এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের প্রস্তুতকারীদের সঙ্গে ব্যবসা করে মুনিরের প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, যদি ক্রেতারা বেশি দাম না দিতে চায়, কম্পানিগুলোও পণ্য উৎপাদনে বেশি খরচ করবে না।

তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিক নিহত হওয়ার পরপরই বিশ্বের অন্যতম বৃহত্ ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট সমালোচনার মুখে পড়েছে। বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠানটি ওই কারখানা থেকে পোশাক আমদানি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্য এ নিষেধাজ্ঞা হয়তো খুব বেশি দিন বহাল থাকবে না। বাংলাদেশের হা-মীম গ্রুপে ২০১০ সালে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের পর তাদের ক্রেতা গ্যাপও একই ধরনের ঘোষণা দিয়েছিল। এর পরও গ্যাপ ওই কারখানা থেকেই পোশাক আমদানি করেছে। ওয়ালমার্ট তাজরীন ফ্যাশনস থেকে পোশাক না নেওয়ার কথা বললেও অন্য কারখানা থেকে যে নেবে না, তা বলেনি।

পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলছিলেন, কোনো আমদানিকারকই বাংলাদেশে চ্যারিটি করতে আসে না। বাংলাদেশ থেকে পোশাক না নিলে তাদের শেলফে মাল যাবে কোথা থেকে? তারা কী বিক্রি করবে?

তবে এতে নির্ভার থাকার সুযোগও নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আমেরিকা ও ইউরোপের সামাজিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো খুব শক্তিশালী, যারা পোশাক আমদানিকারকদের ওপর চাপ রাখবে কর্মপরিবেশ ভাল নয় এমন কারখানা থেকে পোশাক আমদানি বন্ধ করতে। আর তাদের মতামত উপেক্ষা করা তাদের পক্ষে কঠিন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রেতারা এসব দুর্ঘটনার স্মৃতি ভুলে গেলেও শ্রমিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো ভোলে না। বাংলাদেশে এ ধরনের সংগঠনের কথা সরকার বা ব্যবসায়ীরা শোনে না। তবে ইউরোপ ও আমেরিকায় এ ধরনের সংগঠনগুলো বেশ সোচ্চার ও প্রভাবশালী। তাদের কথায় প্রভাবিত হয় সরকার; কেবল একটি সংগঠনের আপত্তির কারণে ছয় বছর ধরে ঝুলে আছে আমেরিকায় বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সম্ভাবনা।

জানা গেছে, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনার উন্নয়নসহ বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর কাজের পরিবেশ ভালো করার জন্য মালিকদের ওপর বারবার চাপ দিচ্ছে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য পয়সাও খরচ করছে তারা। হা-মীম গ্রুপে অগ্নিকাণ্ডের পর গার্মেন্টে অগ্নিনির্বাপণসহ কর্মক্ষেত্র উন্নয়নে 'গ্যাপ' ১০০ কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বখ্যাত ১৯টি ফ্যাশন ব্র্যান্ড সম্মিলিত উদ্যোগে শ্রমিকদের জন্য 'আর নয় আগুন' ব্যবস্থাপকদের জন্য 'এখনই সময়' নামে অগ্নি নিরাপত্তা-বিষয়ক দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে দিয়েছে। গ্যাপ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ববি সিলড্রেন সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদেরের সঙ্গে দেখা করে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ এবং এ জন্য কারিগরি সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন।

তবে এসব ব্যবস্থা ও উদ্যোগ শুধু নেওয়ার জন্য নিলেই হবে না। বাস্তবিক পক্ষেই কাজ করতে হবে পোশাক শিল্পে দুর্ঘটনা রোধ এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য। কারণ বাজার ধরে রাখার জন্য কারখানার পরিবেশ উন্নত করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আর সেজন্য সরকার ও পোশাক মালিকদের একযোগে কাজ করতে হবে। কারণ নিজস্ব ক্রেতাদের অনবরত চাপ, শ্রমিক সংগঠন ও গণমাধ্যমের সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের সুনাম রক্ষা জন্য বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশের বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো দেশের ওপর যদি নিজেদেরকে নির্ভর ফেলে তখন বাংলাদেশের আর যাওয়ার জায়গা থাকবে না। (এসআর)

মন্তব্য
লিঙ্ক