|
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের অর্থনীতির দ্রুত উন্নতি হয়েছে এবং জনধারণের জীবনযাত্রাও অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু পরিবেশের দূষণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের ওপর গুরুতরভাবে প্রভাব ফেলেছে। যদিও পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে চীন সরকার অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে তবুও পরিবেশ উন্নত করার জন্য আমাদের অনেক কিছু করার আছে।
এক সাক্ষাত্কারে পেইচিংয়ের মিস ওয়াং বলেন, তার ছোটবেলায় পেইচিংয়ে মাঝেমাঝে বালি ঝড় দেখা দিত। তার স্মৃতিতে প্রায় দুই তিন পর পর বালি ঝড় ঘটত। বালি ঝড় ঘটলে এক মূহুর্তে আকাশ কালো হয়ে যেত। বালি ঝড় শেষ হওয়ার পর , জালানা ও বাড়িঘরের ছাদে বালি জমে যেত। বেশ কয়েক বছরের সংস্কারের ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পেইচিংয়ে বালি ঝড় খুব কম দেখা দেয়। কিন্তু বতর্মানে হাওয়া দূষিত হয়। মাঝেমাঝে নিশ্বাস নিতে কষ্ট লাগে ।
মিস ওয়াং ঠিকই বলেছেন। নি:সন্দেহে সংস্কারের পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পেইচিংয়ের হাওয়ার গুণগতমান অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু শিল্পজনিত বিষাক্ত গ্যাস গাড়ি থেকে ছড়িয়ে পড়া গ্যাসসহ দূষণ নির্মূল করা খুব কঠিন। পেইচিংয়ের পরিবেশ উন্নত করার জন্য গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর থেকে পেইচিংয়ের পশ্চিমাঞ্চলের রাজধানী লৌহ ও ইস্পাত লিমিটেড কোম্পানির উত্পাদন আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়। এই লৌহ ও ইস্পাত লিমিটেড কোম্পানির ইতিহাস ৯০ বছরের। এই লৌহ ও ইস্পাত লিমিটেড কোম্পানি পেইচিং শহর থেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘটনা থেকে প্রতিপন্ন হয়েছে যে, পরিবেশের দূষণ দূর করার জন্য চীন সরকার কার্যকরভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে। বতর্মানে পেইচিং শহরে সৌর শক্তি ও মিথেন গ্যাসসহ নানা ধরনের নতুন জ্বালানিকে জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছে। লৌহ ও ইস্পাতসহ বহু পরিমাণে ব্যয় ভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমেই ইতিহাসের মঞ্চ থেকে বেরিয়ে এসেছে। বিষাক্ত গ্যাসের নি:সরণ কমানো ভবিষ্যত উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা হয়ে দাড়িয়েছে।
আসলে পেইচিং কেবল মাত্র চীনের শহরগুলোর অন্যতম । মৌলিকভাবে বলতে গেলে বতর্মানে চীনের শহরগুলোতে বাতাসের গুণগতমান আগের চাইতে অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু কোন কোন শহরের দূষণ এখনও গুরতর। ২০০৯ সালে ৬১২টি শহরে পরিবেশ ও বাতাসের গুণগতমানের ওপর পর্যবেক্ষন চালানো হয়েছে। পযর্বেক্ষণের ফলাফলে দেখা গেছে, মাত্র ২৬টি শহর প্রথম শ্রেণীর সারিতে উন্নীত হয়েছে । সুতরাং সারা দেশের আরো অনেক শহরের বাতাসের গুণগতমান আরও উন্নত করার পর্যায়ে রয়েছে।
একটি খবরে বলা হয়েছে, আমাদের জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত জমিও দূষিত হয়েছে। কারণ চীনের শিল্পায়নের প্রক্রিয়ায় অনেক বিষাক্ত ধাতু পানির স্রোত ও বাতাসের মাধ্যমে মাটিতে প্রবেশ করেছে। এ প্রসঙ্গে চীনের রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের সদস্য, ভূমিতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ, দক্ষিণ-পশ্চিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ ও পরিবেশ ইনস্টিটিউটের পরিচালক শিয়ে ডে ঠি বলেছেন, বতর্মানে দূষিত জমি দেশের মোট আবাদি জমির ১০ শতাংশের কাছাকাছি । তিনি জমি দূষিত হওয়ার প্রধান কারণ বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মতে, জলসেচে শহরের দূষিত পানি ব্যবহার করা হয়েছে । অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারে জমিও দূষিত হতে পারে ।
জমির দূষণ ছাড়া, পানির দূষণ অবহেলা করলে চলবে না। চীনের চিয়াংসু প্রদেশের উশি শহরে অবস্থিত ঠাইহু হ্রদ বিশ্ববিখ্যাত। এই হৃদের সৌন্দর্যের প্রসংশার জন্য 'ঠাইহু হ্রদের সৌন্দর্য' নামক একটি গান দীর্ঘকাল ধরে চীনা মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরে অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়নের ফলে এই হৃদের পানি গুরুতরভাবে দূষিত হয়েছে। অতীতে 'দক্ষিণ চীনের মুক্তা' হিসেবে আখ্যায়িত ঠাইহু হ্রদ থেকে এখন দুর্গন্ধ ছাড়ছে। এক সময় ঠাইহু হ্রদের পাশে উশি শহরে পানীয় জল দূষিত হওয়ায় পানীয় জলের সংকট দেখা দেয়।
২০০৯ সালে চীনের পরিবেশ সংরক্ষণ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত 'চীনের পরিবেশের বতর্মান অবস্থা সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে' বলা হয়, চীনের ইয়াংসি নদী, হুয়াংহো নদী , জুচিয়াং নদী , সংহুয়াচিয়াং নদী ও হুয়ে নদীর পানি হালকাভাবে দূষিত হয়েছে। দেশের বেশ কয়েকটি শহরের পানীয় জলের ওপর পযর্বেক্ষণ করা হয়েছে। পযর্বেক্ষণের ফলাফল অনুযায়ী, চীনের প্রধান প্রধান শহরের মধ্যে চার ভাগের এক ভাগের পানীয় জল কোন না কোন মাত্রায় দূষিত হয়েছে।
পরিবেশ দূষণের অবনতি ঘটার পাশাপাশি চীনের পরিবেশ সংস্কারের কাজের ওপর আরও উন্নত করা খুবই প্রয়োজন। তাহলে পরিবেশ সংস্কারের সময় চীনের সম্মুখিন প্রধান সমস্যা কী? শিয়ে ডে ঠি মনে করেন, চীনের উত্পাদন শিল্পের পুনবিন্যাসের গতি অপেক্ষাকৃত মন্থর ও সম্পদ পরিবেশের চাপ বাড়ানো বতর্মানে সংস্কারের প্রধান সমস্যা বলে গণ্য করা হয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। তার প্রস্তাব হল, পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উত্পাদন শিল্পের উন্নয়ন করতে হবে । পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান গবেষণা জোরদার করতে হবে। চীনের রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের সদস্য গাও মিন শিয়ে ডে ঠির প্রস্তাবে সম্মতি দেন। তিনি বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে চীন পাশ্চাত্য দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। বৃটেনের রাজধানী লন্ডন কীভাবে 'কুয়াশার রাজধানী' থেকে মুক্তি পেয়েছে তা থেকে অনেক কিছু শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। লন্ডনের অভিজ্ঞতা খুঁজে বের করার জন্য বৃটেনে সি আর আইয়ের নিজস্ব সংবাদদাতা জেন জে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফ্র্যান্ক খেলির সাক্ষাত্কার নিয়েছেন। অধ্যাপক ফ্র্যান্ক খেলি দীর্ঘকাল ধরে পরিবেশ পযর্বেক্ষণ ও গবেষণার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। তিনি বলেন,
লন্ডনের দূষণ সমস্যা সমাধানের জন্য বৃটেন সরকার অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। কয়েক বছর আগে 'বাতাস পরিষ্কার সংক্রান্ত আইন' প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী, লন্ডন শহরে সমস্ত বিদ্যুত উত্পাদন কারখানা বন্ধ করতে হবে। এ সব বিদ্যুত উত্পাদন কারখানা দূর উপকন্ঠে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। যেমন টাইমস নদীর তীরে বিদ্যুত উত্পাদন কারখানা এখন একটি আধুনিক যাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। সুতরাং গত ২০ বছরে লন্ডনের বাতাসের গুণগতমানের অনেক উন্নতি হয়েছে।
বৃটেনের উদাহরণ থেকে প্রমাণিত হয়েছে, আধুনিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যদি একটি দেশ পরিবেশ নষ্ট করে তাহলে তা ক্ষতিপূণের জন্য অনেক সময় ও টাকা ব্যয় করতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে চীন দেশের বতর্মান গুরুতর দূষণ সমস্যা উপলব্ধি করেছে। দ্বাদশ পাঁচশালা পরিকল্পনা চলাকালে পরিবেশ সংরক্ষণ ক্ষেত্রে চীন সংশ্লিস্ট পদক্ষেপ নেবে। দ্বাদশ পাঁচশালা পরিকল্পনার শেষ নাগাদ চীনের পরিবেশ সংরক্ষণের সংশ্লিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |