চীনের গাড়ি শিল্পের আসল দ্রুত উন্নয়ন শুরু হয়েছে গত শতাব্দীতে চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের পর থেকে। তখন চীন আমদানি নীতির সাহায্যে গাড়ি শিল্পের উল্লম্ফন উন্নয়ন বয়ে এনেছে। অনুমান করা হচ্ছে, ২০১২ সালে চীনের গাড়ি বিক্রির পরিমাণ ২ কোটি হবে। সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের প্রথম দিকে অর্থাত্ ১৯৭৮ সালে চীনে উত্পাদিত গাড়ির বার্ষিক পরিমাণ ছিল মাত্র ১ লাখ ৪৫ হাজারটি। উপাত্ত অনুযায়ী, ১৯৯২ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত - এ দশ বছরে চীনের গাড়ি উত্পাদনে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৫ শতাংশ। এটা হচ্ছে একই সময়ে বিশ্বের গাড়ি উত্পাদন পরিমাণের প্রবৃদ্ধি হারের দশ গুণ।
চীনের গাড়ি শিল্প সমিতির উপাত্ত অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চীনের স্বতন্ত্র ট্রেডমার্ক গাড়ি রপ্তানি হয়েছে ৮ লাখ ৭০ হাজারটি। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে তা ২৭.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনের গাড়ি শিল্প সমিতির মহাসচিব তোং ইয়াং বলেন, ২০১২ সালে চীনের গাড়ি রপ্তানির পরিমাণ ১০ লাখেরও বেশি হবে।
চীনের গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি বাজারে প্রবেশের প্রক্রিয়ায় গাড়ি রপ্তানি করার পাশাপাশি বিদেশে কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছে, বিক্রয় ও মেরামত নেটওয়ার্ক স্থাপন করেছে এবং বিদেশের বিখ্যাত ট্রেডমার্কের সঙ্গে একীভূত হয়েছে ও অধিগ্রহণ করেছে। চিলি হচ্ছে এ সব চীনা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম।
২০১০ সালের আগস্টে চীনের গাড়ি নির্মাতা চিলি ১৮০ কোটি মার্কিন ডলারে ফোর্ড কোম্পানির কাছ থেকে বিশ্ববিখ্যাত গাড়ি ট্রেডমার্ক ভলভো অধিগ্রহণ করে। এ খবর অবিলম্বে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কেন ভলভোকে অধিগ্রহণ করেছে, এর কারণ প্রসঙ্গে চিলি গোষ্ঠির বোর্ড চেয়ারম্যান লি শু ফু বলেন, "বিশ্বায়নের পটভূমিতে চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পৃথিবীতে নিজেদের ভাবমূর্তি, মর্যাদা আর বাস্তব প্রতিযোগিতা শক্তি সঠিকভাবে বুঝতে হবে। চীনের গাড়ি নির্মাতাদের সামনে দুটি কঠিন সমস্যা আছে। একটা হলো মেধাস্বত্ব। আরেকটা হলো ট্রেডমার্ক। অর্থাত্ গুণগত মান ভালো হলেও অন্যরা তা স্বীকার করে না। এ দুটি সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যাবে? এক উপায় হচ্ছে একটু একটু কাজ করে ২০ বছর পর হয়তো অন্যরা তাদের চিনতে পারবে। আরেকটা উপায় হচ্ছে চিলি যেরকম করেছে, সেরকম বিশ্ববিশ্রুত ও প্রভাবশালী গাড়ি কোম্পানি কিনে ফেলা।"
ভলভো কেনার আগে চিলি ব্রিটেনের একটি পুরনো ট্যাক্সি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান - ম্যাঙ্গানিজ ব্রোঞ্জ কোম্পানি আর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গিয়ারবক্স উত্পাদন প্রতিষ্ঠান - ডিএসআই কোম্পানি কেনে। এসব কাজ ছিল ভলভো কেনার প্রস্তুতিমূলক কাজ। কিন্তু ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতিষ্ঠিত এ বেসরকারি গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ভলভো কেনার মধ্য দিয়ে কী কী পেয়েছে? এর উত্তরে লি শু ফু বলেন, "এক শ শতাংশ শেয়ারের অধিকার, ট্রেডমার্কের অধিকার, মেধাস্বত্ব, স্বত্বাধিকার, ১০৯৬৩টি কৃতিস্বত্ব, দশ বারোটি টেকসই উন্নয়নশীল পণ্য আর পণ্য উত্পাদনের প্লাটফর্ম, ৫ লাখ গাড়ি উত্পাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সম্পূর্ণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ইঞ্জিন কোম্পানি, তিনটি গাড়ির খুরচা যন্ত্রাংশ কোম্পানি, ৩৮০০ জনেরও বেশি গবেষণা প্রকৌশলী আর ১০০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে থাকা ২৩২৫টি বিক্রয় ও মেরামত জাল।"
আসলে চিলিই বিদেশি গাড়ি কোম্পানি অধিগ্রহণ করা প্রথম চীনা কোম্পানি নয়। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত চীনের স্বতন্ত্র ট্রেডমার্ক চেরি ২০০১ সাল থেকে বিদেশে যাওয়ার কৌশল গ্রহণ করে। সেই বছর চেরির মোটরগাড়ি প্রথম বারের মতো সিরিয়ায় রপ্তানি হয়। চেরি কোম্পানির মুখপাত্র চিন ঈ বো তাদের প্রথম গাড়ি রপ্তানির কথা স্মরণ করে বলেন, "২০০১ সালে আমরা সবেমাত্র চীনে গাড়ি বিক্রি শুরু করি। তখন একজন সিরীয় ব্যবসায়ী আমাদের গাড়ি পছন্দ করেন। তিনি আমাদের গাড়ি সিরিয়ায় আমদানি করতে চান। তখন আমাদের বিদেশে রপ্তানির ইচ্ছাও ছিলো না। কারণ আমাদের গাড়ি চীনের মূলভূখণ্ডে খুব ভালো বিক্রি হচ্ছিল। কেন বিদেশে রপ্তানি করবো? কিন্তু সে ব্যবসায়ী কেনার খুব আগ্রহ দেখান। তিনি প্রথমে দশটি গাড়ি নিয়ে যান। সে দশটি গাড়ি সিরিয়া পৌঁছানোর পর তিনি আবার ২০০টি গাড়ি কেনার ফরমায়েশ দেন।"
সিরিয়ায় প্রবেশের মধ্য দিয়ে চেরি গাড়ি মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে প্রবেশ করে, তারপর আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রবেশ করে। দশ বছরের মধ্যে চেরি প্রায় সব নবোদিত দেশের বাজারে প্রবেশ করে। ২০১২ সালের প্রথমার্ধে চেরি গাড়ির রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১ লাখ।
২০০৫ সালে চেরি গাড়ি মিশরে প্রবেশ করেছে এবং মিশরে তার উত্পাদনের কেন্দ্র স্থাপন করে। চেরি গাড়ির ৪৫ শতাংশ খুচরা যন্ত্রাংশ চীনের তৈরি। এখন কায়রোর চারদিকে চেরি ট্রেডমার্কের ট্যাক্সি দেখা যায়।
কায়রোয় একজন ট্যাক্সি চালক বলেন, "আমি দেড় বছর ধরে চেরি গাড়ি চালাচ্ছি। আমি মনে করি, এ গাড়ি দ্রুতগতিতে চালালেও সবসময় স্থিতিশীল থাকে। তেমন উঠানামা হয় না। যাত্রীরা খুব সন্তুষ্টু।"
২০১১ সালে চেরি কোম্পানির সবচেয়ে বড় বিদেশি কারখানা - ব্রাজিলের কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এ কারখানায় মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৪০ কোটি মার্কিন ডলার। অনুমান করা হচ্ছে, ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে গাড়ি এ কারখানায় উত্পাদন শুরু হবে। এ কারখানায় প্রতি বছর দেড় লাখ গাড়ি উত্পাদন করা যাবে। এটা হচ্ছে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত চেরির ১৬তম উত্পাদন কেন্দ্র।
চেরি কোম্পানির মুখপাত্র চিন ঈ বো বলেন, "গাড়ি রপ্তানি করলে পরিবহণ ব্যয়ের সমস্যা, শুল্ক সমস্যা, রপ্তানিকারক দেশের গাড়ি শিল্পের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সমস্যাসহ নানা সমস্যা সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু বিদেশে কারখানা প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে এ সব সমস্যার সমাধান হয়েছে। ফলে ওই সব দেশ আমাদেরকে সমর্থন করে এবং স্বাগত জানায়। যেমন ব্রাজিল সরকারের সমর্থনেই সেখানে আমাদের কারখানা এতো দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।"
চীনের আরেকটি স্বতন্ত্র ট্রেডমার্ক হুয়াথাই গাড়ি ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাত্র ১২ বছরের উন্নয়নের পর এ কোম্পানি এখন বছরে ৩ লাখ দূষণমুক্ত ডিজেল ইঞ্জিন, ৪ লাখ স্বয়ংক্রিয় ট্র্যান্সমিশন এবং দেড় লাখ মোটরগাড়ি উত্পাদনে সক্ষম। হুয়াথাই গাড়ি মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ, রাশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আর দক্ষিণ আমেরিকার বাজারকে তার প্রধান বিদেশি বাজার মনে করে এবং এ সব অঞ্চলে তার বিক্রয় ও পরিসেবার জাল স্থাপন করেছে। হুয়াথাই গোষ্ঠির আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিভাগের প্রধান ব্যবস্থাপক চাও ঈ বলেন, "যে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উচিত সমাজে অবদান রাখা। বিদেশি সরকারের তোমাকে স্বাগত জানানোর পূর্ব শর্ত হচ্ছে তোমার সামাজিক দায়িত্ববোধ আছে কিনা। তার মধ্য দিয়ে শিল্পের অগ্রগতি আর প্রযুক্তির উন্নয়ন বয়ে আনা যায়। এতে স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান আর কর সৃষ্টি হবে এবং স্থানীয় শিল্পের সমৃদ্ধি আসবে। এ নীতির ভিত্তিতে আমরা যখন একটি বাজারে প্রবেশ করি, তখন অবশ্যই স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে গভীর পর্যায়ের সহযোগিতা করবো এবং সর্বাধিক মাত্রায় প্রযুক্তি ও শিল্প সে দেশে নিয়ে যাবো, যাতে উভয়ের জয়লাভ হয়।"
অতীতের 'বিদেশে যাওয়া' থেকে বর্তমানের 'স্থানীয় পরিচালনা' পদ্ধতি রূপান্তরের মধ্য দিয়ে চীনের গাড়ি শিল্পের বিশ্বায়ন কৌশলের অনেক পরিবর্তন হয়েছে এবং আরো বেশি দেশের সরকার ও জনগণের অভ্যর্থনা পেয়েছে। (ইয়ু/এসআর)
| ||||