|
গত বছরের ১১ মার্চ ভূমিকম্প ও তার ফলে সৃষ্ট ভয়াবহ সুনামির কবলে পড়ে জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি ছিল দেশটির জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। এতে প্রায় ১৯ হাজার মানুষ প্রাণ হারায় এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় ব্যাপক। অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ধস নামে রপ্তানি বাণিজ্যে। তবে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হিসেবে দেখা দেয় ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রের চুল্লিতে বিস্ফোরণ। এ ঘটনার ফলে বিদ্যুত্ উত্পাদনে ব্যবহৃত দেশটির ৫৪টি পরমাণু চুল্লির মধ্যে ৫২টি বন্ধ করে দিতে হয়। এতে জ্বালানি আমদানি বেড়ে যায় ব্যাপকভাবে এবং তার ফল হিসেবে বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেয়।
নেতিবাচক এ ধারা থেকে অর্থনীতির গতি ফেরাতে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে জাপান সরকার। দুই দফায় মোট ৬৫ ট্রিলিয়ন ইয়েন দেওয়া হয় এ প্যাকেজের আওতায়। পাশাপাশি বিনিয়োগ বাড়াতে সুদের হারও শূন্য থেকে ০.১ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়। কিন্তু এতো উদ্যোগের পরও গতি ফেরেনি দেশটির অর্থনীতিতে, যদিও ওই দুর্যোগের পর ইতোমধ্যে এক বছর পার হয়ে গেছে।
জাপানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসেবে দেখা যায়, ২০১১ সালে দেশটির আমদানি বাড়ে ১২ শতাংশ অথচ রপ্তানি কমে যায় ২.৭ শতাংশ। এতে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ২.৪৯ ট্রিলিয়ন ইয়েন বা ৩২ বিলিয়ন ডলারে। উনিশ শ আশি সালের পর এটাই জাপানের প্রথম বাণিজ্য ঘাটতি। তেল সংকটের কারণে ১৯৮০ সালে আমদানি বেড়ে যাওয়ায় দেশটিতে বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছিল ২.৬ ট্রিলিয়ন ইয়েন।
জাপানের মন্ত্রিপরিষদ দপ্তর জানায়, ২০১১ সালের শেষ প্রান্তিকে রপ্তানি কমে অর্থনীতি এক বছর আগের একই সময়ের তুলনায় ০.৬ শতাংশ সংকুচিত হয়। পুরো বছরে সংকুচিত হয় ০.৯ শতাংশ। দু হাজার দশ সালে জাপানের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪.৪ শতাংশ। সর্বশেষ জানুয়ারির হিসাবে দেখা যায়, এ মাসেও রপ্তানি কমে বাণিজ্য ঘাটতি পৌঁছায় রেকর্ড ৪৩৭.৩ বিলিয়ন ইয়েনে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কার্যক্ষম পরমাণু চুল্লির সংখ্যা কমে যাওয়ায় ব্যাপক পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করতে হচ্ছে বলে চলতি বছরও বাণিজ্য ঘাটতিতে থাকবে জাপান।
তবে দেশটির অর্থনীতির দুরস্থার জন্য কেবল সুনামিই দায়ী নয়। সুনামি থেকে সৃষ্ট ক্ষতি কাটিয়ে উঠার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিল যখন জাপান, তখন মরার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে দেখা দেয় থাইল্যান্ডের বন্যা, ইয়েন শক্তিশালী হওয়া এবং ইউরোপের অর্থনৈতিক সংকট। এ তিনটি কারণ অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টাকে গুরুতরভাবে ব্যাহত করে।
জাপানের বহু প্রতিষ্ঠানের কারখানা রয়েছে থাইল্যান্ডে। দীর্ঘ বন্যায় সেসব প্রতিষ্ঠানের উত্পাদন ও সরবরাহ কার্যক্রম বিঘ্নিত হয় ভীষণভাবে। অন্যদিকে ইউরোপে অর্থনৈতিক সংকট লেগে থাকায় সেখানে জাপানের রপ্তানি কমে যায়। আর জাপানি মুদ্রা ইয়েন শক্তিশালী হওয়ায় রপ্তানি আয় কমে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তবে এতো কিছুর মধ্যেও অর্থনীতিবিদরা আশা করছেন এ বছর জাপানের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধিতে ফিরবে। টোকিওর সিনকিন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের হিরোশি মিয়াঝাকি বলেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা এবং রপ্তানি বৃদ্ধির ফলে বছরের প্রথম প্রান্তিকেই প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে। তবে তিনি উল্লেখ করেন, এখনও অর্থনীতির সামনে অনেক ঝুঁকি রয়েছে।
মিয়াঝাকির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে জাপানের বৃহত্তম ব্যবসায়ী লবি কিডেনরেনের প্রধান হিরোমাসা ইয়োনেকুরা বলেন, "যদিও ঘাটতি দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তবে আমরা আশা করছি বিষয়টি সাময়িক হবে। অবশ্য ইয়েন যদি শক্তিশালী হওয়া অব্যাহত থাকে, তবে এটা ভয়াবহ সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।"
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধংসস্তুপের মধ্য থেকে রপ্তানি বাণিজ্যে শীর্ষ তালিকায় উঠে আসে জাপান। বিশেষ করে গাড়ি বাজার ও ইলেকট্রনিকস পণ্য রপ্তানিতে দেশটি চলে আসে চালকের আসনে। কিন্তু গত বছরের ভয়াবহ ভূমিকম্প ও সুনামি সেই অগ্রযাত্রাকে থমকে দেয়। তবুও দেশটির অর্থনীতি চলতি বছর উঠে দাঁড়াবে এমনই আশা দেশটির নীতিনির্ধারকদের। (এসআর)
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |