ছখাওতি বাদশার কিচ্ছা
একদেশে ছিলেন এক বাদশাহ। তার নাম ছখাওতি বাদশাহ। তিনি যেমন ছিলেন ধন সম্পদের বাদশা তেমনি ছিলেন একজন প্রজাহিতৈশী দানশীল বাদশা। তার বিখ্যাত প্রাসাদের সুরম্য অট্টালিকাতে ছিল বিরাট আকারের এক মেহমান খানা। যেখানে প্রতিদিন নানা দূর দূরান্ত থেকে আসা অসংখ্য মুসাফির, অভাবী মানুষ এসে খাওয়া দাওয়া করতো, আপ্যায়ন গ্রহণ করতো আর নয়নাভিরাম মুসাফির খানায় রাত যাপন করত। বাদশা এমনই প্রজা বাত্সল যে, তার রাজ্যের একটি মানুষও মেহমান খানায় এসে যেন খাওয়া দাওয়া না করে ফিরে যেতে পারে অথবা কোনো প্রজা অতৃপ্তি নিয়ে যেন ফিরে যেতে না পারে, তার জন্য মন্ত্রী আর রাজ পরিষদদের বিশেষ ভাবে নির্দেশ প্রদান করেন। এভাবেই সুখে শান্তিতে রাজ্য আর প্রজা সাধারনের মঙ্গলসাধন করেই দিনযাপন করতে থাকেন এ রাজ্যের অতি জনপ্রিয় ছখাওতি বাদশা।
কিন্তু একদিন প্রাসাদের মেহমান খানায় দুই ব্যক্তি আসে এবং তারা সেখানেই বসে থাকে। তারা কোনো খাওয়া দাওয়াও করে না, তাদের একটাই কথা তারা কেবল বাদশাহের সাথে দেখা করতে চায়। এই অবস্থায় মেহমান খানার খাদেম চলে যায় বাদশাহের কাছে-
খাদেম: হুজুর দু'জন ব্যক্তি আপনার কাছে এসেছে, তারা আপনার সাক্ষাত লাভ করতে চায়।
বাদশাহ: খাদেম আমি এখন একটি কাজে ব্যস্ত আছি, তুমি তাদেরকে খানাদানা দিয়ে ভাল ভাবে আপ্যায়ন কর।
খাদেম: হুজুর আমি তা করেছি, কিন্তু তারা কিছু্ই খাচ্ছে না। কেবল চুপ করে বসে আছে।
বাদশাহ: তাহলে তুমি তাদের বেশকিছু টাকা পয়সা দাও আর জিজ্ঞাসা কর বিশেষ কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে কিনা, তাহলে তাও দিয়ে দাও।
খাদেম: হুজুর আমিতো পূর্বেই এ সব চেষ্টা করেছি। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করেছি তারা কে, কোথা থেকে এসেছে। কিন্তু তারা কোনো কথার উত্তর না দিয়ে কেবল চুপ করে থাকে। শুধু বললো তাদের কোনো ঘরবাড়ি নাই, তারা মসজিদ বা সুবিধামত যেকোনো স্থানে রাত কাটায়। তারা এখানে টাকা পয়সা ধন দৌলতের জন্যও আসে নাই। হুজুর, তাদের প্রয়োজন বলতে একটিই চাওয়া যে, তারা আপনারই সাক্ষাত লাভ করতে চায়। তারা আপনার সাথে দেখা না করে কোথাও যাবে না।
বাদশাহ: ঠিক আছে খাদেম, তাহলে যাও তাদেরকে আমার সভা কক্ষে গিয়ে অপেক্ষা করতে বল। আমি দ্রুতই সেখানে যাচ্ছি।
এই কথা বলে বাদশাহ চলে গেলেন সভা কক্ষে দেখলেন বেশ শুভ্র গায়ের রঙের দুইজন লোক বসে আছে। বাদশাহকে দেখা মাত্র উঠে দাড়াঁলেন আর কুর্নিশ করলেন। বাদশাও তাদের সম্মান গ্রহন করে বিনীত ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন-
বাদশাহ: খাদেমের কাছ থেকে শুনেছি যে আপনারা মেহমান খানার কোনো খানাপিনা, আপ্যায়ন গ্রহণ করেন নি এমনকি অর্থ প্রদান করতে চাইলে তাও গ্রহণ করেন নি। শুধু আমার সাথেই দেখা করতে চেয়েছেন। আমিই সেই বাদশাহ যার সাথে আপনারা দেখা করতে চেয়েছিলেন। বলুন তা হলে কি ভাবে আপনাদের খেদমত করতে পারি।
লোক: বাদশাহ হুজুর আপনি যে দয়ালু, দানশীল তাহা দেশে সকল মানুষ জানেন। তাই আমরা এসেছি আপনার নিকট হতে দুইটা জিনিষের যেকোনো একটি জিনিষ নিতে।
বাদশাহ: বলুন, কোন দুইটা জিনিষের একটি জিনিষ আপনারা আমার কাছ থেকে নিতে চান?
লোক: হুজুর আমরা যেটা চাই সেটি হচ্ছে আপনার অতি প্রিয় সিংহাসন নতুবা যে ভাগ্য নিয়ে আপনি জন্মগ্রহণ করেছেন সেই ভাগ্য। এই দুটি জিনিষের যেকোনো একটি আমরা চাই।
বাদশাহ: কি বলছেন আপনারা? তা কি করে হয়? কিন্তু আমিতো কখনো কাউকে খালি হাতে ফিরে যেতেও দেইনি কখনো। দাঁড়ান আমাকে খানিকটা ভাবতে দিন আপনারা। (এরা হয় উন্মাদ না হয় বিশেষ ক্ষমতাশালী কেউ হবেন যারা আমাকে নিশ্চয়ই পরীক্ষা করতে এখানে এসেছেন। কিন্তু কি দিতে পারি আমি তাদের। যে ভাগ্যগুণে আজ আমি বাদশাহ, রাজ্যের প্রজাদের খেদমত করার সুযোগ পেয়েছি তাতো কখনোই দিতে পারিনা। তবে এই ক্ষমতা, সিংহাসন যদি না থাকে তাহলে প্রজাদেরই বা কি হবে। আবার যদি ভাগ্যেই না থাকে তবে তো সিংহাসনও হারাতে পারি, ঠিক আছে।) শুনুন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমার ভাগ্যকে কোনোমতেই কাউকে দিতে পারি না। তবে আমার সিংহাসন নিতে পারেন। আমার ধন দৌলত যা কিছু আছে তার এবং সিংহদ্বারের চাবি এখানে আছে এই নিন। আর আমি কি অল্প কিছু অর্থ সাথে নিতে পারি?
লোক: অবশ্যই আপনি সকল ধন আর অর্থ সাথে নিয়ে যেতে পারেন। আমাদের এসবের কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই।
বাদশাহ: না না তা আমি নিতে পারি না। কারণ তাহলে এই দেশ চলবে কি করে। প্রজাদের উপর মহা দুর্যোগ নেমে আসবে। আমি বরং সামান্য প্রয়োজনীয় কিছু অর্থ নিয়ে যাই।
এই বলে বাদশাহ রাজ্য সিংহাসন ছেড়ে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে বের হয়ে আসলেন। যাবার মুহূর্তে তিনি রাজ নাকাড়া বাজিয়ে সকল মানুষদের জড়ো করে ঘোষণা করে দিলেন যে, আজ থেকে আর আমি বাদশা নই, এই যে দুজন ব্যক্তিকে দেখছেন এরা এই রাজ্যের বাদশাহ হয়ে আপনাদের খেদমত করবে। লি: এই কথা শুনে সকল প্রজা হায় হায় করে উঠলো। আপনি আমাদের এতিম করে রেখে চলে যাবেন না। বাদশাও আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। তিনি শুধু একটি কথাই বললেন, আমার যে আর কোনো উপায় নেই, আমাকে যে যেতেই হবে। এই কথা বলে বাদশাহ তার রানীর হাত ধরে সোজা উত্তর দিকে রওনা হলেন। আর পশ্চাতে প্রজাদের কান্নায় আকাশ বাতাস যেন ভারি হয়ে উঠলো। কিছু দূর যাবার পর লোক দুইজন এসে বাদশাহের সামনে দাঁড়ালো-
লোক: হুজুর, হুজুর আমাদের ক্ষমা করবেন, আমরা আসলে মানুষ নই। আল্লাহ তালা আমাদের আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তালা আপনার পরীক্ষা নিতে চেয়েছিলেন। আসলে আপনি সত্যিই আল্লার পছন্দের বাদশাহ, এই দুনিয়ার বাদশা। এই নিন আপনার প্রাসাদের চাবি। আমাদের ক্ষমা করবেন, এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে কেনো আমরা কিছুই খাইনি বা অর্থ গ্রহণ করিনি। আজ থেকে চিরদিন আপনি এ রাজ্যের বাদশাহ।আমরা তাহলে আসি।
এই বলে দুই ফেরেস্তা চলে গেল আর বাদশাহ প্রাসাদে ফিরে গেলে রাজ্যজুড়ে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। সবাই বুঝলো এটা আল্লাহতালার একটি পরীক্ষা। কিন্তু বর্তমান যুগে কোনো বাদশাহ কি এইরূপ পরীক্ষা দিবেন? (ইয়ু / লিপন)
| ||||