মেড ইন চায়না পর্ব-৫
2024-06-29 18:16:33


হাজার বছর আগের কাগজ থেকে শুরু করে আজকের প্যাসেঞ্জার ড্রোন, কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন কিংবা নতুন জ্বালানির গাড়ি। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলেছে চীনের শক্তিশালী আবিষ্কারের হাত ধরে। নানা সময়ে দারুণ সব আবিষ্কার করে আধুনিক সভ্যতার ভিত গড়ে দিয়েছে চীন। আর সেই সব আবিষ্কার নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন মেড ইন চায়না।

মেড ইন চায়নার পঞ্চম পর্বে সাথে আছি আমি ফয়সল আবদুল্লাহ... আজকের পর্বে থাকছে চীনের আবিষ্কার চায়ের কথা।

একটি মিষ্টি সকাল মানেই হাতে থাকা চাই ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা। আর এভাবেই শুরু হয় প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা একটি ব্যস্ত দিন। চা মানেই শুধু একটি পানীয় নয়। প্রবাহমান জীবনে এক চিলতে বাড়তি রং যোগ করে এই চা। ক্লান্তিহীন আড্ডা হোক আর বৃষ্টিমুখর বিষণ্ন বিকেল, এক কাপ চা হলে নিজেকে আর একা মনে হয় না। জাত-ধর্ম, আয় রোজগার যেমনই হোক, চায়ের বেলায় না করে না কেউ। আর আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে বিশ্বে প্রথম চা বানিয়েছিল চীনারা। চা মানেই মেড ইন চায়না।  

পানির পরই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পান করা হয় চা। ২০২২ সালে সারা বিশ্বে দরকার হয়েছিল ৬৭০ কোটি কেজি চা পাতা। আগামী বছর সংখ্যাটা ৭৪০ কোটি কেজিতে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

কিন্তু কী করে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল চা? চীনেই বা কী করে আবিষ্কার হলো এই চা।

যথারীতি প্রচলিত আছে একটি মজার গল্প।

চীনা লোকগাথায় বলা আছে, আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে চীনের সম্রাট ছিলেন শেন নাং। চীনা ভাষায় শেন নাং অর্থ হলো স্বর্গীয় কৃষক। তার এমন নামের আরেকটি বড় কারণ হলো, চীনে প্রথম কৃষিকাজের ধারণা নিয়ে আসেন শেন নাং। আবার তাই কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, শেন নাং স্বর্গ থেকেই নিয়ে এসেছিলেন প্রথম চা পাতা।

তবে যে গল্পটা বেশি প্রচলিত তা অনেকটা এমন, শেন নাং ছিলেন দারুণ স্বাস্থ্যসচেতন। একবার তিনি নিয়ম করেন সবাইকে ফুটিয়ে পানি পান করতে হবে। একদিন বিকেলে বাইরে বসে শেন নাং নিজেই পানি ফোটাচ্ছিলেন। হঠাৎ সেই পানিতে এসে পড়ে কয়েকটি অচেনা পাতা। পাতাগুলো গরম পানিতে পড়তেই ছড়াতে শুরু করে চমৎকার ঘ্রাণ। এদিকে কৌতুহলী সম্রাট শেন নাংয়ের গবেষণার প্রিয় বস্তু ছিল নানা ধরনের ভেষজ। তাই ভাবলেন, এই নির্যাস পান করেই দেখা যাক। এরপরই ঘটল মজার ঘটনা। রঙিন পানীয়টা পান করা মাত্রই দারুণ চাঙ্গা হয়ে যান শেন নাং। এটি পান করে তার ঘুম ঘুম ভাবটাও কেটে গিয়েছিল। আর এভাবেই এসে গেল আমাদের সবার প্রিয় চা।

 

চা নিয়ে কয়েকটি তথ্য শোনা যাক এবার

·        বাংলাদেশে চায়ের চল শুরু হয়েছে বেশিদিন হয়নি। কারও মতে ১৮৪৩ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার কর্নফুলি নদীর তীরে নাকি প্রথম চা পান করা হয়েছিল। সতের শতকের দিকে বিকেলের নাস্তায় চা খাওয়ার রেওয়াজ চালু হয় ব্রিটিশদের হাত ধরে। কিন্তু ইউরোপ চা পৌঁছানোর কয়েক হাজার বছর আগেই চীনে চায়ের চল ছিল দেদার।

·        চীনে ১৩৬৮ সালে মিং রাজবংশের ক্ষমতায় আসার আগে, চা পাতাকে শুকিয়ে ইটের মতো আকৃতি দেওয়া হতো। সেগুলোকে ব্যবহার করা হতো মুদ্রা হিসেবে। চীনের দেখাদেখি এই চা-মুদ্রার প্রচলন রাশিয়াতেও গিয়েছিল।

·        নবম শতকের দিকে জাপানিদের চায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এক সন্নাসী। চীন থেকে চা নিয়ে আসার কয়েক দশকের মধ্যেই জাপানের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে চা।

 

এবার শুনবো চায়ের কিছু স্বাস্থ্যগুণের কথা

·        আড়াই বছর আগে চীনা মনীষী লাওৎসে চা–কে বলেছিলেন মহৌষধ। আধুনিক কালের অজস্র  গবেষণায় সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। চায়ে থাকা ফ্ল্যাভানয়েড এক ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট; যা দেহে প্রবেশ করা মাত্রই বাড়ায় হৃদ্‌যন্ত্রের সক্রিয়তা। সুস্থ রাখে রক্তনালি। শরীরে দেয় তরতাজা ও উৎফুল্ল ভাব।

·        ক্যানসার প্রতিরোধ থেকে শুরু করে রক্তের কোলেস্টেরলও কমায় চা। এ ছাড়া নানা ধরনের ভেষজ চা আছে যেগুলো শরীরের দূষিত পদার্থ বের করে দেয়। তাই সঠিক উপায়ে সঠিক চা পানে ফিরে পাওয়া যায় হারানো সজীবতা।

·        ডায়াবেটিসের জন্যও উপকারী চা। এর লিকার দাঁতের ক্ষয়রোধ ও মাড়ি শক্ত করে। নিয়মিত চা পানে রক্ত চলাচল ভালো হয়, পেট পরিষ্কার করে আর মস্তিষ্ককে রাখে সচল ৷

·        চায়ে আছে এপিগ্যালো ক্যাটেচিন-গ্যালেট নামের এক ধরনের রাসায়নিক, যা দুর্দান্ত একটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং এটি ভিটামিন সি-এর চেয়েও ১০০ গুণ বেশি ফলদায়ক। এটা কোষের ডিএনএ’কে ক্যানসারের প্রভাব থেকে সুরক্ষা দেয়।

অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে জেনে নিই চা কত প্রকার ও কী কী

নানা সময়ে ৬ প্রকারের প্রায় দুই হাজারেরও বেশি চা আবিষ্কার হয়েছে চীনে। মূল ৬টি প্রকার হলো—সবুজ, সাদা, কালো, হলুদ, উলং ও ডার্ক চা। চা পাতার প্রক্রিয়াকরণের ভিন্নতার ওপরই নির্ভর করে কোন চা কেমন হবে। যেমন চা পাতাকে সরাসরি কড়া রোদ ও আগুনের তাপে শুকিয়ে রোল করে বানানো হয় উলং চা। আবার পাতাকে খুব বেশি না শুকিয়ে দ্রুত জলীয় বাষ্পের তাপে প্রক্রিয়াকরণ করা হলে চা পাতার সবুজ রং অক্ষুণ্ন রাখা হয়। আর এটাইকে বলে গ্রিন টি। আবার এই গ্রিন টি তৈরির প্রক্রিয়ায় একটি বাড়তি ধাপ যোগ করলেই তৈরি হয় ইয়েলো টি তথা হলুদ চা। এ চা বানাতে হলে প্রক্রিয়াকরণের শেষ ধাপে পাতাগুলোকে রোল করে শুকিয়ে বদ্ধ একটি স্থানে উত্তপ্ত জলীয় বাষ্প প্রয়োগ করতে হয়।

তবে চায়ের মধ্যে সবচেয়ে দামি হলো ফুচিয়ান প্রদেশের উয়ি পাহাড়ে জন্মানো অর্কিড ফুলের ঘ্রাণ ছড়ানো তা হোং পাও নামের একটি বিশেষ চা। এটি উলং চায়ের শ্রেণিতে পড়ে। ফুচিয়ানের অনেক পুরনো কিছু তা হোং পাও চায়ের গাছ আছে। আর সেই গাছগুলো থেকে সংগৃহীত প্রতি কেজি চা পাতার দাম কোটি ডলারও ছাড়িয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ তুলনা করা হলে দেখা যাবে এই চায়ের দাম স্বর্ণের চেয়েও ত্রিশ গুণ বেশি। তবে আদি গাছ থেকে ক্লোন প্রক্রিয়ায় তৈরি করা নতুন গাছের কচি পাতা থেকে যে তা হোং পাও চা তৈরি হচ্ছে, সেগুলো  তুলনামূলক কম দামেই পাওয়া যাবে।

 

শেষ করার আগে জানা যাক চীনে চায়ের ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ে কিছু তথ্য

যে চীনে চায়ের জন্ম, সেই চীন তো চায়ের বাণিজ্যে এগিয়ে থাকবেই। ২০২২ সালে চীনের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পরও রপ্তানি হয়েছিল ৩ লাখ ৭৫ হাজার টন চা। যা ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ। এর মধ্যে প্রায় ৮৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ লাখ ১৪ হাজার টন ছিল গ্রিন টি।

চীনের মধ্যে চা উৎপাদন ও রপ্তানিতে এক নম্বরে আছে ফুচিয়ান প্রদেশ। রপ্তানির প্রায় ২৬ শতাংশই ফুচিয়ানের চা। এ বছরের শেষ নাগাদ প্রদেশটির চা বাগানের বিস্তৃত দাঁড়াবে ২ লাখ হেক্টরে। আর গত কয়েক বছরে চীন যে পরিমাণ চা রপ্তানি করছে তার বাৎসরিক বাজারমূল্য প্রায় ২০০ কোটি ডলারেরও বেশি।

 

সুপ্রিয় শ্রোতা আজকের মেড ইন চায়না ছিল এ পর্যন্তই। আগামী পর্বে আবার আসবো চীনের সাড়া জাগানো আরেকটি আবিষ্কারের গল্প নিয়ে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।

 

গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ

সার্বিক তত্ত্বাবধান: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী