Web bengali.cri.cn   
শিক্ষার উন্নয়নে একজন শহিদুলের অবদান
  2011-08-30 16:51:53  cri

সমাজ সংসারে কিছু মানুষ থাকে যারা নিজেদের ভোগ বিলাস আর অর্থ ও প্রতিপত্তির চেয়ে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারার আনন্দটাকেই পরম পাওয়া মনে করেন। সামাজিক কল্যাণের জন্য তারা বিনা দ্বিধায় নিজেদের উত্সর্গ করেন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই। সারা বিশ্বজুড়ে এমন মানুষ রয়েছেন অনেক, যারা সাধারণত থাকতে পছন্দ করেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। তারা প্রচার প্রিয় নন। এমন অনেক মহত মানুষের কথাই আমরা জানি। আবার জানিনা অনেকের কথাই।

চীনে আরো অনেকের মধ্যে এমন একজন মানুষের কথা আপনারা আমাদের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুনেছেন। চীনের সেই সামান্য কাবাব বিক্রেতা তার কাবাব বিক্রি করে অর্জিত সব টাকা ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ায় সহায়তা ও শিক্ষা ক্ষেত্রের উন্নয়নে বিলিয়ে দিচ্ছেন, নিজের বা নিজের পরিবারের জন্য কিছুই সঞ্চয় করে রাখছেন না। তেমনি বাংলাদেশেও আরো অনেকের মধ্যে এমন একজন আছেন যিনি সামান্য ফেরিওয়ালা মাত্র। তিন চাকার একটি রিকসা ভ্যান নিয়ে পথে পথে ঘুরে ফেরি করে বিক্রি করেন হরেক রকম প্লাস্টিকের পণ্য। এটাই তার পেশা বেঁচে থাকার অবলম্বন। তার ক্রেতারাও হচ্ছেন নিম্ন আয়ের লোকজনেরা।

ইনি হচ্ছেন বাংলাদেশের যশোর জেলার সদর উপজেলার কৃষ্ণবাটি গ্রামের তিরিশ বয়সের ভ্যান চালক ফেরিওয়ালা শহিদুল ইসলাম। যিনি বাংলাদেশের যশোরের এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীসহ সকলের কাছে একজন নিবেদিত মানুষ হিসেবে পরিচিত। তাকে দেখলেই শিক্ষার্থিরা উত্ফুল্ল হয়ে ওঠে।

ভ্যান চালিয়ে প্লাস্টিকের দ্রব্য ফেরি করেন তিনি। প্রতিদিন তার আয় হয় গড়ে ২০০ টাকার মত। তা থেকে তিনি ১০০ টাকা রেখে দেন সংসার ও ব্যবসার জন্য। বাকি ১০০ টাকা রেখে দেন এতিম ও গরিব শিক্ষার্থীদের মধ্যে খাতা-কলমসহ শিক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করার জন্য। এভাবে তার জমানো টাকা দিয়ে তিনি যে সব শিক্ষার্থীরা অভাবের কারণে লেখাপড়ার জন্য স্কুলে ভর্তি হতে পারে না সে সব শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন এবং যারা লেখাপড়ার ব্যয় বহন করতে পারছে না সেই সব গরিব মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দেন। প্রয়োজনে তাদের বিদ্যালয়ে যাবার জন্য পোশাকআশাক কিনে দেন। অথচ তার নিজের গায়ে লেপ্টে আছে একটি অতি পুরোনো জামা আর পরনে অতি ব্যবহৃত রংচটা একটি লুঙ্গি। তিন বছর ধরে শহিদুল এভাবেই তাঁর জ্ঞানের আলো ফেরি করছেন। এ কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি শিক্ষাবন্ধু নামে পরিচিতি পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি যশোরের ১৪টি বিদ্যালয়ের ২০০ এতিম, অসহায়, গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত খাতা-কলমসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা সামগ্রী দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।

ফকরে আলমের এ প্রতিবেদন তৈরির দিন এলাকার খড়কি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ৯ জন এতিম শিক্ষার্থীর মধ্যে শিক্ষাবন্ধু খাতা-কলম বিতরণ করছিলেন। খাতা-কলম পেয়ে এ বিদ্যালয়ের লাবণী, তানজিয়া, রুবিনা, শারমিন, মুকুল, আরমান, রুবেল বেজায় খুশি। তাদের মধ্যে লাবণীর বাড়ি মণিরামপুর। সে এতিম। স্থানীয় একটি এতিমখানায় থেকে খড়কির এই বিদ্যালয়ে পড়ে। লাবণী বলে, 'শিক্ষাবন্ধুই আমার সব খাতা-কলমের জোগান দেন। উনি খুব ভালো মানুষ।' পঞ্চম শ্রেণীর সেরা ছাত্র মুকুল। সেও এতিম। আঞ্জুমানে খালেকিয়া এতিমখানায় থাকে। মুকুল বলে, 'খাতা ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই শিক্ষাবন্ধু খাতা-কলম নিয়ে হাজির হন। আমি যে ক্লাসে প্রথম হই, তাতেও তাঁর অবদান রয়েছে। তিনি আমাদের সব সময় খোঁজ-খবর নেন। পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়ার কথা বলেন।'

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহজাদ হোসেন বলেন, 'আমার বিদ্যালয়ের ৪৭ জন এতিম শিক্ষার্থীকে তিনি নিয়মিত খাতা-কলম দেন। এ ছাড়া তিনি পড়াশোনার খোঁজ-খবর নেন। ঝরে পড়া ছাত্রদের ভর্তি করানোর জন্য নিয়ে আসেন। আমরা তাঁর কর্মকাণ্ড দেখে অভিভূত হই। শহিদুল খুবই গরিব। কিন্তু শিক্ষার প্রতি তাঁর রয়েছে প্রবল আগ্রহ।' বিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহিদা খাতুন বলেন, 'তিন বছর ধরে তাঁকে আমি চিনি। আমি তাঁর মুখে কখনো দুঃখের ছাপ দেখিনি। সারাক্ষণ তার মুখে শুধু হাসি জড়িয়ে থাকতে দেখেছি।'

শহিদুল ইসলাম যশোরের ফকরে আলমের সাথে কথা বলার সময় জানান, ফেরি করার পাশাপাশি তিনি নিজেই বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে এতিম এবং গরিব শিক্ষার্থীদের তালিকা করেন। অর্থ সংগ্রহের জন্য তিনি অধিক রাত পর্যন্তও ফেরি করে বেরান। এর মাঝেই তিনি নিজে লেখাপড়া করতে না পারলেও তার জীবনের আনন্দ খুঁজে পান একটু হলেও।

শহিদুল ইসলাম জানান, 'আড়াই বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। মা বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাজ করে তাকে কোনমতে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে ছিলেন। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত তিনি পড়ালেখা করতে পেরেছেন। তিনি জানান' চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত তিনি কোনদিন ক্লাসে প্রথম স্থান ছাড়া দ্বিতীয় স্থান আধিকার করে নি। অথচ, পঞ্চম শ্রেণীতে ওঠার পর সংসারের অভাবের কারণে অর্থাভাবে আর লেখাপড়া আর চালিয়ে যেতে পারেননি। সংসার চালানোর টাকা যোগার করতে গিয়ে তাঁকে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়। তখন থেকেই শুরু হয় তার ভ্যান-রিকশা চালানো। এরই মধ্যে মা মারা গেছেন। তিনি বিয়ে করেছেন আর এখন সংসারে রয়েছে স্ত্রী ও একটি ফুট ফুটে কন্যা। টাকার অভাবে কারো পড়া বন্ধ হলে, স্কুলে ভর্তি হতে না পারলে বা কেউ বই-খাতা কিনতে না পারলে তাই তার ভেতর বড় কষ্ট হতো। আর এ কষ্টের কারনেই তার এ উদ্যোগ। সময়, সুযোগ আর অর্থ সংগ্রহ করতে পারলে তিনি তার এ সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করতে চান আরো বেশি অভাবগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে।

আমাদের সামাজিক জীবনে চীনের ভ্যানগাড়ির কাবাব বিক্রেতা এবং বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র ভ্যানচালক শহিদুলের মত করে একটু হলেও স্বচ্ছল ব্যক্তিরা যদি তাদের উদার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন, তাহলে হত দরিদ্র সাধারণ মানুষের সন্তানেরা তাদের শিক্ষার মাধ্যমে নিজেদের উন্নতির পাশাপাশি দেশ জাতির কল্যাণে নিজেদের নিবেদন করতে পারে অবলীলায়। এত করে পরনির্ভরশীলতার চাপও ধীরে ধীরে দূরিভূত হতে পারে সহজেই।– আবাম. ছালাউদ্দিন।

(বাংলাদেশের যশোরের ফকরে আলমের তথ্য অবলম্বনে)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্যের পাতা
ভিডিও চিত্র
সাক্ষাত্কার
চিঠিপত্র
Play Stop
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040