৪১ বছর ধরে চলমান ফ্রি ক্লাস
2024-06-06 15:20:22

চীনের ছিং তাও শহরের ওয়ার্কার্স কালচারাল প্যালেসে রয়েছে এমন একটি ক্লাস, যা প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়। ঝড়বৃষ্টি যাই হোক না কেন, এ ক্লাস টানা ৪১‌ বছর ধরে স্থায়ী হয়েছে। এ ক্লাসের নাম ‘সপ্তাহে একটি বক্তব্য’।

চীনজুড়ে সবচেয়ে দীর্ঘসময় ধরে চালু থাকা জনকল্যাণমূলক ক্লাস হিসেবে  ‘সপ্তাহে একটি বক্তব্য’ ক্লাসটি কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। বক্তব্য রাখার বিষয়ও সীমিত নয়। এতে পরীক্ষা নেই, সার্টিফিকেটও পাওয়া যায় না। কোন জটিল শিক্ষার সূচক নেই, কেবল আছে বিশুদ্ধতম জ্ঞান ভাগাভাগি। এ ক্লাস একটি বাতিঘরের মতো মানুষের আধ্যাত্মিক জগতকে আলোকিত করে এবং সাংস্কৃতিক জ্ঞান ও পুষ্টি নিয়ে আসে। যারা ৪১ বছর ধরে এই চিরন্তন বাতিঘর জ্বালিয়েছেন তারা হলেন স্থায়ী লেকচারার, যারা অর্ধেক জীবন ধরে শিক্ষকতা করেছেন এবং অনুগত শ্রোতারা, যারা আরো বহু বছর ধরে ক্লাস নেওয়ার জন্য অবিচল রয়েছেন। তা ছাড়া আরও রয়েছেন কর্মচারীরা, যারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সেবা দিয়ে আসছেন। তারা বলেন, জ্ঞানের হস্তান্তর বন্ধ করা যাবে না এবং এই ক্লাস চালাতেই হবে। আজকের জীবন কথা অনুষ্ঠানে আমরা শুনবো এ ক্লাসের গল্প।

প্রতি সোমবার সন্ধ্যা নয়টায় চীনের ছিং তাও শহরের ওয়ার্কার্স কালচারাল প্যালেসে ‘সপ্তাহে একটি বক্তব্য’ সময়ের মতো অনুষ্ঠিত হয়। 

১৯৮৩ সালে অল-চায়না ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়ন ‘পুনরুজ্জীবিত চাইনিজ রিডিং ক্যাম্পেইন’ শুরু করেছিল। এই আহ্বানে ছিং তাও ওয়ার্কার্স কালচারাল প্যালেস ‘জ্ঞান হলো শক্তি’ শীর্ষক ‘সপ্তাহে একটি বক্তব্য’ ক্লাস চালু করেছিল।

সেই সময়ে দর্শকদের কাছে অনন্য জ্ঞান ভাগ করে নেওয়ার জন্য ওয়ার্কার্স কালচারাল প্যালেসের কর্মীরা মনোযোগ দিয়ে ভেবেছিলেন।

সেই যুগে মানুষের তথ্যে সীমিত প্রবেশাধিকার ছিল। তাই রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলা, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদির অন্তর্ভুক্তি সর্বব্যাপী ‘সপ্তাহে একটি বক্তব্য’ ক্লাসটি তাত্ক্ষণিকভাবে ভাইরাল ছিল। সেই বছরের দিকে ফিরে তাকালে ৬৩ বছর বয়সী চৌ সুয়ে উ’র এখনও তরতাজা সেই স্মৃতি মনে পড়ে।

মঞ্চের নীচে সর্বস্তরের মানুষ রয়েছেন। তাদের কাছে সাধারণ ছাত্রদের মতো জ্ঞানের ভাণ্ডার নেই, না প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো একাডেমিক লক্ষ্য রয়েছে। তাদের ধরে রাখার একমাত্র উপায় হল উচ্চমানের এবং আকর্ষণীয় বক্তব্য। অনেক প্রভাষক মনে করেন, ‘এই মঞ্চে দাঁড়ানো সহজ নয়।’

সোং ওয়েন চিং এ ক্লাসের প্রভাষক। তিনি বলেন, আমি যদি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, তাহলে এটি সাধারণত একটি কোর্স। এ কোর্সের কারণ এবং ফলাফল, অধ্যায় বিতরণ এবং একাডেমিক গভীরতা থাকতে হবে। তবে এখানে বিষয়গুলো সহজ উপায়ে ব্যাখ্যা করতে হবে। আপনাকে সবার সাথে যোগাযোগ করতে এবং গল্প বলার জন্য ভাষা ব্যবহার করতে হবে। আমি সবাইকে খুশি করতে চাই। আজকাল সবাই অনলাইনে অনেক কিছু দেখতে পারে, তাই আপনার কিছু স্বাধীন মতামত থাকতে হবে।’

প্রভাষকরা তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন এবং শ্রোতারা তাতে আনন্দ পান। ‘সপ্তাহে একটি ক্লাসে’ প্রত্যেকে কেবল জ্ঞানের আনন্দই ভাগ করেন না, অভিন্ন আগ্রহের কারণে অনেকে একে অপরের বন্ধু হয়েছেন।

বিগত ৪১ বছরে, ২০০ জনেরও বেশি প্রভাষক প্রতি সোমবার বিরতি বা পুনরাবৃত্তি ছাড়াই ক্লাস নিয়েছেন, তাদের মধ্যে একটি পরিবার ধারাবাহিকভাবে রিলে পদ্ধতিতে মঞ্চে পা রেখেছে।

১৯৯৪ সালে সোং ওয়েন চিংকে ‘সপ্তাহে একটি বক্তব্য’ ক্লাসের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই সময়ে দুই বছর বয়সী সোং হান এর এবং তার যমজ বোন সোং লু  ক্লাসের সর্বকনিষ্ঠ শ্রোতা সদস্য হয়েছিলেন।

সোং হান এর বলেন, সবাই বাবার দিকে তাকালো, যেন বাবার কাছ থেকে আরও মজার জিনিস শোনার আশায়। তারা সবাই বাবাকে ঘিরে ধরে এবং আমার মনে হয় একটা পরিবেশ ছিল যা আমার কাছে ক্লাসটিকে অবিস্মরণীয় করে তুলেছিল।

গত ৩০ বছরে, সোং ওয়েন চিং ৮০ বার এ ক্লাস নিয়েছেন। সে সময় তার মেয়ে সোং ওয়েন চিংয়ের সঙ্গি ছিলেন। এমন কি বাড়িতে ছবি এবং ভিডিও, এবং স্লাইডশো করতে সাহায্য করেন সোং হান এর। ‘সপ্তাহে এক বক্তব্য’ এর অনানুষ্ঠানিক সহকারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ক্লাস তার হৃদয়ে আসন করে নিয়েছে।  

 

গত বছরে সোং হান এর সেন্ট্রাল একাডেমি অফ ফাইন আর্টস থেকে ডক্টরেট নিয়ে স্নাতক হয়েছে। নিজের শহরে ফিরে এসে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন তিনি। অবসর সময়ে, সোং হান এর তার বাবার মতো প্রতি সোমবার বক্তৃতা দেওয়ার জন্য মঞ্চে ওঠেন।

৪১ বছর ধরে চলমান ‘সপ্তাহে একটি বক্তব্য’ ক্লাস অলৌকিক না বললেও বিষ্ময়কর বলা যায়। গত ৪১ বছরে ছোট ক্লাসরুমের পরিবর্তে ১০০ জন ধারন ক্ষমতার একটি প্রশস্ত রুম প্রতিস্থাপিত হয়েছে। সংকীর্ণ ব্ল্যাকবোর্ডটি বুদ্ধিমান মাল্টিমিডিয়া সরঞ্জাম দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এ ক্লাসের পরিবেশ বদলে যাচ্ছে, তবে ‘জ্ঞানই শক্তি’ ধারণাটি একই রয়ে গেছে এবং ‘সপ্তাহে একটি বক্তব্য’র আনা আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক পুষ্টি তাদের হৃদয়ে চিরকাল অম্লান থাকবে।