|
বন্ধুরা, আপনি কখনো ছেংদে-এর নাম শুনেছেন? এটা হচ্ছে চীনের একটি ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক বিখ্যাত নগর। চীনের হোপেই প্রদেশের উত্তর দিকে অবস্থিত। পেইচিং থেকে ছেংদে শহরে যেতে প্রায় দেড় ঘন্টা সময় লাগে। সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য সুন্দর, জলবায়ু ঝরঝরে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে ছিং রাজবংশের গ্রীষ্মকালীন রাজপ্রাসাদটি রয়েছে সেখানে। তা ছাড়া দশ বারোটি উজ্জ্বলতর রাজকীয় মন্দিরও রয়েছে। ছিং রাজামলে এখানে ছিল পেইচিংয়ের পর চীনের দ্বিতীয় রাজনৈতিক কেন্দ্র। প্রায় দু শ বছর সময় ধরে প্রতি বছর সম্রাটরা বিপুল সংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত দল নিয়ে ছেংদে গিয়ে গ্রীষ্মকাল কাটাতেন।
ছিং রাজবংশের রাজকীয় শিকার সংস্কৃতি ও ছেংদের ইতিহাসের সম্পর্ক প্রসঙ্গে ছেংদে শহরের সংস্কৃতি ব্যুরোর ছিং রাজবংশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও চিয়া শুয়েন বলেন, 'এ এলাকার ঐতিহাসিক সংস্কৃতির কথা বলতে গেলে প্রথমে শরত্কালের শিকার সংস্কৃতি থেকে বলতে হয়। ছেংদে'র উত্তর দিকের অদূরে অবস্থিত মুলান ওয়েইছাং ১৬৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর প্রায় ১০০ বছরে ছিং রাজবংশের খাংসি, ছিয়ানলোং ও চিয়াছিংসহ বেশ কয়েকজন সম্রাট পর পর এখানে এসে মোট ৯২ বার শিকার করেন এবং ৮৮ বার শিকার বিষয়ক উদযাপনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্দেশ্য হলো শিকারের মাধ্যমে শক্তিশালী সেনাবাহিনী হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়ে রাশিয়ার সম্প্রসারণের উচ্চাভিলাষের ওপর হুমকি সৃষ্টি করা। অন্য দিকে এখানে মঙ্গোলিয়ার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে সীমান্ত অঞ্চলের বিভিন্ন জাতির সংহতি ও সংমিশ্রণ ত্বরান্বিত করা। যাতে উত্তর চীনের সীমান্তরেখার প্রতিরক্ষা কাজ জোরদার করে ঐক্যবদ্ধ বহু জাতিক দেশ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সহায়তা করা হয়। মুলান ওয়েইছাং প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে পরিত্যাক্ত হওয়া পর্যন্ত মোট সময় ছিল ১৮৩ বছর। ছিং রাজবংশের খাংশি ও ছিয়ানলোং সম্রাট আমলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সিদ্ধান্ত এখান থেকেই নেয়া হয়েছে। বলা যায়, মুলান ওয়েইছাংয়ে ছিং রাজবংশের মহান ইতিহাস রেখাপাত করেছে।'
মুলান ওয়েইছাং হচ্ছে বর্তমান হোপেই প্রদেশের ওয়েইছাং মান ও মঙ্গোলীয় জাতির স্বায়ত্তশাসিত জেলা। অতীত কালে এখানে সমৃদ্ধ তৃণভূমি ছিল। তখনকাল মঙ্গোলীয় জাতির সম্প্রদায় এ তৃণভূমি উপহার হিসেবে ছিং রাজবংশের সম্রাটকে দেয়। ভৌগলিক ও প্রাণী বন্টনের অবস্থা অনুযায়ী, ওয়েই ছাংকে ৭২টি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। সম্রাট এসে শিকার করার সময় নিজের বাহিনী ছাড়া নিকটবর্তী মঙ্গোলীয় জাতির সৈন্যরাও এসে একসাথে সম্রাটের নিরাপত্তা রক্ষা করে। শিকার শুরুর আগে সৈন্যরা পূর্ব নির্ধারিত অঞ্চলকে ঘেরাও করে এবং যথাক্রমে ছোট করে দেয়। যখন এ ঘেরাও আকার যথেষ্ঠ ছোট হয়ে যায়, বন্য প্রাণীরা সব ভিতরে অবস্থান করে, তখন শিকার শুরু হয়। প্রথমে মন্ত্রীর অনুরোধে সম্রাট প্রথম তীর নিক্ষেপ করেন। তারপর রাজকুমার ও রাজ পরিবারের অন্যান্য সদস্য তীর নিক্ষেপ করেন। অবশেষে সম্রাটের সঙ্গী মন্ত্রী ও সৈন্যরা তীর নিক্ষেপ করেন।
প্রতিবার শিকারের মেয়াদ বিশ দিনেরও বেশি। শিকার শেষ হওয়ার পর মনোজ্ঞ ভোজ সভার আয়োজন হয়। তাঁরা নাচ গান করেন, মদ খান, কুস্তি প্রতিযোগিতা করেন, মঙ্গোলীয় জাতির নেতাদের দাওয়াত দেন এবং তাঁদের সামরিক কীর্তি অনুসারে পুরস্কার দেন। ওয়েনছাং জেলায় এখনো তুংমিয়াও মন্দির, ছিয়ানলোং সম্প্রাটের বাঘ শিকার করার গুহাসহ ছিং রাজবংশের সম্রাটের শিকার করা সংক্রান্ত দশ বারোটি বিশেষ পুরাকীর্তি সংরক্ষিত রয়েছে।
ছিং রাজবংশের সম্রাটদের শিকার করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল চীনের উত্তরাংশ ও পশ্চিমাংশের তৃণভূমির যাযাবর জাতির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা। এ জন্য সম্রাটরা ওয়েইচাংয়ের বাইরে দশ বারোটি বড় আকারের রাজকীয় মন্দির নির্মান করেন। এ মন্দিরগুলো সব মঙ্গোলীয় জাতি ও তিব্বতী জাতির লামা ধর্মাবম্বীদের জন্য নির্মিত হয়। কারণ সম্রাটরা মনে করেন, প্রতিপক্ষের ধর্ম বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে সাম্রাজ্যের শান্তি মজবুত হবে। এখন এ সব মন্দির মূল্যবান ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি এবং পর্যটকদের জনপ্রিয় পর্যটন স্থানে পরিণত হয়েছে। পথনির্দেশক মিস. লিউ জানান, 'ছেংদের এ ১২টি রাজকীয় মন্দিরকে ওয়েইবা মন্দির বলা হয়। ১৯৯৪ সালে ওয়েইবা মন্দির আর বিশু শানচুং উভয় বিশ্বের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার তালিকাভূক্ত হয়েছে।'
চীনের হান জাতির ঐতিহ্যগত স্থাপত্য আর তিব্বত, মঙ্গোলিয়া ও সিনচিয়াসহ অন্য অঞ্চলের স্থাপত্যের রীতি এখানে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মিশ্রিত হয়েছে। বিভিন্ন জাতির লোক এখানে নিজ নিজ বিশ্বাসী দেবতার খুঁজে পান। পৃথিবীতে কাঠ দিয়ে তৈরি সবচেয়ে বড় আকারের দেবতার মূর্তি – হাজার হাত, হাজার চোখ কুয়ানইন বধিসভা মূর্তি এখানে রয়েছে। পথনির্দেশক লিস লিউ গর্বিত কণ্ঠে বলেন, 'আমাদের এখানে একটি প্রবাদ আছে, হুয়াং পাহাড় থেকে ফিরে এসে আর পাহাড় দেখার দরকার নেই। ছেংদে থেকে ফিরে এসে আর মন্দির দেখার দরকার নেই। কারণ ছেংদের মন্দিরগুলো দেখতে যেমন সুউচ্চ, তার রীতিও বৈচিত্রময়। এটা হচ্ছে হান, মঙ্গোলীয় ও তিব্বতী জাতির সংস্কৃতি মিশ্রণের দৃষ্টান্ত। এখন ছেংদে বুদ্ধ ধর্মের সাংস্কৃতিক ও বিনোদন পর্যটন অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।'
বহু বছর ধরে স্থানীয় সরকার এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রে জোর দিয়েছে। তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় কৃত্রিম বন সৃষ্টি করেছে। বিশাল তৃণভূমি ও বন সমুদ্রের মাধ্যমে উত্তর চীনের সত্যিকারের ফুসফুস গড়ে উঠেছে। ওয়েইচাং জেলায় জাতীয় পর্যায়ের প্রাকৃতিক তিনটি সংরক্ষণ অঞ্চল রয়েছে, প্রাদেশিক পর্যায়ের প্রাকৃতিক সংরক্ষণ অঞ্চল রয়েছে দুটি। বনাঞ্চলের হার দাঁড়িয়েছে ৫৫ শতাংশ। ওয়েইছাং জেলা প্রাকৃতিক পরিবেশ আর কৃষি খাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধের সামর্থ্য উন্নত করার জন্য গত দশ বছরে মোট ৯০ কোটি ইউয়ান ব্যয় করেছে। এর মাধ্যমে ওয়েইছাং জেলাকে 'চীনের প্রাকৃতিক দৃষ্টান্ত অঞ্চল' হিসেবে পরিণত করা হয়েছে। (ইয়ু কুয়াং ইউয়ে)
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |