Web bengali.cri.cn   
চীনের সং রাজবংশের মহিলা কবি লি ছিং চাও
  2013-02-27 14:42:57  cri
১০৮৪ সালে লি ছিং চাও সেন তং প্রদেশের চিনানে জন্মগ্রহণ করেন। চীনের ইতিহাসে চিনান একটি বিখ্যাত শহর ছিল। এই শহরে অনেক সুন্দর জায়গা ছিল। এখানকার ডামিং হ্রদ এবং ছিয়েহু পাহাড়ের দৃশ্য অত্যন্ত সুন্দর। ইতিহাস বলছে, ছোটবেলায় লি ছিং চাও তার বড় বোন ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে এ-দুটো জায়গায় বেড়াতে যেতেন। সেখানে তারা একসঙ্গে ছবি আঁকতেন এবং কবিতা আবৃত্তি করতেন। ছোটবেলা থেকে লি ছিং চাও বই পড়তে পছন্দ করতেন এবং কবিতা লিখতেন।

লি ছিং চাওয়ের বাবা-মা প্রাচীনকালের কবিতা রপ্ত করেছিলেন। বাবা-মার প্রভাবে লি ছিং চাও ছোটবেলা থেকেই চীনের প্রাচীনকালের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি অজস্র সাহিত্যবিষয়ক বই পড়েছেন। কবিতা লিখতে তার বিশেষ কৌতুহল ছিল। যখন তাঁর বয়স সাত বছর তখন তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। যখন তাঁর বয়স ১৫ বছর তখন তিনি সারা দিন বই পড়েন এবং কবিতা লেখেন। তিনি কেবল প্রাচীনকালের বিখ্যাত সাহিত্যিক বা কবিদের বই বারবার পড়তেন তাই নয়, তাদের লেখা কবিতাগুলো দেখে দেখে বারবার লিখতেনও। এ-পদ্ধতিতে তিনি অনেক কবিতা মুখস্ত করেন।

এক সময় লি ছিং চাওয়ের বাবা লি গে ফেই রাজদরবারে নিয়োগ পান। তাঁর বাবা মাঝেমাঝে লি ছিং চাওকে সঙ্গে নিয়ে রাজদরবারে যেতেন। একদিন তাঁর বাবা বেশ কয়েকজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর সঙ্গে বাইরে বেড়াতে গেলেন। ফিরে আসার সময় তিনি লি ছিং চাওয়ের জন্য একটি বই নিয়ে আসলেন। ভাত খাওয়ার পর তাঁর বাবা বইটি লি ছিং চাওকে দিয়ে বললেন: 'এই বই আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর। তিনি একজন বিখ্যাত কবি। সবাই বলেন তার লেখা কবিতা খুব ভাল। তুমি ভালভাবে তার কবিতা পড়বে।' লি ছিং চাও এই কবিতা বই নিষ্ঠার সঙ্গে পড়তে শুরু করেন। পড়তে পড়তে তিনি লক্ষ্য করলেন যে, এ সব কবিতায় চীনের থাং রাজবংশের সমৃদ্ধির প্রশংসা করা হয়েছে। লেখার ষ্টাইলও ভিন্ন রকমের। তবে, পাশাপাশি তার মনে এ-ভাবনারও উদয় হলো যে, বইটিতে কেবল থাং রাজবংশ আমলের সমৃদ্ধির বর্ণনা দেয়া হয়েছে; থাং রাজবংশ আসলের দুর্নীতির কথা কবিতায় উঠে আসেনি। তারপর তিনি একই স্টাইলে দু'টো কবিতা লিখলেন। তার এ দুটো কবিতাতে তিনি নিজের ধারণা প্রকাশ করলেন।

একদিন লি ছিং চাওয়ের বাসায় বেশ কয়েকজন মেহমান আসলেন। খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর সকলেই সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করলেন। লি ছিং চাও বড়দের পাশে বসে তাদের আলোচনা শুনলেন। কিছুক্ষণ পর মেহমানদের মধ্যে একজন লোক লি ছিং চাওয়ের বাবা লি গে ফেইকে বললেন: 'আপনি তো বতর্মানের নাম-করা পন্ডিত। আপনার মেয়ে নিশ্চয়ই কবিতা লিখতে পছন্দ করে। আজকে সবাই এখানে আছি। আপনার মেয়ে কি আমাদের সামনে তার মেধা একটু প্রদর্শন করতে পারবে?'

লি ছিং চাওয়ের বাবা লি ছিং চাওকে তার সাম্প্রতিক লেখা দু'টো কবিতা দেখাতে বললেন। লি ছিং চাও বাবার কথা শুনে তার লেখা দুটো কবিতা মেহমানদেরকে দিলেন। তারা পালা করে লি ছিং চাওয়ের এ দুটো কবিতা পড়ে ফেললেন। অবশেষে সবাই লি ছিং চাওয়ের লেখা দুটো কবিতার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। তাদের মধ্যে একজন বললেন: 'অল্প বয়স্ক একটি মেয়ে এতো চমত্কার কবিতা লিখতে পারে! কবিতাতে যে-ধারণা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা খুবই যুক্তিযুক্ত। কবিতার শব্দগুলোও খুব সুন্দর হয়েছে। মনে হয় এ-কবিতা একজন বিখ্যাত কবির হাতের লেখা।' মেহমানদের প্রশংসা শুনে লি ছিং চাওয়ের বাবা ভীষণ খুশী হলেন। তখন থেকে তিনি মেয়ের ব্যাপারে বেশি বেশি আগ্রহ দেখাতে শুরু করলেন।

যখন লি ছিং চাওয়ের বয়স ১৮ বছর তখন তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী চাও ঠিং জির ছেলে চাও মিং ছেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। চাও মিং ছেন কেবল চমত্কার কবিতা লিখতে পারতেন তাই নয়, তিনি পুরার্কীতি সংগ্রহ করতে পছন্দ করতেন। বিয়ের পর তিনি রাজধানীতে পড়াশুনা করতে গেলেন। তখন তার স্থায়ী উপার্জন ছিল না। মাঝে মাঝে তিনি নিজের কাপড়চোপড় বিক্রি করে তার পছন্দমতো বই বা পুরার্কীতি কিনতেন। তার স্বামীকে সাহায্য করার জন্য লি ছিং চাও নিজেও অত্যন্ত হিসেব করে চলতেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত ভাল ছিল। তারা দু'জন মাঝে মাঝে একসঙ্গে কবিতা লিখতেন। সময় পেলে দু'জন কবিতা নিয়ে আলোচনা করতেন। কবিতা লিখতে দু'জন পরস্পরকে সাহায্যও করতেন। তারা দু'জনই স্থানীয় লোকজনের মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। সবাই তাদের প্রশংসা করতেন।

১১২৬ খৃষ্টাব্দে লি ছিং চাওয়ের স্বামী চাও মিং জি রাজদরবারে নিয়োগ পান। তখন লি ছিং চাওয়ের বয়স ৪৩ বছর। এর আগে তাদের জীবন অপেক্ষাকৃত শান্ত ছিল। তারা দু'জন অনেক কবিতা লিখেছেন। তা ছাড়া, তার স্বামী চাও মিং জি অনেক মূল্যবান পুরার্কীতি সংগ্রহ করেছেন। তারা দু'জন যৌথভাবে ইতিহাস সম্পর্কিত একটি বই লেখার কাজও সম্পন্ন করলেন। কিন্তু ঠিক সে-বছরে উত্তরাঞ্চলের চীন রাষ্ট্র দক্ষিণাঞ্চল আক্রমণ করতে শুরু করল। শুরু হল জাতিগত যুদ্ধ। সুতরাং লি ছিং চাওয়ের শান্ত জীবন নষ্ট হল।

একদিন লি ছিং চাওয়ের স্বামী চাও মিং জি বাইরে থেকে তাড়াহুড়া করে বাসায় ফিরলেন। তা দেখে লি ছিং চাও স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন: 'আজ আপনাকে অস্থির লাগছে। কী ব্যাপার? আমাকে বলুন।' চাও মিং জি উত্তর দিলেন: 'পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ। দু'জন রাজা এখন চীন বাহিনীর হাতে বন্দি হয়েছেন। সং রাজবংশের পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ।'

'কেন কি শত্রুদের প্রতিরোধ করছে না? এ-সব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা গেলেন কোথায়?' লি ছিং চাও আবেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন। চাও মিং জি উত্তর দিলেন: 'কে জানে! শুনেছি রাজদরবারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই পালিয়ে গেছেন।'

'তাহলে আমরা কী করবো?' লি ছিং চাও জিজ্ঞেস করলেন।

'এখানে আর থাকতে পারবো না। আমাদেরকে এখান থেকে তাড়াতাড়ি দক্ষিণাঞ্চলে যেতে হবে।' চাও মিং জি বললেন।

'আমাদের এত মূল্যবান জিনিস কিভাবে নিয়ে যাবো? গত বিশ বছর ধরে আমরা প্রায় দশটি ঘরভর্তি পুরার্কীতি সংগ্রহ করেছি।' হতাশ হয়ে বললেন লি ছিং চাও।

'কোন উপায় নেই। এতো বেশী জিনিস একসাথে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। আমরা মাত্র কিছুটা সঙ্গে নিতে পারি।' চাও মিং জি বললেন।

চাও মিং জির জন্মস্থান নানচিন। তখন চাও মিং জির মা গুরুতর অসুস্থ্য হয়ে পড়লেন। সুতরাং লি ছিং চাও ও তার স্বামী চাও মিং জি তাড়াতাড়ি নানচিনে চলে গেলেন। তাদের সংগৃহীত অধিকাংশ মূ্ল্যবান পুরার্কীতি যুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে গেল।

নানচিনে এক বছর থাকার পর লি ছিং চাও তার স্বামী চাও মিং জির সঙ্গে আনহুয়ের জিইয়াংয়ে আশ্রয় নিলেন। এক বছর পর চাও মিং জি জে চিয়ান প্রদেশের হুচৌর গর্ভনর হিসেবে নিয়োগ পান। লি ছিং চাও আপাতত নিজেই জিইয়াংয়ে অবস্থান করলেন। একদিন যখন লি ছিং চাও তার স্বামী চাও মিং জিকে চিঠি লিখছিলেন তখন তার কাজের মেয়ে এসে বলল: 'ম্যাডাম, স্যার একজন লোকের মাধ্যমে আপনার জন্য চিঠি পাঠিয়েছেন। এখন লোকটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।' 'তাড়াতাড়ি তাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে আস।' লি ছিং চাও আগ্রহভরে বললেন। লি ছিং চাওকে দেখে আগত লোকটি বলল, 'ম্যাডাম, আপনার স্বামী গুরুতরভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন। আপনাকে তাড়াতাড়ি তার কাছে যেতে হবে।'

হুচৌ পৌছার পর বোঝা গেল, স্বামী চাও মিং জি হুচৌ পৌছার কিছুদিন পরই অসুস্থ্য হয়ে পড়লেছিন। অনেক চিকিত্সা নেওয়ার পরও কোন উন্নতি দেখা গেলনা। অসুস্থ্য স্বামীকে দেখে লি ছিং চাও অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে পড়লেন। তখন চাও মিং জি স্পস্টভাবে কথাও বলতে পারেন না। কয়েক দিন পর চাও মিং জি মারা গেলেন। লি ছিং চাও তিন দিন তিন রাত কাঁদলেন। স্বামীকে কবর দেয়ার পর লি ছিং চাও জানালার সামনে বসে কবিতা লিখতে শুরু করলেন। কবিতার নাম 'সেনসেনমেন'। এই কবিতা ছিল লি ছিং চাওয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা। এই কবিতায় দেশের তত্কালীন অবস্থা ও তাদের যেখানে-সেখানে আশ্রয় নেয়ার দৃশ্য সুন্দরভাবে বর্ননা করা হয়েছে।

চীনের সাহিত্যক্ষেত্রে লি ছিং চাওয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে। তিনি চীনের ইতিহাসের একজন বিখ্যাত মহিলা কবি।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক