|
1030lvyou
|
জন্মস্থান প্রত্যেকের কাছেই একটি পরিচিত ও সুখী জায়গা। আজকাল অনেককেই জীবন ও জীবিকার জন্য জন্মস্থান ছেড়ে অন্যত্র যেতে হয়। কিন্তু জন্মস্থানের প্রতি টানটা কিন্তু থেকেই যায়। কুইচৌ প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল তং জাতির জন্মস্থান। তং জাতির জন্মস্থান তাদের জন্য বিশেষ তাত্পর্য বহন করে। পর্যটকদের জন্যও এটি একটি স্বপ্নের মতো স্থান। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা আপনাকে নিয়ে তং জাতির জন্মস্থানে বেড়াতে যাব। চলুন তাহলে, বেড়িয়ে আসি।
আলিম. বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টিতে শাংহাই একটি আধুনিক শহর, সি'আন একটি ঐতিহাসিক শহর এবং লিচিয়াং জেলা দর্শনীয় স্থান। তবে, কুইচৌ প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে তং জাতির বসবাস এলাকা আদি ও অকৃত্রিম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যেন ভরপুর। স্থানীয়দের জীবনযাপন প্রণালীও দেখার মতো।
সুবর্ণা. গাড়িতে পাহাড়ি পথ ধরে কুইচৌ শহর থেকে তুলিউচিয়াং নদী বরাবর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে যাওয়া যায়। প্রাচীনকালে থেকেই তুলিউচিয়াং নদীটি কুইচৌ মালভূমি থেকে কুয়াংতুং ও কুয়াংসি যাওয়ার সুবিধাজনক পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বছরের চার ঋতুতেই এই নদীপথে ভাসমান বাঁশের ভাসমান স্তুপ দেখা যায়; এসব বাঁশ ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এক স্থান থেকে অন্যস্থানে। তং জাতির লোকর বিশ্বাস করে যে, প্রাচীনকালে তাদের পূর্বপুরুষ কুয়াংসি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল থেকে এসে তুলিউচিয়াংয়ের দু'পাশে বসবাস করতে শুরু করেছিল। আপনাকে নিয়ে গাড়ি যখন রোংচিয়াং জেলার কাছাকাছি চলে আসবে, তখন থেকেই আপনি তং জাতির বৈশিষ্ট্য অনুভব করতে শুরু করবেন। আপনি দেখবেন নদীতে ছোট সেতু, গ্রামের বহুবর্ণ ঢোল টাওয়ার এবং তং জাতির বিশেষ পোশাক পরিহিতা রমণী।
আলিম. আচ্ছা, শ্রোতা, গান শোনা হল। গানটির শিরোনাম দেওয়া যেতে পারে সানতু প্রেমের গান। তং জাতির লোকেরা প্রাচীনকাল থেকেই প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে থাকার নীতি মেনে আসছে। তাদের বাড়িঘর দেখলেও বোঝা যাবে প্রকৃতির সাথে তারা কী নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। কাঠ দিয়ে তৈরী মাচান-ঘরে প্রবেশ করলেই আপনার নাকে ভেসে আসবে কাঠের সুগন্ধ। রাতের বেলা তং জাতির গ্রামে সুনসান নিরবতা আপনাকে দেবে বৃষ্টির শব্দ ও নানা ধরনের পোকার ডাক স্পষ্টভাবে শোনার সুযোগ। নির্মল এক প্রশান্ত পরিবেশে আপনি কখন ঘুমিয়ে যাবেন, টেরও পাবেন না।
সুবর্ণা. রাতের মিষ্টি ঘুমের পর ভোরবেলায় বিছানা ছেড়ে নাস্তা খেয়ে আপনি ওয়াংতুং উপজেলার বিখ্যাত ঢোল টাওয়ার দেখার জন্য ছুটতে চাইবেন। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে প্রায় নয় কিলোমিটার হেঁটে আপনাকে পৌঁছাতে হবে সেখানে। তং জাতির লোকদের কাছে এই ঢোল টাওয়ার সবচে বড়, পুরনো ও সুন্দর। তিন শতাধিক বছর আগে এটি নির্মিত হয়েছিল। তো, ঢোল টাওয়ারের কাছে পৌঁছাতে আপনাকে পাহাড়ি পথে ঘন্টা খানেক হাঁটতে হবে। তারপর একসময় আপনি দেখতে পাবেন দুই শতাধিক মাচান-ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ঢোল টাওয়ার। তবে আপনি যদি ঢোল টাওয়ারের আসল রূপ দেখতে চান, তাহলে আপনাকে গ্রামের পাহাড়ে উঠতে হবে। কয়েকশ মিটার দূরের পাহাড়ের চূড়া থেকে গোটা গ্রামটিকে ছবির মতো সুন্দর দেখাবে। আপনি দেখবেন তং জাতির গ্রামের চার দিকে পাহাড়, তিন দিকে নদী। আপনি আরো দেখবেন পাহাড়ের কোল ঘেষে নদী, নদীর কোল ঘেষে গ্রাম, আর গ্রামের কোলে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ঢোল টাওয়ার। সে এক অপরূপ সুন্দর দৃশ্য। প্রকৃতির আশ্চর্য সৌন্দর্য দেখে আপনি মোহিত হবেন।
আলিম. বাহ্, কী চমত্কার বর্ণনাই না দিলেন আপনি সুবর্ণা! এমন একটা সুন্দর গ্রামে যারা বসবাস করেন, তারা দারুণ ভাগ্যবান আর সুখী নিশ্চিয়ই। প্রতিদিন এ-সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। প্রিয় শ্রোতা, তং জাতির গ্রামের রাস্তা নূড়ি-পাথরের; দেখতে সুন্দর। বর্ষাকাল রাস্তায় পানি জমে থাকে না এবং থাকে না বালিও। এ-রাস্তায় আপনি যদি খালি পায়ে হাঁটেন, তবে আপনার মনে হবে যে, রাস্তা আপনার পায়ের তালু মাসাজ করে দিচ্ছে। স্বাস্থ্যের জন্য এটি খুবই ভালো। আগেই বলা হয়েছে, ঢোল টাওয়ার হচ্ছে তং জাতির গ্রামের সবচে আকর্ষণীয় ও উঁচু স্থাপত্য। গ্রামের যে-কোনো পথ ধরে ঢোল টাওয়ার পর্যন্ত আসা যায়। পূর্বপুরুষদের তৈরি করা নিয়ম অনুসারে, তং জাতির লোকেরা একটি গ্রাম গড়ে তোলার সময় সবার আগে একটি ঢোল টাওয়ার নির্মাণ করে। যদি কোনো গ্রাম আগুনে পুড়ে যায় বা অন্যকোনো প্রাকৃতিক দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয়, তবে সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত ঢোল টাওয়ার মেরামত করা হয়। সাধারণত ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত ঢোল টাওয়ারের আগের স্থানেই সেটি পুনরায় নির্মাণ করা হয়।
সুবর্ণা. ঢোল টাওয়ার সম্পর্কে আমরা কিন্তু আগের একটি অনুষ্ঠানেও কিছু তথ্য দিয়েছিলাম। তো এখন কুইচৌ প্রদেশের একটি লোকসংগীত শুনবো আমরা। কুইচৌ পাহাড়কে নিয়ে গানটি গাওয়া হয়েছে।
আলিম. তং জাতির লোকজন ধিরস্থির ও সরল। তাদের সারল্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। তো চলুন আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিই তং জাতির আরেকটি গ্রামের সঙ্গে। চানলি একটি ছোট গ্রামের নাম। অতি ছোট বিধায় কোনো ম্যাপেই আপনি একে খুঁজে পাবেন না। তাতে কী! এ গ্রামের মানুষের জীবন দারুণ সুন্দর। তারা খুব আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করেন। গ্রামে মাত্র ১০০টি পরিবারের বাস। ১৯৫৩ সালে গ্রামের লোকসংখ্যা ছিল ৭২০ জন। ২০০০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭২১ জনে। অর্থাত, গত ৫০ বছরে লোকসংখ্যা বেড়েছে মাত্র ১ জন। তং জাতির পূর্বপুরুষদের তৈরি করা নিয়ম এক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছে। তার শিখিয়েছেন যে, চানলি হচ্ছে একটি নৌকার মতো। নৌকার যাত্রী অতিরিক্ত হলে তা ডুবে যায়। সুতরাং যাত্রী তথা লোকসংখ্যা সীমিত রাখতে হবে। এ গ্রামে অনেক আগে থেকেই, পরিবারপিছু দু'টির বেশি সন্তান নেওয়ার নিয়ম নেই।
সুবর্ণা. দু'টি সন্তানের মধ্যে একটি মেয়ে ও একটি ছেলে হলে বেশ ভালো হয়। চানলি গ্রামের ১৬৮টি পরিবারের মধ্যে ১৫৬টি পরিবারেই একটি ছেলে ও একটি মেয়ে! বিষয়টি অবাক করার মতো, তাই না? এ গ্রামে একধরনের চমত্কার ভেষজ ওষুধ পাওয়া যায়। বিশ্বাস করা হয় যে, এ ওষুধ বাচ্চার লিঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। পরিবারের প্রথম বাচ্চাটি ছেলে হলে, গৃহবধু দ্বিতীয় বাচ্চা জন্ম দেওয়ার আগে মেয়ে-সন্তানের আশায় নির্ধারিত ওষুধ খেয়ে থাকেন; আর প্রথম বাচ্চা মেয়ে হলে, করতে হয় উল্টোটা। তখন তাকে খেতে হয় ছেলে সন্তানের আশায় নির্ধারিত ওষুধ। গোটা বিষয়টি চিকিত্সা-বিজ্ঞান দিয়ে ঠিক ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবে কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ওষুধে কাজ হতে দেখা যায়। ব্যাপারটিকে কেউ কেউ ঘটনাচক্র বলতে পারেন। ওষুধের একটি মজার নাম আছে। এর চীনা নামের বাংলা অর্থ হচ্ছে: 'ফুল ও ঘাস বিনিময় ওষুধ'। গ্রামের একজন বৃদ্ধ মহিলা এই ওষুধ প্রস্তুত করেন ও এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করেন। গ্রামবাসীরা ওষুধের উপাদান সম্পর্কে কিছুই জানে না। এ ওষুধ প্র্রস্তুতের পদ্ধতি কেবল জাতির যোগ্যতম নারীকেই শেখানো হয়। এ নিয়ম চলে আসছে বহুকাল ধরে।
আলিম. সত্যিই খুবই মজার ব্যাপার। ব্যাপারটাকে আসলে ঘটনাচক্র বললে অন্যায়ই করা হবে। আমার তো মনে হয় ওই ভেষজ ওষুধ নিয়ে গবেষণা করলে একটা কিছু বের হয়ে আসবে বা এর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেলে যেতেও পারে। সে যাক, এবার আমরা আরেকটি গান শুনবো। গানের নাম তং জাতির সুর। গায়িকা চীনের বিখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী সোং জু ইং। চলুন তার মিষ্টি কণ্ঠে শুনি মিষ্টি এই গানটি।
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |