|
ধর্মীয় বিশ্বাস হচ্ছে তিব্বতী জাতির লোকজনের জীবনযাপনের একটি প্রয়োজনীয় অংশ। ছিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে সবসময় তিব্বতে প্রচলিত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দেখা যায়। এরা শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে নিজেদের জন্মস্থান থেকে রওয়ানা হয়ে রাস্তায় উপূর হয়ে পড়ে প্রার্থনা করে তাদের পবিত্র শহর লাসায় যাত্রা করে, তাদের মধ্যে অনেককেই কয়েক বছর অথবা দশ বছর সময় হাঁটতে হয়। তবে যখন এসব ধার্মিক ধর্মাবলম্বীরা লাসায় প্রবেশ করার পর কোথায় প্রার্থনা করে? তা হল আমাদের আজকের অনুষ্ঠানের জানার বিষয়, আর তা হলো, লাসার কেন্দ্রীয় অঞ্চলের তাচাও মন্দির।
তাচাও মন্দির পোতালা প্রাসাদের কাছে অবস্থিত, ওখান থেকে হেঁটে হেঁটে প্রায় ১০ মিনিটে মন্দিরে পৌঁছতে পারা যায়। তাচাও মন্দিরের চত্বরে প্রবেশ করে দূরদূরান্ত থেকে দেখা মন্দিরের দরজার সামনে উঁচু পতাকার স্তম্ভ, আস্তে আস্তে ভেসে হাল্কা ধোয়া ও সোনালী রঙ্গের মন্দিরের ছাদ দেখা যায় এবং ঘি'র বাতির সুগন্ধ ঘ্রাণ নিতে পারে।
লাসায় একটা কথা আছে তাচাও মন্দির নির্মিত হওয়ার পরই লাসা শহর নির্মিত হয়। এ কথা তাচাও মন্দির নির্মাণের ইতিহাসে প্রতিফলিত হয়েছে। ৭ম শতাব্দীতে ৩৩তম তিব্বতী রাজা স্রোংস্টেন গাম্বো তিব্বতকে একীকরণ করার পর তাঁর রাজপ্রাসাদ শাননান থেকে লাসা নদীর উপত্যকা এলাকায় স্থাপন করছিলেন, তা হল বর্তমানের লাসা শহর। তখন লাসায় শুধমাত্র অল্প পরিমাণের স্থাপত্য ছিল। রাজা স্রোস্টেন গাম্বো পৃথক পৃথকভাবে নেপালের ছিজুন কুমারী ও থাং রাজবংশের ওয়েনছেং কুমারীকে বিয়ে করেন, দু'জন কুমারী পৃথক পৃথকভাবে এটি অতি শ্রেষ্ঠ গৌতম বুদ্ধের মূর্তি তিব্বতে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু কিভাবে এ দুটি মূর্তি স্থাপন করা যাবে তা ছিল একটি জটিল সমস্যা। ওয়েনছেং কুমারীর প্রস্তাবে স্রোংস্টেন গাম্বো তাচাও মন্দির ও সিয়াওচাও মন্দির নির্মাণ করে বুদ্ধের দুটি মূর্তি স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ দুটি মন্দির নির্মিত হওয়ার পর তিব্বত প্রচলিত বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র স্থানে পরিণত হয়েছে। তিব্বতীর লোকজন মন্দির এসে প্রার্থনা করছিল। তখন থেকে তাচাও মন্দিরকে কেন্দ্র করে একটি শহর নির্মিত হয়েছে, তা হল লাসা শহর। এ জন্যে লোকজন সবসময় বলে, তাচাও মন্দির নির্মিত হওয়ার পর লাসা শহর স্থাপিত হয়েছে।
তাচাও মন্দিরকে তিব্বতী ভাষায় জুলাখাং বলে ডাকা হয়। এর অর্থ হল বুদ্ধের ভবন বা প্রাসাদ। তার আরেকটি নাম হল চ্যুয়ে খাং। এর অর্থ হল গৌতম বুদ্ধ অর্থাত্ গৌতম বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের বৌদ্ধ ভবন এবং এ বুদ্ধ মূর্তি ওয়েনছেং কুমারী প্রাচীনকালের চীনের থাং রাজবংশের রাজধানী ছাং'আন শহর থেকে নিয়ে এসেছেন। জানা গেছে এ বুদ্ধ মূর্তি গৌতম বুদ্ধের ১২ বছর বয়স সময়কালের সোনার মূর্তি। তা হল ক্রিষ্ট পূর্ব ৫৪৪ সালে গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুবরণের আগে তৈরী শ্রেষ্ঠ সম্পত্তি।
গাইড লি সিয়াও হুয়া আমাদেরকে বলেছেন, আমরা দেখছি এ বুদ্ধ মূর্তির প্রায় ২৫০০ বছরের ইতিহাস রয়েছে, কারণ গৌতম বুদ্ধ জীবিতকালে মোট তিনটি ভিন্ন বয়স সময়কালের বুদ্ধ মূর্তি তৈরী করছিলেন। তাঁর ৮ বছর বয়স সময়কালের বুদ্ধ মূর্তি চীনের সংস্কৃতি বিপ্লবের সময় বিধ্বংস্ত হয়েছে, একটি ২৫ বছর বয়স সময়কালের বুদ্ধ মূর্তি ভারতে হারিয়ে গেছে। এ জন্যে এ বুদ্ধ মূর্তি হচ্ছে পৃথিবীতে থাকা ১২ বছর বয়স সময়কালের বুদ্ধ মূর্তি। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে জন্মস্থান থেকে লাসায় হেঁটে হেঁটে প্রার্থনা করতে এসেছে, এ বুদ্ধ মূর্তির প্রতি প্রার্থনা করা ঠিক গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে দেখার মতো।
কাহিনী অনুযায়ী তাচাও মন্দির নির্মাণের সময় অনেক ঝামেলার সম্মুখীন হয়েছিল। কয়েকবার বন্যায় ধ্বংস হয়েছে। ওয়েনছেং কুমারী লক্ষত্রমন্ডল ও ভৌগৌলিক বিদ্যার বিশেষজ্ঞ, তিনি রাতে লক্ষত্রমন্ডল পর্যবেক্ষণ করতেন এবং দিনের বেলায় ভৌগৌলিক অবস্থা পরিদর্শন করতেন। কয়েকবার পর্যবেক্ষণের পর তিনি ব্যাখ্যা করতেন যে, তিব্বতের আকার শুয়ে থাকা একজন কুহকিনীর মতো, এ কুহকিনীর হৃদ অঞ্চলে একটি হ্রদ ছিল, এ হ্রদ ভরাট করার পর কুহকিনীকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং তাচাও মন্দির নির্মাণ করা যায়। তিনি আরও বলতেন, ছাগল দিয়ে মাটি বহন করে হ্রদ ভরাট করা যায়। ফলে ছাগল দিয়ে মাটি বহন করা তাচাও মন্দিরের একটি বিখ্যাত কাহিনীতে পরিণত হয়েছে।
এ ভবনের প্রস্তরখণ্ডতে পবিত্র ছাগল রাম জেম ভবন' লিপিবদ্ধ রয়েছে, লাখ লাখ ছাগল দিয়ে মাটি নিয়ে হ্রদ ভরাট করার মাধ্যমে তাচাও মন্দির নির্মিত হয়েছে। ছাগল তাচাও মন্দির নির্মাণের জন্য বিরাট অবদান রেখেছিল। তাচাও মন্দির খোলার দিনে রাজা স্রোংস্টেন গাম্বো হস্তশিল্পীদেরকে একটি সাদা রঙয়ের সোনালী পাওডারসহ ছাগল ভাস্কর্য করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, এভাবে সব বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তাকে প্রার্থনা করতে পারে এবং তাদের অবদানের জন্য ধন্যবাদ জানাতে পারছে। লাসা শহরের নাম ছাগলের মাটি নেয়ার গল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ তিব্বতী ভাষায় ছাগলের উচ্চারণ হল রা এবং মাটির উচ্চারণ হল সা। দীর্ঘকাল ধরে এ শহরের নাম লাসায় পরিণত হয়েছে। তিব্বতী ভাষায় লা'র অর্থ হল বুদ্ধ এবং সা'র অর্থ হল মাটি, এ জন্য লাসাকে পবিত্র স্থান বা বুদ্ধের স্থান বলে ডাকা হয়।
আসলে তাচাও মন্দির নেপালের ছিজুন কুমারীর নিয়ে আসা ৮ বছর বয়সের গৌতম বুদ্ধের সময়কালের মূর্তি রাখার জন্য নির্মিত হয়েছিল এবং সিয়াওচাও মন্দির ওয়েনছেং কুমারীর থাং রাজবংশের ১২ বছর বয়সের গৌতম বুদ্ধের সময়কালের মূর্তি রাখার জন্য নির্মিত হয়েছিল। তবে ফলে কেন ওয়েনছেং কুমারীর নিয়ে আসা মূর্তি তাচাও মন্দিরে রাখা হয়েছে? এ সম্পর্কে গাইড লি সিয়াও হুয়া আমাদেরকে বলেছেন,
তাচাও মন্দির ও সিয়াওচাও মন্দির নির্মিত হওয়ার পর থাং রাজবংশের বাহিনী তিব্বতী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, কাহিনী অনুযায়ী তত্কালীন থাং রাজবংশের রাণী উ জে থিয়ান ১২ বছর বয়সের গৌতম বুদ্ধের সময়কালের মূর্তি পুনরায় দখল করতেন। এ কারণে তিব্বতের কর্মকর্তা ও ধর্মাবলম্বীরা এ বুদ্ধ মূর্তি সংরক্ষণের জন্য এ মূর্তিটি সিয়াওচাও মন্দির থেকে তাচাও মন্দিরে হস্তান্তর করে ৬০ বছর রেখেছেন। ফলে নেপালের ছিজুন কুমারী নিয়ে আসা ৮ বছর বয়সের গৌতম বুদ্ধের সময়কালের মূর্তি সিয়াওচাও মন্দিরে হস্তান্তর করা হয়েছিল।
তাচাও মন্দিরের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মুণি হিসেবে গৌতম বুদ্ধের ১২ বছর বয়সের গৌতম বুদ্ধের সময়কালের মূর্তি গৌতম বুদ্ধের ছোটবেলার ভাবমূর্তি ভাস্কর্য্য । এ বুদ্ধ মূর্তি তিব্বতী জাতির লোকজনের কাছে নিজেদের জীবনের মতো শ্রেষ্ঠ ধর্ম বিশ্বাসের প্রার্থনার উত্স্য।
গৌতম বুদ্ধ ছাড়া তাচাও মন্দিরে পোতালা প্রাসাদ ও মন্দিরের সৃষ্টিকারী স্রোংস্টেন গাম্বোর মূর্তি রাখা আছে। মাঝখানের এ ভদ্র লোক হলেন ৭ শতাব্দীতে ৩৩তম রাজা স্রোংস্টেন গাম্বো। তিনি তিব্বতের একীকরণ করতেন এবং ৬৩৩ সালে শাননান অঞ্চল থেকে লাসায় স্থানান্তর করেন, পোতালা প্রাসাদ নির্মাণ করেন এবং একজন মিনিস্টারকে সংস্কৃত লেখাপড়া করার জন্য ভারতে পাঠিয়ে দিতেন এবং তিব্বতী ভাষার ৩০টি অক্ষর সৃষ্টি করেন। রাজা স্রোংস্টেন গাম্বোর থেকে তিব্বতের ইতিহাস অক্ষর দিয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল এবং বৌদ্ধ ধর্মের অনেক বই ও শাস্ত্র অনুবাদ করা হয়েছিল।
তিব্বতকে একীকরণ করা স্রোংস্টেন গাম্বো তিব্বতী জাতির লোকদের কাছে একজন মহান নেতা। তারা মনে করে, স্রোংস্টেন গাম্বো এবং তাঁর দু'জন স্ত্রী ছিজুন কুমারী ও ওয়েনছেং কুমারী হল দেবতার প্রতীক, তাঁরা তিব্বতের জনগণকে দুর্ঘটনা ও দুঃখ থেকে বের হওয়ার জন্য বিশ্বে চলে এসেছেন। তাচাও মন্দিরে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যাপার হল এ মন্দিরে স্রোংস্টেন গাম্বো ও ওয়েনছেং কুমারীর অনেক লিপিবদ্ধ রয়েছে।
মন্দিরের এক তলা, দুই তলা এবং ছাদের ওপর সবই ৭ম শতাব্দীতে কাঠ দিয়ে ভাস্কর্য করা বুদ্ধের মূর্তি দেখা যায়। প্রতিটিস্তম্ভের ওপর একজন লোকের চেহারার ভাস্কর্য রয়েছে, তা হল রাজা স্রোংস্টেন গাম্বোর নিজের ভাস্কর্য করা শিল্পকর্ম। মন্দিরের ভিতরে একটি পাথরের চেয়ার আছে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা হাত দিয়ে স্পর্শ করার জন্য পাথরের ওপর অনেক ঘি দেখা যায়।
তাচাও মন্দিরের প্রশাসনিক কমিটির উপ-পরিচালক, বিখ্যাত সন্ন্যাসী নিমা ছিরেন মনে করেন, তাচাও মন্দিরের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি ও ইতিহাসের মূল্য শুধু মাত্র বুদ্ধ মূর্তি তা নয়, আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সংস্কৃতির সংমিশ্রণ এতে প্রতিফলিত হয়েছে।
তাচাও মন্দিরের দুটি শ্রেষ্ঠ দিক আছে। প্রথমত: এখানে গৌতম বুদ্ধের ১২ বছর বয়সের সময়কালের মূর্তি রাখা আছে, তা হচ্ছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধ মূর্তি। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তাকে সত্যি গৌতম বুদ্ধের মতো দেখে। অন্য দিকে বিশ্বের মানবজাতির সংস্কৃতির ক্ষেত্র থেকে দেখে, তা হচ্ছে গোটা মানবজাতির মণি। দ্বিতীয়ত: তাচাও মন্দিরের স্থাপত্য স্রোংস্টেন গাম্বোর প্রশাসনকালে নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে চমত্কার কাঠের ভাস্কর্য্য ও দোয়াল ছবি রয়েছে। আমরা সবসময় বলি দোয়াল ছবি হল একটি বিশ্বকোষ, তাচাও মন্দিরের স্থাপত্য তিব্বতের স্থাপত্যের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ও প্রাচীনকালের চীনের থাং রাজবংশের স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিশ্রণ করেছে, এর সঙ্গে সঙ্গে ভারত ও নেপালের স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যও ব্যবহৃত হয়েছে। তা হল সংস্কৃতি আদান-প্রদানের প্রতীক ও সাফল্য।
(সুবর্ণা/আবাম)
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |