Web bengali.cri.cn   
স্বপ্নের জলমাতৃক গ্রাম -- চৌচুয়াং
  2011-06-21 17:53:46  cri

চৌচুয়াংয়ের নদীপথ

বন্ধুরা, আজকে আমি আপনাদেরকে দক্ষিণ চীনের চিয়াংসু প্রদেশের খুনশান শহরে অবস্থিত বিখ্যাত জলমাতৃক গ্রাম চৌচুয়াংয়ে নিয়ে যাবো। সেখানকার দীর্ঘ সংকীর্ণ পাথর গলি নীরবে দূরে ছড়িয়ে যায়। গলির দুপাশে এক একটি মোচাকার ঘর। ঘরবাড়ির পিছন দিয়ে বয়ে গেচে একটা সরু নদী। পরিষ্কার পানি সেখানে নীরবে বয়ে যায়। নদীতে মাঝে মাঝে ছোট নৌকা দেখা যায়। বেশির ভাগ নৌকা বহু বছর ব্যবহৃত হয়েছে। তার ওপরে পড়েছে কালের চিহ্ন। নৌকায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য হচ্ছে নারী মাঝি।

বন্ধুরা, এখন আপনারা নৌকা চালানোর গান শুনছেন। গানটি গেয়েছেন নারী মাঝি সু মেই চেন। সু মেই চেনের বয়স এখন ৬১ বছর; গত বছর মাত্র অবসর নিয়েছেন। সংবাদদাতা তাঁর সাক্ষাত্কার নেবেন এটা জেনে তিনি দারুণ খুশি। তিনি স্বেচ্ছায় সংবাদদাতার পথনির্দেশক হয়ে পথে পথে তাঁর মাঝি জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি জানান, তিনি আর তাঁর স্বামী দুজনেই নৌকা চালানোর গান গাইতে পারেন। তাঁরা অতিথিকে অভ্যর্থনা জানানো থেকে শুরু করে বিদায় দেয়া পর্যন্ত সব ধরনের গান গান। তাঁদের অনুভুতি সব গানের মধ্যে রয়েছে। তিনি গানে পারদর্শী বলে চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশন কেন্দ্রের আমন্ত্রণে সেখানে এক অনুষ্ঠান অংশগ্রহণ করেন।

সু মেই চেনের বাড়ি চৌচুয়াংয়ের বিখ্যাত সুয়াং সেতুর পাশে। নারী মাঝি হওয়া আগে তিনি স্থানীয় একটি জুতো কারখানার ক্যান্টিনে কাজ করতেন। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের পর সু মেই চেন ও আশেপাশের অনেক কৃষকের জীবন চৌচুয়াংয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত হয়ে যায়। মাঝি হওয়ার পর সু মেই চেনের আতিথেয়তা ও সাহসী চরিত্র প্রতিফলিত হয়। তাঁর কণ্ঠও মধুর। নৌকা চালানোর সময় গান গাইতে গাইতে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এখন চৌচুয়াংয়ের নারী মাঝিদের প্রায় সবাই সু মেই চেন রচিত 'নৌকা চালানোর গান' গাইতে পারেন।

চৌচুয়াংয়ের নারী মাঝি

চৌচুয়াংয়ের নারী মাঝিরা সবাই নীল রংয়ের জমিনে সাদা ফুল ছাপানো কাপড় পরেন। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, তাদের গাঁয়ে এক একটি সাদা রংয়ের ছোট চন্দ্রমল্লিকা ফুল ফুটে রয়েছে। নারী মাঝিরা স্থিরভাবে নৌকার ওপরে দাঁড়িয়ে স্থিতিশীল গতিতে হাল ধরে নৌকা চালান। তাঁদের সুদর্শন দেহ নৌকা চালানোর সাথে সাথে দুলতে থাকে। এর মধ্যে ছন্দ ও সৌন্দর্য দেখা যায়। সারা দিন রৌদ্রের নিচে থেকে কাজ করার দরুণ নারী মাঝিদের মুখ যদিও সাধারণত কালো হয়ে যায়, তবে তাদের মুখে থাকে সন্তুষ্টির হাসি।

সু মেই চেন যদিও অবসর নিয়েছেন, তবুও এখনো তিনি সেই নীল ও সাদা ফুলের কাপড় পরতে পছন্দ করেন। তাঁর সঙ্গে চৌচুয়াংয়ের গলিতে হাঁটার সময় আমরা লক্ষ্য করেছি যে, পথে পথে অনেকে তাঁকে সম্ভাষণ জানান। সু মেই চেন হাসতে হাসতে বলেন, অবসর নেয়ার আগে তিনি চৌচুয়াংয়ের তারকা মাঝি ছিলেন। তিনি কেবল ভাল গান গাইতে এবং স্থিতিশীল গতিতে নৌকা চালাতে পারেন তা নয়; বরং চৌচুয়াংয়ের প্রতিটি নদী, প্রতিটি সেতু, এমন কি প্রতিটি গলির প্রত্যেকটি ইটকেও ভালোভাবে জানেন। তিনি গর্বিত কন্ঠে সংবাদদাতাকে বলেন, অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি তাঁর নৌকায় চড়েছেন। যেমন সিঙ্গাপুরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউয়, থাইল্যান্ডের রাজকুমারি মহা ছাকরি শিরিনথর্ন, চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী উ ঈ, হংকংয়ের প্রধান প্রশাসক চেন ইন ছুয়ান প্রমুখ।

সু মেই চেন বলেন, 'লি কুয়ান ইউয় তিন বার আমার নৌকায় চড়েছিলেন। লি কুয়ান ইউয় খুব লম্বা, পাতলা, সাদা চুল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তাঁর ছেলে শিগগির তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবে। চেন ইন ছুয়ান এসেছিলেন ২০০৫ সালে, রাজকুমারী মহা ছাকরি শিরিনর্থন ২০০৭ সালে এবং উ ই ২০০৪ সালে। তিনি বলেন, চৌচুয়াংয়ের দৃশ্য খুব ভালো, খুব সুন্দর। আমি বলি, প্রাচীনকাল থেকে সংরক্ষিত দৃশ্য। আমাদের চৌচুয়াংয়ে চারটি নদীপথ, আটটি রাস্তা আছে।'

চৌচুয়াংয়ের নারী মাঝি

চৌচুয়াং তার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দক্ষিণ চীনের জলমাতৃক গ্রামের দৃশ্যের জন্য অনেক গৌরব অর্জন করেছে এবং দেশি-বিদেশি বহু পর্যটককে আকর্ষণ করেছে। ইউনেস্কো চৌচুয়াংকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রস্তুতিমূলক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। চৌচুয়াং দুবাই আন্তর্জাতিক আবাসিক পরিবেশ উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ আদর্শ পুরস্কার, জাতিসংঘের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের শ্রেষ্ঠ সফল পুরস্কার এবং মার্কিন সরকারের পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছে। প্রতি বছর চৌচুয়াংয়ে আসা পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ, প্রতিদিনের হিসেবে সে সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার।

এখন চৌচুয়াংয়ের চার দিকে দেখা যায় বিদেশি পর্যটক। তাঁরা সাধারণত একটি নৌকা ভাড়া করে মাঝির গান শুনে নদীর দুপাশের দৃশ্য উপভোগ করেন। ব্রিটেন থেকে আসা বিদ্যুত্ প্রকৌশলী ব্রেইন বলেন, 'আমি প্রথম বার চৌচুয়াংয়ে এসেছি। এটা স্মৃতি রোমন্থনের ভালো জায়গা। অনেক আগেকার মানুষের জীবন দেখা যায়। এ ছোট্ট নৌকাগুলো, মাঝিরা আর প্রাচীন সেতুগুলো খুব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এটি এক সুন্দর নগর। আমি চৌচুয়াং পছন্দ করি।'

পর্যটন শিল্প উন্নয়নের কারণে চৌচুয়াংয়ে আগত বিদেশিদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সু মেই চেন বলেন, আগে তিনি মাত্র কয়েকটি ম্যান্ডরিন বাক্য বলতে পারতেন। এখন তিনি সাবলীলভাবে ম্যান্ডরিন চীনা ভাষা বলার পাশাপাশি কিছু ইংরেজি ও জাপানি ভাষাও বলতে পারেন।

সু মেই চেন বলেন, তিনি বিশ বছর ধরে নৌকা চালিয়েছেন। অনেক পর্যটক তাঁর নৌকায় চড়ার পর তাকে ছবি ও চিঠি পাঠান। এ চিঠি ও ছবিগুলোতে একটি বড় বাক্স ভরে গেছে। তাঁর কাছে এগুলোর বিশেষ মূল্য আছে।

চেন ঈ ফেইয়ের তৈলচিত্র

সু মেই চেন বলেন, প্রয়াত চিত্রকর চেন ঈ ফেই তাঁর নৌকায় চড়েছিলেন এবং সু'র মনে গভীর দাগ কেটেছিল। ১৯৮৪ সালে চেন ঈ ফেই তাঁর তৈলচিত্র 'জন্মস্থানের স্মৃতি'র জন্য বিশ্ববিশ্রুত হয়ে ওঠেন। তাঁর আঁকা তৈলচিত্রে চৌচুয়াংও হঠাত্ একরাতে বিখ্যাত হয়ে যায়। চেন ঈ ফেই তাঁর বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে চৌচুয়াংয়ের মূল্য আবিষ্কার করেন এবং এ মুক্তাকে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন। ২০০৫ সালের ১০ এপ্রিল চেন ঈ ফেই মৃত্যুবরণ করেন। চৌচুয়াংবাসীরা এ এলাকার প্রতীকী স্থাপত্য দ্বৈত সেতুর ওপরে চেন ঈ ফেইর স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ পাথর স্থাপন করেন এবং 'ঈফেই'র বাড়ি' নির্মাণ করেন। সেখানে চেন ঈ ফেই'র ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য ও তাঁর আঁকা ছবিগুলোর কপি প্রদর্শিত হয়।

সু মেই চেন বলেন, '২০০৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি শেষ বার আমার নৌকায় চড়েন। তখন একটু একটু বরফ পড়তে শুরু করেছে। তিনি প্রতিবার চৌচুয়াংয়ে এসে আমার নৌকায় চড়তেন। সেবার তিনি আমাকে আস্তে আস্তে চালানোর অনুরোধ করেন। তিনি নৌকায় বসে ছবি আঁকেন। যেমন সকাল পাঁচটা থেকে শুরু করে টানা দুঘন্টা ছবি আঁকেন।'

চেন ঈ ফেই'র ছবিতে আমরা চৌচুয়াংয়ের সুন্দরী মাঝিদের দেখতে পাই। তাঁরা নৌকার মাথায় দাঁড়ানো। এ জলমাতৃক অঞ্চল তাদের জন্য সুন্দর ও মনোরম হয়ে ওঠে। নারী মাঝি হচ্ছেন চৌচুয়াংয়ের প্রধান চরিত্র। তাদের হাসিমুখ থেকে মনের আনন্দ ও সুখ প্রকাশিত হয়। (ইয়ু কুয়াং ইউয়ে)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্যের পাতা
ভিডিও চিত্র
সাক্ষাত্কার
চিঠিপত্র
Play Stop
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040