|
আপনারা জানেন চীনের সর্ব দক্ষিণের দ্বীপ হাইনানে প্রচুর নারিকেল গাছ আছে বলে এ দ্বীপকে নারিকেল দ্বীপ এবং হাইনান প্রদেশের রাজধানী হাইখৌকে নারিকেলের শহর বলা হয়। নারিকেল ও ডাব হচ্ছে হাইনান প্রদেশের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন খাবার এবং সেখানকার প্রতীক।
হাইনান দ্বীপে আগত পর্যটকরা সবখানে নারিকেল গাছ দেখতে পাবেন। নারিকেল গাছ খুব লম্বা ও সোজা এবং এর মাথায় বড় পাতা থাকার কারণে এ গাছ দেখতে একটি বড় ছাতার মতো। বছরে বেশ ক'বার নারিকেল গাছে ফুল ফোটে এবং ফল ধরে। একই গাছে ফুল, কচি ফল বা ডাব, অপরিপক্ক বা দুমড়ো নারিকেল ও পাকা বা ঝুনো নারিকেল সবই দেখা যায়।
ডাবের রঙ সবুজ কিন্তু পেকে গেলে বাদামি রং ধারণ করে। এ ফলে প্রচুর পুষ্টি আছে। হাইনান ইউশান পুষ্টি বিশেষজ্ঞ দপ্তরের পরিচালক ছেন ছিং বলেন, "নারিকেল হচ্ছে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল। নারিকেল যত পাকে, তার মধ্যে প্রোটিন ও উদ্ভিজ্জ তেলের পরিমাণ তত বাড়ে। নারিকেল বা ডাবের পানি ও শাঁসের মধ্যেও প্রচুর পুষ্টি রয়েছে।"
বলা হয়, নারিকেল হচ্ছে পুষ্টিকর ফলের অন্যতম। এর প্রধান কারণ হল এর পানি ও শাঁসের মধ্যে প্রোটিন, চিনি, উদ্ভিজ্জ তেল, ভিটামিন-বি-১, ভিটামিন-ই ও ভিটামিন-সিসহ বিভিন্ন ধরনের উপাদান রয়েছে। ডাবের পানি সাধারণ পানির মতো স্বচ্ছ তবে বেশ মিষ্টি। গ্রীষ্মে এ পানি মানুষের খুব পছন্দ।
সিছুয়ান প্রদেশ থেকে আগত ম্যাডাম ছাও শা জানান, নারিকেল খেতে তাঁর খুব ভালো লাগে। তিনি বলেন, "চকচকে ও সুগন্ধযুক্ত। নারিকেল খাওয়ার পর মুখে ঘ্রাণ লেগে থাকে। আমার মনে হয় এর স্বাদ বাদামের মতো।"
গ্রীষ্মকালে সমুদ্রের পাশে নারিকেল গাছের নিচে বসে বসে সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে মজার ডাবের পানি খেয়ে সত্যিকারভাবে হাইনান দ্বীপের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়।
নারিকেলের শাঁসের মধ্যে তেলের পরিমাণ ৩৫ শতাংশ এবং এ শাঁসে প্রচুর পরিমাণে আঁশও থাকে। নারিকেল মানুষের চেহারার সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করা ছাড়াও চর্মরোগ প্রতিরোধ এবং হজমশক্তি বাড়ানোর ক্ষেত্রে সহায়ক।
নারিকেল বা ডাবের পানিতে এমিনোফেনলের পরিমাণ বিশ্বের অন্য যে কোনো প্রাকৃতিক পানীয়ের চেয়ে বেশি। চিকিত্সা গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ পানি হৃদরোগ, ক্যানসার ও বাত রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। নিয়মিত ডাবের পানি খেলে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং চর্বি কমে। এতে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে যায়।
ছেন ছিং সংবাদদাতাকে জানান, নারিকেল দিয়ে নানা ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরি করা যায়। "নারিকেল দিয়ে নানা ধরনের খাবার তৈরি করা যায়। নারিকেল দিয়ে তৈরি মুরগির মাংসের খাবার সবচেয়ে বেশি সুস্বাদু। যেমন নারিকেল ও মুরগির স্যুপ, নারিকেল ও মুরগির টুকরা এবং নারিকেল, মুরগির মাংস ও আঠালো ভাত।"
এগুলো হচ্ছে হাইনানের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ খাবার; এসব খাবারে প্রচুর পুষ্টি রয়েছে। যাদের হজমশক্তি কম, খাওয়ার ইচ্ছা কম এবং শরীরে শক্তির অভাব তাদের জন্য নারিকেল ও মুরগির সুপ খুব উপযোগী।
নারিকেলের যদিও অনেক গুণ, তবে মাত্রারিক্ত খেলে তা শরীরের জন্য সমস্যা ডেকে আনতে পারে। এ সম্পর্কে ছেন ছিং বলেন, যাদের শরীরে তাপ বেশি, তাদের পক্ষে নারিকেল কম খাওয়া ভালো। যদি আপনি দীর্ঘকাল ধরে গভীর রাতে ঘুমান, ভাজা খাবার খেতে পছন্দ করেন, আপনার মুখ সবসময় শুকনা লাগে এবং সহজে রেগে যান, তাহলে নারিকেল না খেলে ভাল; খেলেও কম খাবেন।
হাইখৌ শহরের ছোট দোকানে দুই বা তিন ইউয়ান দিয়ে আপনি একটি ডাব কিনতে পারেন। ডাবের পানি খাওয়ার পর দোকানি আপনাদের জন্য সেটার শাঁস খাওয়ারও ব্যবস্থা করে দিতে পারে। ডাবটি চিরে দেয়ার পর আপনি চামচ দিয়ে তার শাঁস খেতে পারেন। রাস্তায় দুপাশের নারিকেল গাছ বড় আকারের ছাতার মতো আপনাকে সূর্যের আলো থেকে রক্ষা করবে। তারপরও হাঁটতে হাঁটতে যদি আপনি ক্লান্ত হয়ে যান, তাহলে যে কোনো দোকানে গিয়ে একটি ডাব কিনে খাওয়ার পাশাপাশি বিশ্রাম নিতে পারেন। তা খুবই মজার ব্যাপার হবে।
ডাব ছাড়া হাইখৌ শহরে আরেক ধরনের বিখ্যাত খাবার আছে। এর নাম হাইনান চালের নুডলস। হাইখৌ শহরের পুরনো সড়কে 'লাওপান চালের নুডলস দোকান' নামের একটি দোকান ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ নুডলস বিক্রি করছে। লোকজন তাদের চালের নুডলস খেতে খুব পছন্দ করে। প্রতিদিন ভোরবেলা ৬টা থেকে দোকানে ভীড় শুরু হয়। এ দোকানের মালিক ম্যাডাম পান স্যুয়ান মেই ও তাঁর পুত্রবধু অতিথিদের জন্য এ খাবার রান্না করেন। সাদা ও কুচি কাঁচা চালের নুডলস, সুগন্ধী ও চকচকে বাদামের গুড়ো, তিল, হলুদ ডালের নবোদগম, লাল রঙের গরুর মাংসের কুচি, সবুজ ধনেপাতা ও সুগন্ধী রস দেয়ার পর লাল, সাদা, হলুদ ও সবুজ রঙের সুস্বাদু ও সুন্দর চালের নুডলস তৈরি হয়ে যায়। দোকানের ইতিহাস সম্পর্কে ম্যাডাম লুও বলেন,
"আমাদের চালের নুডলসের ব্যবসা ঐতিহ্যবাহী; আমাদের দাদার আমলে এ ব্যবসা শুরু হয়।"
তিনি আরও বলেন, তাদের চালের নুডলসের খাওয়া অনেক অতিথির অভ্যাসে পরিণত হয়েছে; প্রতিদিন তাদের এ খাবার খেতেই হয়। অতিথি পেং দাদা হলেন তাদের মধ্যে একজন। তিনি বলেন,
"তাদের চালের নুডলসের স্বাদ অন্য দোকানের চেয়ে ভালো। আমি সপ্তাহে কয়েকবার আসি। সময় পেলেই চলে আসি।"
হাইনান চালের নুডলস তৈরির প্রক্রিয়া খুবই জটিল। এ জন্য তারা অন্য দোকান থেকে কাঁচা নুডলস কিনে তাতে শুধু নুডলসের উপকরণ এবং বিশেষ রস ও মসলা দিয়ে তা তৈরি করেন। প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে বিকেল ২টা পর্যন্ত তা বিক্রি হয়। প্রতিদিন ১০০ কেজির বেশি চালের নুডলস বিক্রি হয় সেখানে। "আমাদের চালের নুডলস খুব পরিস্কার ও টাটকা। প্রতিদিন আনা নুডলস দিনেই বিক্রি করে ফেলা হয়। আমরা গুণগতমানসম্পন্ন উপকরণ ব্যবহার করি এবং প্রতিদিন ২৫ কেজি শঙ্খ দিয়ে বিশেষ স্যুপ রান্না করি।"
হাইনান চালের নুডলস খাওয়ার পদ্ধতি খুবই মজার। সিদ্ধ ঠাণ্ডা নুডলস পেয়ালায় রাখার পর বিভিন্ন ধরনের উপকরণ ও সবজি দেয়া হয়। তারপর মুলার কুচি, কালো ছত্রাক, বাঁশের কুঁড়ি দিয়ে বানানো রস দেয়ার পর তা পরিবেশন করা হয়। ঠাণ্ডা চালের নুডলস গরম রসের সাথে মেশানোর পর তা খেতে খুব মজা লাগে। আপনি যদি ঝাল খাবার খেতে চান, তাহলে এর মধ্যে লাল মরিচের সস দিতে হবে।
আপনি যদি তাড়াতাড়ি এ নুডলস খেয়ে ফেলেন, তাহলে এর স্বাদ ভালভাবে উপভোগ করতে পারবেন না। সবটুকু নুডলস না খেয়ে অল্প কিছুটা রেখে দোকানে বানানো গরম শঙ্খ সুপ তার সঙ্গে মিশিয়ে খেলে তা হবে দারুণ সুস্বাদু।
হাইখৌ শিল্পকলা জাদুঘরের উপ-পরিচালক রীতিনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ছিউ থিয়েন ওয়েই এ খাবার নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, "এটা খেলে চালের সুগন্ধ পাওয়া যায়। তবে এটা সাধারণ নুডলসের মতো শক্ত নয়, সহজভাবে মুখে গলে যায়। যদি চপস্টিক দিয়ে টেনে টেনে এ নুডসল খাওয়া হয়, তাহলে খাওয়ার শেষে পেয়ালায় নুডলসের কোনো ছোট টুকরা থাকে না। হাইখৌ শহর সমুদ্রের কাছে অবস্থিত। এ জন্য শঙ্খসহ বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক উপাদান দিয়ে স্যুপ তৈরি করা হয়, যা খুবই সুস্বাদু।
হাইনান চালের নুডলসের পাঁচ শতাধিক বছরের ইতিহাস রয়েছে। এটা রান্নার উপায় সম্পর্কে একটি সুন্দর কাহিনী প্রচলিত আছে। প্রাচীনকালে চীনের মিং রাজবংশের শেষ দিকে চীনের ফুচিয়ান প্রদেশে একজন যুব হস্তকর্ম শিল্পী তার মাকে নিয়ে হাইনানে এসে বসবাস করতেন। তার মার হজমশক্তি ভাল ছিল না। ওই যুবক মায়ের জন্য স্থানীয় এলাকার চাল দিয়ে এ নুডলস তৈরি করে এবং তার মা এটা খাওয়ার পর তাঁর স্বাস্থ্য ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়। তারপর তারা একটি চালের নুডলস দোকান খোলে। তখন থেকেই এ খাবার হাইনান দ্বীপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বর্তমানে হাইনান চালের নুডলস স্থানীয় অঞ্চলের লোকজনের মধ্যে আরও জনপ্রিয় হয়েছে। হাইখৌ শহরের পুরনো সড়ক ও অলিগলিতে নানা ধরনের চালের নুডলসের দোকান দেখা যায় এবং এসব দোকানের নুডলস বড় রেস্তোরাঁর চেয়ে সুস্বাদু। হাইনান চালের নুডলস স্থানীয় অঞ্চলের লোকজনের দৈনন্দিক খাবারে পরিণত হয়েছে। তা সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার কিংবা উত্সব উদযাপন ও অতিথি আপ্যায়নের সময়ও খাওয়া যায়।
আপনারা যদি হাইনানে বেড়াতে আসেন, তাহলে হাইনান দ্বীপের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই এখানকার ডাব এবং পুরনো সড়কে মাত্র তিন-চার ইউয়ান দিয়ে সুস্বাদু হাইনান চালের নুডলস খেতে ভুলবেন না।
(সুবর্ণা/এসআর)
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |