Web bengali.cri.cn   
সৈয়দ আলী আহসান: বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন মানুষের প্রতিকৃতি (ছবি)
  2013-06-18 20:15:16  cri

আলিমুল হক

সৈয়দ আলী আহসান ১৯২০ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের মাগুরা জেলার আলোকদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সৈয়দ আলী হামেদ ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। মাতা সৈয়দা কামরুন্নেগার খাতুন ছিলেন ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার আগলা গ্রামের জমিদার ও পীর সৈয়দ মোকাররম আলীর কন্যা।

সৈয়দ আলী আহসান

১৯৩৭ সালে আর্মানিটোলা স্কুলে অধ্যয়নকালে স্কুল ম্যাগাজিনে তার 'দি রোজ' শিরোনামের একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে দৈনিক আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী, সওদাত ইত্যাদি পত্রিকায় বাংলা ভাষায় তার গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র থাকাকালে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা'পরিচয়'-এ তার 'কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত' শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এ-সময় তিনি ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের নিয়ে 'পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ' প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজে সংগঠনের সম্পাদক হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর সৈয়দ আলী আহসান কিছুকাল কলেজে অধ্যাপনা করেন এবং ১৯৪৫ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র কলকাতা কেন্দ্রে সাহিত্যসম্পর্কিত অনুষ্ঠান প্রযোজনা শুরু করেন। ১৯৪৬ সালের ৭ই জুলাই তিনি কলকাতাতেই বিয়ে করেন। কলকাতায় তিনি দেশি-বিদেশি বহু খ্যাতনামা সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান এবং নিজেও কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি টি এস ইলিয়ট ও আল্লামা ইকবালের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ করেছেন। তিনি একদিকে ইসলামি ভাবধারার কবিতা রচনা করেছেন, অন্যদিকে লেনিন ও অন্য সামাজিক প্রসঙ্গ নিয়ে কবিতা লিখেছেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে তিনি অধ্যাপনা শুরু করেন।

১৯৫৪ সালে সৈয়দ আলী আহসান করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের রিডার ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি ভাষা ও সাহিত্যসম্পর্কিত একটি ইংরেজি ষাণ্মাষিক পত্রিকা প্রকাশ করতেন। তিনি আন্তর্জাতিক লেখক সংঘ 'পি ই এন' এবং 'কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডম' নামক দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা একাডেমীর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এসময় তিনি একাডেমী ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে দেশের অনেক কবি-সাহিত্যিককে সংশ্লিষ্ট করতে সক্ষম হন।

১৯৬৭ সালে তিনি নতুন প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং কলা অনুষদের ডীন নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি ভারতে চলে যান এবং কলকাতায় অবস্থান করে স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। তিনি এসময় তার শক্তিশালী লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে স্থানীয় ও বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের' শব্দ-সৈনিক ছিলেন এবং 'চেনাকণ্ঠ' নামে শ্রোতাদের মাঝে সুপরিচিত ছিলেন।

১৯৭২ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। তখন সদ্যপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি আধুনিক ও পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা ছাড়াও, তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখেন। তিনি বাংলাদেশ সংবিধানের বাংলা চূড়ান্তকরণ, শিল্পকলা একাডেমীর গঠনতন্ত্র প্রণয়ন, বাংলা একাডেমী ও বাংলা ডেভেলপমেন্ট বোর্ড একত্রীকরণ, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কমিশন গঠন ইত্যাদি কাজের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের ইংরেজি অনুবাদও তিনিই সম্পন্ন করেন।

১৯৭৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সৈয়দ আলী আহসান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ পান। ১৯৭৭ সালের ২৬ জুন তিনি রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যপদ গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের ২৪ জুলাই তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮০ সাল থেকে কিছুকালের জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে খণ্ডকালীন শিক্ষকরূপে গবেষণামূলক কাজ করেন। ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি 'অ্যাপ্রোচ' নামক একটি ইংরেজি ষাণ্মাষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর কিছুকাল পর তিনি 'বাংলাদেশ কবিতা কেন্দ্র' প্রতিষ্ঠা করে ঢাকায় দুটি এশীয় কবিতা উত্সবের আয়োজন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি দেশের জাতীয় অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৯৯ সাল থেকে প্রায় দুবছর তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দারুল ইহসানের উপাচার্যরূপে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সুইডেনের নোবেল কমিটির সাহিত্য শাখার উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান জীবনে বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৬৭ সালে তিনি কবিতার জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে একুশে পদ এবং ১৯৮৭ সালে স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। এ ছাড়া, ১৮৭৪ সালে ভারতের নাগপুরে বিশ্ব হিন্দী সম্মেলনে বিশেষ সম্মাননাপত্র ও ১৯৯২ সালে ফরাসি সরকারের বিশেষ পদক ও সনদ লাভ করেন। মত্যুর কিছুকাল পূর্বে তাকে বাংলাদেশ সরকার শিক্ষাবিদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রকল্প ভাষাবিদ হিসেবে দুটি পৃথক স্বর্ণপদক দিয়ে সম্মানিত করে। এসব পুরস্কার ও সম্মাননা ছাড়াও তিনি শেরে বাংলা পুরস্কার, সুফি মোতাহার হোসেন স্বর্ণপদক, নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদক, মধুসূদন পুরস্কার ইত্যাদি লাভ করেন।

ইংরেজি ও বাংলায় রচিত তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে: আওয়ার হেরিটেজ (১৯৪৮); ইকবালের কবিতা (অনুবাদ, ১৯৫২); কবিতার কথা (১৯৫২); নজরুল ইসলাম (১৯৫৪); বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত---আধুনিক কাল (মুহম্মদ আব্দুল হাই-এর সঙ্গে যৌথভাবে, ১৯৫৬); প্রেমের কবিতা (ফরাসি ভাষায় অনুবাদ, ১৯৫৯); ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতা (১৯৬৫); পদ্মাবতী (সম্পাদনা, ১৯৬৮); কাব্যসমগ্র (১৯৭৪); রবীন্দ্রনাথ: কাব্যবিচারের ভূমিকা (১৯৭৪); জার্মান সাহিত্য (১৯৭৬); বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস---প্রাচীনযুগ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস---মধ্যযুগ (২০০১); অনেক আকাশ (১৯৬০); উচ্চারণ (১৯৬৮); আমার প্রতিদিনের শব্দ (১৯৭৩); কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা (১৯৬৮); ইত্যাদি।

২০০২ সালের ২৫ জুলাই তার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনর চিরঅবসান ঘটে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।

(তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া ও অন্যান্য)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক