মেড ইন চায়না পর্ব-৩ নুডলস
2024-06-15 19:53:14

কাগজ থেকে শুরু করে প্যাসেঞ্জার ড্রোন, চা থেকে শুরু করে কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলেছে চীনের নানা আবিষ্কারের হাত ধরে। হাজার বছর ধরে দারুণ সব আবিষ্কার করে আধুনিক সভ্যতার ভিত গড়ে দিয়েছে চীন। আর সেই সব আবিষ্কার নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন মেড ইন চায়না।

মেড ইন চায়নার তৃতীয় পর্বে সাথে আছি আমি ফয়সল আবদুল্লাহ... আজকের পর্বে থাকছে চীনের আবিষ্কার নুডলসের কথা।

 

হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে টিকে আছে একটি খাবার। এমন কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে খাবারটি জনপ্রিয় নয়। স্কুলের টিফিন থেকে শুরু করে সকাল সন্ধ্যা যখন তখন কারণে অকারণে খাওয়া যায় এ খাবার। বলছিলাম, নুডলসের কথা। আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে যে খাবারটি আবিষ্কার করে মানুষ। আর এখন সারা বিশ্বে প্রতি বছর কোটি কোটি মানুষ সেই একই স্বাদের নুডলস খাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

 

এক জরিপে দেখা গেছে বছরে শুধু ইনস্ট্যান্ট নুডলসই খাওয়া হচ্ছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি  প্যাকেট। কোটি কোটি মানুষের নিত্যদিনের এ খাবার নুডলস পুরোপুরি মেড ইন চায়না।

 

২০০৫ সালের কথা। চীনের একদল প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান চালালেন উত্তর চীনের লাচিয়া আর্কিওলজিক্যাল সাইটে। সেখানে তারা খুঁজে পান একটি বাটির ফসিল। গবেষণায় দেখা গেল ওই বাটিতে ছিল নুডলসের মতো একটি খাবার। অর্থাৎ আজ থেকে ৪ হাজার বছর আগেও বাটিতে করে নুডলস খেত চীনারা।

পরে অবশ্য নানা যুগে চীনের নুডলস খাওয়ার নজির পাওয়া যায় বিভিন্ন চিত্রকর্ম ও নথিপত্রে। বিশেষ করে দুই হাজার দুইশ বছর আগে গম দিয়ে তৈরি নুডলস খেতেন হান রাজবংশের সময়কার চীনারা।  এখনকার উত্তর চীনে লামিয়ান নামে যে লম্বাটে নুডলস দেখা যায়, অনেকটা এমনই দেখতে ছিল হান আমলের নুডলস।

চার হাজার বছর আগের লাচিয়ায় আবিষ্কৃত নুডলসটি ছিল কিছু শস্যদানা দিয়ে তৈরি। তবে এখন উপকরণে এসেছে নানা পরিবর্তন। এখন চালের গুঁড়ার তৈরি রাইস নুডলসও কিন্তু কম জনপ্রিয় নয়। তবে ময়দা, লবণ ও পানিই হলো এখনকার নুডলসরে প্রচলিত উপকরণ।

এবার থাকলো নুডলস নিয়ে চারটি মজার তথ্য

একটা সময় নুডলসকে ধনীদের খাবার বিবেচনা করা হলেও এখনকার বিশ্বে নুডলসই হলো সবচেয়ে কমদামি নাস্তাগুলোর একটি। এক হিসেবে দেখা গেছে, কেউ যদি সারা বছর তিন বেলা শুধু নুডলসই খায়, তবে তার ১৪০ ডলারের বেশি খরচ হবে না।

সুরুত করে টেনে নুডলস খাওয়া নিয়ে অন্যরা যাই ভাবুক না কেন, চীনে কিন্তু এভাবে শব্দ করে নুডলস খাওয়ার মানে হলো রান্নাটা চমৎকার হয়েছে। শব্দটা শুনে যিনি রান্না করেছেন তিনিও বেশ খুশি হন।

চীনে লম্বা নুডলস হলো দীর্ঘ জীবনের প্রতীক। যদি কেউ খাওয়ার সময় লম্বা নুডলসকে কেটে টুকরো করে ফেলেন, তখন এটাকে দুর্ভাগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বিশ্বের দীর্ঘতম নুডলটি ৩ কিলোমিটারেরও বেশি লম্বা ছিল। চীনা  প্রতিষ্ঠান সিয়াংনিয়ান ফুড করপোরেশন লিমিটেড তৈরি করেছিল এটি। পানি, গম দিয়ে নুডলটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল ১৭ ঘণ্টা।

 

 

 

এবার জানা যাক চীনা নুডলসের ধরন সম্পর্কে

চীনারা সবচেয়ে বেশি নুডলস। কত রকমের নুডলস? পাঁচটি নয় দশটি নয় এমনকি একশও নয়। গুনে গুনে বারশ রকমের নুডলস আছে চীনে। গম, বাকহুইট, ভাত, শস্যদানা, যব, ওটস, সয়াবিন, গোলআলু, মিষ্টি আলু এমন হরেক সবজি দিয়ে নানা ধরনের নুডলস খাওয়ার চল আছে দেশটিতে। চীন থেকেই বৈচিত্র্যময় স্বাদের নুডলসগুলোর রেসিপি পৌঁছে এশিয়ার কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ক্যাম্বোডিয়াসহ আরও অনেক দেশে।

৯৬০ থেকে ১২৭৯ সাল পর্যন্ত চীনে ছিল সং রাজবংশের শাসন। ওই সময় চীনে ছিল নুডলসের দোকান। দোকানগুলো খোলা থাকত সারারাত। আর সেখানে যে নুডলসটি তৈরি হতো সেটাকে বাংলা করলে দাঁড়ায় সুপের কেক।

১৯৫০-এর দশকে নুডলস তৈরির স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র আবিষ্কার হওয়ার আগে, চীনা নুডলস প্রক্রিয়াকরণের মোট চারটি ধাপ ছিল।

প্রথম ধাপে তৈরি হতো তাজা নুডলস। যা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খেতে হতো। দ্বিতীয় ধাপে নুডলসকে রোদে শুকানো হলে তা সংরক্ষণ করা যেত আরো কিছুদিন।

এরপর সেদ্ধ করা হতো রোদে শুকানো নুডলস। এতে মেশাতে হয় সামান্য ভোজ্য তেল, যাতে করে নুডলসের স্টিকগুলো দলা পাকিয়ে না যায়।

সবশেষে নুডলসকে দীর্ঘসময় সংরক্ষণ কিংবা এর স্বাদ পরিবর্তনের জন্য দেওয়া হয় জলীয় বাষ্পের তাপ।

নুডলসের সুতোটি কতটা মোটা বা চিকন হবে সেটার ওপর নির্ভর করে নুডলসটার নাম কী হবে এবং এর রেসিপিটাই বা কেমন হবে।

তবে চীনের সিচুয়ান প্রদেশের চিকং শহরের শেফ লি হংখাই নুডলসকে নিয়ে গেছেন এক নতুন উচ্চতায়। চিকন নুডলস বানিয়ে তিনি নাম লিখিয়েছেন গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। তার তৈরি ‘সোনালি সুতার নুডলস’গুলো প্রতিটি শূন্য দশমিক শূন্য সাত তিন মিলিমিটার পুরু। এমন ৪৩টি নুডলস অনায়াসে পুরে দেওয়া যাবে একটি সুঁইয়ের ভেতর।

এর মধ্যে নুডলসের আরেক বিশ্বজয় করা নুডলস হলো ইনস্ট্যান্ট নুডলস। মজার বিষয় হলো এটি কিন্তু চীনের আবিষ্কার। চীনের তাইওয়ানের উদ্যোক্তা মোমোফুকু আনদো ১৯৫৮ সালে তৈরি করেন ইনস্ট্যান্ট নুডলস। আর নামের মতোই এটি তাৎক্ষণিকভাবে হয়ে যায় দারুণ জনপ্রিয়।

দুটো নুডলস তৈরির প্রক্রিয়া কিছুটা ভিন্ন। আবার ইনস্ট্যান্ট নুডলস দেখতেও খানিকটা আঁকাবাঁকা। আর এ নিয়ে আছে একটি জনপ্রিয় চীনা কৌতুক।

 

এই ফাঁকে শোনা যাক নুডলস নিয়ে একটা কৌতুক

একবার একটি সাধাসিধে নুডলস চলার পথে ভুল করে আঘাত করে বসলো একটি গরম গরম পাউরুটিকে। পাউরুটি তো রেগে আগুন। সে তাড়া করলো ওই নুডলসকে। নুডলসটা ভয় পেয়ে এক দৌড়ে পালিয়ে গেল। নুডলসকে খুঁজতে খুঁজতে একদিন পাউরুটির সামনে পড়ল একটি ইনস্ট্যান্ট নুডলস। তাকে দেখেই পাউরুটিটা বলল, চুলের স্টাইল যতই বদলাও না কেন, আমার চোখ ফাঁকি দিতে পারবে না!

শেষ করছি নুডলস খাওয়ার কিছু তথ্য জানিয়ে

শত শত রকমের নুডলস আছে।  কোথায় কী পরিমাণে খাওয়া হচ্ছে বা রপ্তানি হচ্ছে সেই হিসেব পাওয়া মুশকিল বটে। তবে ওয়ার্ল্ড ইন্সট্যান্ট নুডল অ্যাসোসিয়েশনের কাছে থাকে ইনস্ট্যান্ট নুডলসের তথ্য। তারা  বলছে, ২০২০ সালে সারা বিশ্বে ১১ হাজার ৭০০ কোটি প্যাকেট নুডলস খাওয়া হয়েছে। আর এর মধ্যে চীনেই খাওয়া হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি প্যাকেট। নুডলস খাওয়ার তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইন্দোনেশিয়া। দেশটিতে বছরে খাওয়া হয় গড়ে দেড় হাজার কোটি প্যাকেট। এর ঠিক পরেই আছে ভারত, ভিয়েতনাম, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র। আর বাংলাদেশের অবস্থান এ তালিকার ২৮ নম্বরে। এ দেশে বছরে নুডলস খাওয়া হয় প্রায় ৩৪ কোটি প্যাকেট।

 

সুপ্রিয় শ্রোতা আজকের মেড ইন চায়না ছিল এ পর্যন্তই। আগামী পর্বে আবার আসবো চীনের সাড়া জাগানো আরেকটি আবিষ্কারের গল্প নিয়ে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।

 

 

গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ

সার্বিক তত্ত্বাবধান: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী