বাংলাদেশে রপ্তানি আয় বাড়ছে এবং যথারীতি এক্ষেত্রে সবচে বড় অবদান রেখে চলেছে তৈরি পোশাক শিল্প। দেশটির রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর দেওয়া তথ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে অর্থাত ২০১৩ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে মোট আয় করেছে ১৯৮৩ কোটি মার্কিন ডলার। এ আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৪ শতাংশ এবং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২.১৭ শতাংশ বেশি। রপ্তানি আয়ের ৮১ শতাংশেরও বেশি এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। টাকার হিসেবে গত আট মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে দেশ আয় করেছে ১৬১৪ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে উভেন পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ৮২২ কোটি ৮৩ লাখ ডলার এবং নিট পোশাক থেকে এসেছে ৭৯১ কোটি ডলার। তৈরি পোশাক থেকে আসা এই আয়ও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫.১৩ শতাংশ বেশি এবং গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬.৭১ শতাংশ বেশি। তবে সার্বিকভাবে অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রপ্তানি আয় বাড়লেও, শুধু ফেব্রুয়ারি মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কম হয়েছে ৩.৭৬ শতাংশ। নেতিবাচক দিক আরেকটি আছে। সেটি হচ্ছে, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি আয় ২০.৭১ শতাংশ কমেছে। তা নাহলে, এসময় হিমায়িত মাছ রপ্তানি বেড়েছে ২৪.২৩ শতাংশ, কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ১০ শতাংশ, কাঁচা চামড়া রপ্তানি বেড়েছে ৪৪.৫৭ শতাংশ, চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৫০ শতাংশ, ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ২৩.৫৭ শতাংশ এবং সিরামিক রপ্তানি বেড়েছে ৩০.৬৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধির এই প্রবণতা কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পরিসংখ্যান দিলেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশ রপ্তানি খাতে আয় করেছিল ১৫ ৫৬ কোটি মার্কিন ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে আয় হয় ১৬ ২০ কোটি মার্কিন ডলার; ২০১০-১১ অর্থবছরে আয়ের পরিমাণ ছিল ২২৯৩ কোটি ডলার; ২০১১-১২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ২৪২৯ কোটি ডলার; এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় হয় ২৭০৩ কোটি মার্কিন ডলার। আর চলতি অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩০৫০ কোটি মার্কিন ডলার।
এমনি এক অনুকূল প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে, আগামী পাঁচ বছর পর দেশের বার্ষিক রপ্তানি আয় ৭ হাজার থেকে সাড়ে ৭ হাজার কোটি মার্কিন ডলার হতে পারে। সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন, এটি আপনাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। অনুষ্ঠানে তিনি তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএ-র সভাপতি আতিকুল ইসলামকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা চিন্তা করে দেখুন, কীভাবে রপ্তানিকে সে পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের উদ্দেশ্যে অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের আশি শতাংশের বেশি আসছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। যদি পাঁচ বছরের মধ্যে বছরে ৭ থেকে সাড়ে সাত হাজার কোটি মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়, তবে তৈরি পোশাক খাতকেই সবচে বড় ভূমিকাটি রাখতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে: তৈরি পোশাক খাত কি সেই চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত?
দৃশ্যত, তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা অর্থমন্ত্রীর মতো অতোটা উচ্চাভিলাষী নন। ওই অনুষ্ঠানেই বিজিএমইএ-র সভাপতি বলেছেন, সরকারি সহায়তা ও অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকলে, রপ্তানি আয় পাঁচ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব। অনু্ষ্ঠানে তিনি পোশাকশিল্পের জন্য ফ্যাশন ডিজাইনের মতো অগ্রবর্তী সংযোগ শিল্প গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। অনুষ্ঠানে ফ্যাশন উদ্যোগের সভাপতি আজহারুল হক সংগঠনের পক্ষ থেকে কিছু নীতিসহায়তার দাবি জানান। তিনি বলেন, দেশীয় ফ্যাশন শিল্পকে বিশেষ অগ্রাধিকার খাত ঘোষণা করতে হবে; এ শিল্পের জন্য পাঁচ থেকে সাত শতাংশ হার সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে; সমমূলধনী উদ্যোক্তা তহবিল চালু করতে হবে; নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কর অবকাশ সুবিধা দিতে হবে; এবং আমদানি করা তৈরি পোশাকে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করতে হবে। অন্যদিকে, সমিতির প্রথম আহ্বায়ক মনিরা এমদাদ বলেন, 'রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সময় আমাদের দোকান বন্ধ রাখতে হয়। এটা আমাদের আত্মহত্যার সমান।' তিনি বলেন, ফ্যাশন হাউসগুলো যদি ভালো মানের কাপড় পায় তাহলে বিশ্ববাজারে তাদের পোশাকের রপ্তানি কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব হবে।
অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি ওঠে স্বাভাবিকভাবেই। এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি হেলাল উদ্দিন অর্থমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় সারা দেশের সব খাতের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ক্ষতি পোষাতে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর মতো সব খাতেই প্রণোদনা দেওয়া উচিত।
ব্যবসায়ীদের জন্য ভালো খবর হচ্ছে, গত ২০ মার্চ চট্টগ্রামে তিন দিনব্যাপী পোশাকশিল্প পণ্যের প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ তৈরি পোশাকশিল্প খাতের জন্য একগুচ্ছ প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। মন্ত্রী বলেন, পোশাকশিল্পে রপ্তানিমূল্যের ওপর দশমিক ২৫ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, উৎসে কর দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন বাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান ২ শতাংশ নগদ সহায়তা বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। হরতাল-অবরোধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পোশাকশিল্পের মালিকদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে দ্রুত এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে বলেও তিনি জানান। অনুষ্ঠানে তিনি পোশাকপল্লি গড়ে তোলার কাজ শুরুর আশ্বাসও দেন; জানান, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ৫০০ একর জমিতে শিল্পপার্ক স্থাপনে চীনের ঋণ দেওয়ার কথা রয়েছে। এ অনুষ্ঠানে বিজেএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, রপ্তানি আয় ৫০০০ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অন্যান্য উদ্যোগের পাশাপাশি নতুন নতুন শিল্পপার্ক গড়ে তুলতে হবে।
দৃশ্যত, সরকার তৈরি পোশাকশিল্পকে সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তত। বাণিজ্যমন্ত্রীর প্রণোদনার ঘোষণা তার প্রমাণ। কিন্তু, এরই মধ্যে বিদ্যুতের দাম ৭ শতাংশ বৃদ্ধি করায় উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি বিজিএমইএ-র পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে পোশাকশিল্পে বিদ্যুতের মূল্য ইউনিট প্রতি ২ টাকা ৫১ পয়সায় অপরিবর্তিত রাখার আবেদন জানিয়ে বলা হয়েছে, "শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে সেচে ব্যবহৃত কৃষি পাম্পের অনূরূপ পোশাক শিল্পে বিদ্যুৎ মূল্য অপরিবর্তিত রাখার বিষয়টি সহানুভূতির সাথে বিবেচনার জন্য বিজিএমইএ সরকারকে বিনীতভাবে অনুরোধ জানাচ্ছে।" বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গত ১৩ মার্চ বিদ্যুতের দাম গড়ে ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বাড়ালেও, কৃষিকাজে ব্যবহৃত পাম্প বা সেচ গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট ২ টাকা ৫১ পয়সা অর্থাত 'অপরিবর্তিত' রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিজিএমইএ-র বিবৃতিতে আরো বলা হয়, বিদ্যুতের দাম গড়ে ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় তৈরি পোশাক শিল্পে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যুতের এই মূল্যবৃদ্ধি পোশাক শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং এই মূল্য বৃদ্ধির কারণে শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা আরও হ্রাস পাবে। এখন দেখার বিষয় সরকার পোশাক রপ্তানিকারকদের এই দাবির প্রতি সাড়া দেয় কি না। (আলিম)
| ||||