|
এখন আপনারা যে সঙ্গীতটি শুনছেন, সেটি চীনের প্রাচীনকালের বিখ্যাত 'গীতিকবিতা গন্থ' থেকে নিয়ে সুরারোপ করা। দুই হাজার বছর ধরে অসংখ্য চীনা মানুষ গীতিকবিতা থেকে জ্ঞান শিক্ষা জীবন শুরু করেন। বর্তমানে চীনা জাতির এসব অবিনশ্বর অধ্যায়, যাতে জীবনের উত্থান-পতন, তা সম্পর্কে পেইচিং কুও জি চিয়ানে জানা যায়।
পেইচিংয়ের আন তিং মেন নেই একটি স্থির, গভীর ও ক্লাসিক্যাল পূর্ব ও পশ্চিম দিকের সড়ক রয়েছে। সেটি হলো কুও জি চিয়ান সড়ক। এর নাম সড়কে স্থাপিত প্রাচীন স্থাপত্য — কুও জি চিয়ান থেকে আসা। কুও জি চিয়ান ছিল প্রাচীনকালে শিক্ষা ক্ষেত্রে চীনের সর্বোচ্চ একাডেমি এবং উচ্চশিক্ষা ও প্রশাসন প্রতিষ্ঠান। এর পূর্ব দিকে রয়েছে কনফুসিয়াস মন্দির। সেটা কনফুসিয়াসের প্রতি সম্রাটদের শ্রদ্ধা নিবেদনের স্থান। দুটো গ্রুপের স্থাপত্য হলো ২ হাজার বছর ধরে কনফুসিয়াস ও কনফুসিয়াসকে সম্মান করা ঐতিহ্য ও ধারণার প্রকৃত ছবি। সড়কে মানুষের ভীড় ও গাড়ির স্রোত। তবু একটি দেয়ালের উল্টো দিকে ঘন সবুজ গাছের স্থির ও শান্ত চিত্র। দুটি বিশ্বের মতো। কুও জি চিয়ানের কর্মী ইয়ু চিউ ছেন এখানে আসা দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জন্য কুও জি চিয়ানের ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন,
"পেইচিং কুও জি চিয়ান ইউয়ান রাজবংশের সময় নির্মিত হয়। এটা ছিল ইউয়ান, মিং ও ছিং তিনটি রাজবংশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় একাডেমি এবং শিক্ষা ও প্রশাসনিক সংস্থা। এখানকার ইতিহাস হান রাজবংশ থেকে শুরু হয়। হান রাজবংশের সম্রাট উ তি'র সময়পর্বে, অর্থাত খৃষ্টপূর্ব ১২৪ সালে রাজকীয় কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের জন্য কর্মকর্তা গড়ে তোলার জন্য। সুই রাজবংশের সময়ে অর্থাত্ ৬০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কুও জি চিয়ানে পরিবর্তিত হয় এবং ছিং রাজবংশের শেষে এমনকি বর্তমান সময় পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়।"
বি ইয়োং
কুও জি চিয়ান প্রায় ৩০ হাজার বর্গমিটার জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য বি ইয়োং এর ঠিক মাঝখানে অবস্থিত, যেটি আসলে একাডেমির আলোচনা কক্ষ বা শ্রেণীকক্ষ। বি ইয়োংকে কেন্দ্র করে আবার রয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রেণীকক্ষ ও অফিস। বি ইয়োংয়ে স্থাপিত রাজকীয় আলোচনা সভার ছবিতে সে সময়ের জাঁকজমক প্রতিফলিত হয়। রাজপ্রথার অবসান হওয়ার পর কুও জি চিয়ান এক সময় গুরুত্ব হারায়। কিন্তু সেটিকে পরে সম্পূর্ণরূপে সংস্কার করে আকজের কুও জি চিয়ান ও কনফুসিয়াস মন্দিরে রূপ দেয়া হয় এবং কুও জি চিয়ান জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে বৈশিষ্ট্যময় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্থাপত্য আরো বেশি দর্শকদেরকে আকর্ষণ করছে। কুও জি চিয়ান অবস্থিত কুও জি চিয়ান সড়কও চীনের প্রথম পর্যায়ের ১০টি বিখ্যাত ঐতিহাসিক সড়কের মধ্যে অন্যতম। চীনের বিখ্যাত ঐতিহাসিক, কনফুসিয়াস ও কুও জি চিয়ান জাদুঘরের সাম্মানিক প্রধান ইয়ান ছৌংনিয়ান বলেন,
ইয়ান ছৌংনিয়ান
"পেইচিংয়ের কুও জি চিয়ান সড়ক দেশের ১০টি ঐতিহাসিক বিখ্যাত সড়কের মধ্যে অন্যতম। এটা খুব তাত্পর্যপূর্ণ। সারা দেশ ও সারা বিশ্ব জানে যে, পেইচিংয়ে কুও জি চিয়ান সাংস্কৃতিক সড়ক রয়েছে। কুও জি চিয়ান ছিল তত্কালীন চীনের সর্বোচ্চ একাডেমি। এখানে রয়েছে তত্কালীন রাজকীয় আলোচনা সভা অনুষ্ঠানের স্থান। এটা চীনের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে উন্নত করে।"
বর্তমানে কুও জি চিয়ান সড়কে বেড়াতে গেলে প্রাচীনকালের ধ্বংসাবশেষও এখানে-সেখানে দেখা যায়। প্রাঙ্গনে দাঁড়ানো রিকুই কয়েকশ' বছরের সাক্ষি। বি ইয়োং ভবনে রাজকীয় আলোচনা সভার সময় ব্যবহৃত ড্র্যাগন চেয়ারও ঠিক কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। নতুন নির্মিত কনফুসিয়াস ভাস্কর্য শান্তিপূর্ণভাবে এখানকার সব পরিবর্তন দেখছে। উত্সব বা ছুটি না হলেও অনেক মানুষ আসেন এখানে। কোনো কোনো মা-বাবা নিজেদের ছেলেমেয়েদের জন্য মঙ্গল প্রার্থনা করার জন্য এখানে আসেন আবার কোনো কোনো তরুণ-তরুণী আসেন প্রাচীনকালের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য জানার জন্য। দুয়েকজন বিদেশী পর্যটক কৌতূহল নিয়ে প্রাচ্য সংস্কৃতির ভাবধারা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। পর্তুগালের মারিয়া হচ্ছেন একজন প্রবীণ স্থপতি। কুও জি চিয়ানের বৈশিষ্ট্যময় স্থাপত্যের স্টাইল এবং গভীর সাংস্কৃতিক প্রেক্ষপট গভীরভাবে তাঁকে আকর্ষণ করে। তিনি বলেন,
কনফুসিয়াস ভাস্কর্য
"কুও জি চিয়ান একটি চমত্কার জায়গা। আমার মনে হয়, এটা অসাধারণ। এটা খুবই বিশেষ জায়গা। এখানকার বিদ্যাগত পরিবেশ গভীর। আমি কল্পনা করতে পারি সে সময় পরীক্ষা নেয়া মানুষদের অবস্থা কি রকম ছিল। কুও জি চিয়ানে প্রদর্শিত তত্কালীণ রাজকীয় আলোচনা সভা এবং ছাত্রদের পরীক্ষা নেয়ার কাগজ দেখে আমি চীনের গভীর সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট জানতে পারি। এছাড়া কনফুসিয়াস সংস্কৃতিতে আমার অনেক আগ্রহ রয়েছে। আমি এই নামের কারণে কুও জি চিয়ানে আসি। পর্তুগালে থাকার সময় আমি এখানকার কথা শুনতাম। এখানকার স্থাপত্যের প্রশংসায় মানুষ পঞ্চমুখ।"
চীনা তরুণ-তরুণীদের চোখে কুও জি চিয়ান একটি আকর্ষণীয় জায়গা। হুপেই প্রদেশের চিয়াং হান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তিং হাও বলেন, কুও জি চিয়ান সড়কে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে এখানকার অনাড়ম্বর প্রাচীন শৈলী ও শান্ত আমেজ তাঁকে আকর্ষণ করে। তিনি বলেন,
"কনফুসিয়াস মন্দির দেখে এলাম। সেখানে অনেক খোদাই করা সমাধিফলকে দেখলাম। আমার মনে হয়, প্রত্যেকে যদি যার যার নাম এখানকার পাথরফলকে খোদাই করতে চাইতো তাহলে তাদেরকে অনেক লেখাপড়া করতে হতো; অনেক ভালো কাজ করতে হতো। আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ব্যাপারটি আমার জন্যও এক রকম উত্সাহ।"
পুরাকীর্তি নিদর্শন ছাড়া কুও জি চিয়ান হচ্ছে পেইচিংয়ের একটি সক্রিয় জ্ঞান-বিজ্ঞান আদান-প্রদান স্থান। এবার আমরা চীনের বিখ্যাত পণ্ডিত ওয়েন হুয়াইশা'র চীনতত্ত্ব আলোচনাসভা দেখলাম এখানে। ৯০ বছরের এই পণ্ডিত গভীর চেতনায় চীনা সংস্কৃতির সার ব্যাখ্যা করেন। সকল শ্রোতা বিস্ময়াহত হয়ে সে আলোচনা শোনেন।
ওয়েন হুয়াইশা
জাদুঘরের কর্মীদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এরকম আলোচনা সভার কর্মকাণ্ড খুবই ঘন ঘন হলে সবার চাহিদা পূরণ করা যায় না।
বক্তৃতা ও করতালির শব্দ অব্যাহত চলছে। মনে হয় যেন এ সময়ের কুও জি চিয়ান আগের জ্ঞান-বিজ্ঞান শ্রেণীকক্ষে ফিরে গেছে। আমি বিশ্বাস করি, আপনি যদি কোনো সময় ধীর পদক্ষেপে কুও জি চিয়ানে প্রবেশ করেন, তাহলে শহরের আড়ম্বরতা অবশ্যই দূর হবে এবং আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মিশেলে সৃষ্ট বৈশিষ্ট্যময় আকর্ষণ শক্তি উপলব্ধি করতে পারবেন।
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |