বিল গেটস ভাবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, রোবট পৃথিবী পরিবর্তনের পরবর্তী প্রযুক্তি হবে। নানা লক্ষণ থেকে প্রমাণিত হয়েছে, বিশ্বে 'রোবট যুগ' দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে। চীনও এর ব্যতিক্রম নয়। ইতোমধ্যেই চীনে অনেক মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানে রোবট চুপে চুপে কাজ শুরু করেছে। (সংগীত)
লেইপাই প্রযুক্তি লিমিটেড কোম্পানি হচ্ছে শেনচেনের একটি কম্পিউটার সরঞ্জাম উত্পাদক প্রতিষ্ঠান। ২০১১ সালের মে মাস থেকে এ কোম্পানি কর্মীদের সঙ্গে কাজ করার জন্য অনেক রোবট কিনেছে। লেইপাই প্রযুক্তি কোম্পানির কীবোর্ড উত্পাদন ইউনিটে এক একটি রোবট ধারাবাহিকভাবে নানা খুচরা যন্ত্রাংশ সংযোজন করে এবং আধা-তৈরী পণ্য পরবর্তী ধাপে পাঠায়। আগে একই কাজ একই প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করতে ১১০ জন কর্মীর দরকার হতো। এখন মাত্র ৫ জন কর্মী লাগে। এতে কোম্পানির সাশ্রয় হচ্ছে ১০৫ জনের বেতন।
এ কোম্পানির এক কর্মী আমাদের বললেন, "আমার মনে হয়, এ রোবট খুব দ্রুত কাজ করে। ভবিষ্যতে আরো বেশি রোবট মানুষের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে।"
কুয়াংতু প্রদেশের কুয়াংহোং প্রযুক্তিগত ইলেকট্রনিক লিমিটেড কোম্পানির সংস্কার বিভাগের প্রধান হুয়াং ফু সিন স্ক্রু বসানোর জন্য তিনটি রোবট কিনেছেন। এ তিনটি রোবটের কাজ নিয়ে হুয়াং ফু সিন সন্তুষ্ট। তিনি মনে করেন, মানুষের তুলনায় রোবটের কর্মদক্ষতা বেশি। তিনি বলেন,"আগে আমরা হাত দিয়ে স্ক্রু বসাতাম। একটি স্ক্রু বসাতে এক মিনিট সময় লাগে। এখন রোবট একই কাজ করতে মাত্র ৪০ সেকেন্ড সময় নেয়। হাত দিয়ে কাজ করলে মাঝেমধ্যে দু'একটা ভুল হতে পারে। কিন্তু রোবট প্রশিক্ষণ ছাড়াই সঠিকভাবে কাজ করতে পারে।"
হুয়াং ফু সিনের হিসাব পরিস্কার। এ তিনটি রোবট কিনতে ১ লাখ ৮০ হাজার ইউয়ান রেনমিনপি ব্যয় হয়েছে। কিন্তু তিনটি রোবট ছয় জন কর্মীর সমান কাজ করতে পারে। তাই রোবট কেনার টাকা তার উঠে আসবে এক বছরের মধ্যে। আর রোবটগুলো যদি তিন বছর কাজে লাগে, তাহলে ৪ থেকে ৫ লাখ ইউয়ান সাশ্রয় হবে। এর ফলে, এ কোম্পানি রোবট আমদানি করার জন্য আরো ৫০ লাখ মার্কিন ডলার বরাদ্দ করবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেন চীনের উত্পাদনশিল্পে বিপুল সংখ্যক রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে? বিশ্লেষকরা মনে করেন, এর পেছনে ক্রিয়াশীল আছে যুগের জরুরি চাহিদা। চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক শেং লেই ইয়ুন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ২০১২ সালে চীনে ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা প্রথমবারের মতো তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ৩৪ লাখ ৫০ হাজার কমে গেছে।
শেং লেই ইয়ুন বলেন, "গত ৩০ বছর ধরে চীনের অর্থনীতিতে প্রায় ১০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, চীনে অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ শ্রমসম্পদ এবং বিস্তীর্ণ বাজার রয়েছে। কিন্তু ৩০ বছর ধরে উচ্চ হারের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হওয়ার পর, গত কয়েক বছর ধরে শ্রমশক্তির দামও ধাপে ধাপে বেড়ে গেছে। নবীন প্রজন্মের শ্রমিক সরবরাহ ও চাহিদার সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। শ্রমিকদের এখন বেশি বেতন দিতে হয়।"
চীনের বৃহত্তম রোবট শিল্পপ্রতিষ্ঠান --- শেনইয়াং সিনসোং-এর প্রেসিডেন্ট ছু থাও কুই উল্লেখ করেন, বর্তমানে চীনের উত্পাদনশিল্প বাধ্য হয়ে নতুন কর্মী নিয়োগের পদ্ধতি খুঁজে বের করছে। ছু থাও কুই বলেন,"গত বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বুদ্ধিবৃত্তিক উত্পাদন পদ্ধতির কথা বলেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নে নতুন শিল্পবিপ্লব সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। অর্থাত্ রোবট এবং তথ্যব্যবস্থা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সরঞ্জাম মিলিয়ে এ হবে এক ধরণের নতুন উত্পাদনপদ্ধতি। চীনের শ্রমভিত্তিক নিম্ন ব্যয়ের উত্পাদনপদ্ধতির কার্যকারিতা কমছে; এ পদ্ধতির প্রাধান্যও এখন প্রায় নেই। ফলে ভবিষ্যতে ইউরোপ ও আমেরিকা আবারও উচ্চমানের উত্পাদনশিল্পে প্রাধান্য দেখাতে পারে। এখন আমাদের নিম্ন ব্যয়ের উত্পাদনশিল্প দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মেক্সিকো ও ভারতসহ বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি হচ্ছে। এ সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যে আমাদের চিন্তা করতে হবে যে, কীভাবে রোবটের মাধ্যমে আমাদের নিম্নমানের উত্পাদনশিল্পকে মধ্য ও উচ্চ মানের উত্পাদনশিল্পে রূপান্তর করা যায়।"
জটিল আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতার চাপে চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো রোবট ব্যবহার শুরু করে।
চীনে রোবট আমদানি করে সবচেয়ে বেশি সাফল্য পাওয়া শিল্পপ্রতিষ্ঠান --- শেনচেন লেইপাই প্রযুক্তি লিমিটেড কোম্পানির উত্পাদনকেন্দ্রের প্রধান তেং ছিউ ওয়েই মনে করেন, "ভবিষ্যতে কর্মীব্যয় আরো বাড়বে। তখন মানুষের সঙ্গে রোবটের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে দেখা দেবে।"
রোবটের দ্বারা উত্পাদন করলে পণ্যের মান নিশ্চিত করা যায়, কাজের কার্যকারিতা বাড়ে এবং উত্পাদনের ব্যয় কমানো যায়। এর ফলে চীনের বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান রোবট আমদানি করেছে এবং চীনে একটি বিরাট রোবটবাজার সৃষ্টি হয়েছে। এ বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য চীনে ইতোমধ্যে ত্রিশের অধিক রোবট শিল্প উদ্যানও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, স্নানঘরে ব্যবহৃত জিনিস উত্পাদন খাতের কথাই ধরা যাক। উত্পাদন-ব্যয় বৃদ্ধির কারণে এ খাতে বর্তমানে চীনের ২০ হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠানে রোবটের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। যদি প্রতিটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান দশটি করে রোবট কেনে এবং প্রতিটি রোবটের দাম যদি হয় ৬ লাখ ইউয়ান, তবে ২০ হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান মোট ১২,০০০ কোটি ইউয়ান ব্যয় করবে এ খাতে। এ থেকে এ খাতে বাজারের বিশালতা উপলব্ধি করা যায়।
শেনচেনের আন্তর্জাতিক কন্টেইনার শিল্পপ্রতিষ্ঠান --- চোংচি গোষ্ঠীও রোবট নিয়ে গবেষণাকাজ শুরু করেছে। এ কোম্পানি রোবটকে তার ২০ শতাংশ কর্মীর স্থলাভিষিক্ত করার পরিকল্পনা করেছে।
কিন্তু রোবট যদি ক্রমবর্ধমান হারে মানবকর্মীর স্থান দখল করে নিতে থাকে, তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব কি কর্মসংস্থানের ওপর পড়বে না? একজন কর্মী বললেন,
"আগে আমাদের এখানে অনেক কর্মী ছিল। এখন অনেক কমে গেছে। কিছু লোক অন্য কাজ করছে। আমার মনে হয়, এতে বেকারত্ব বাড়বে।"
কুয়াংতুং গাড়ি শিল্পগোষ্ঠীর মোটর গাড়ি লিমিটেড কোম্পানির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ফেং ঈ ছিয়াং বলেন, "আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভবিষ্যতে উত্পাদনের শেষ প্রক্রিয়ায় স্বয়ংক্রিভাবে কাজ সম্পন্ন হবে ৯০ শতাংশেরও বেশি। মানবকর্মীরা প্রধানত সরঞ্জামের মেরামত, পরীক্ষা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেবে।"
রোবটের প্রচলন চীনের ঐতিহ্যিক শ্রমঘন উত্পাদনশিল্পে মানুষের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ হ্রাস করবে। ভবিষ্যতে রোবট উচ্চমানের শিল্প এবং বিশেষ শিল্প থেকে নিম্ন পর্যায়ের শিল্প পর্যন্ত জনপ্রিয় হবে, যেমন স্থাপত্য ও বস্ত্রবয়ন ইত্যাদি। শ্রমশক্তির ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া, কর্মী নিয়োগে সমস্যাসহ নানা সমস্যা মোকাবিলায় শিল্পখাতে রোবট নিয়ে নেবে মানবকর্মীর স্থান। এবং এভাবেই ইতোমধ্যেই শুরু হওয়া নতুন উত্পাদনশিল্প যুগ উপনীত হবে চূড়ান্ত পর্যায়ে। বিশেষজ্ঞরা এমনটিই মনে করেন। (ইয়ু/আলিম)
| ||||