|
শানহাইকৃয়ান পাসের ওপর বিশাল আকারের ঢাক্, যাকে চীনা ভাষায় বলো 'কুউ'। এটা বাজালে পূণ্য হয় বলে সবাই একবার হলেও বাজায়
দু'পাশে দেখা যায় বিস্তির্ণ এলাকা জুড়ে ফসলের ক্ষেত আর ক্ষেত। কোথাও বা ফসল কেটে নেবার পর খোলা প্রান্তর। দেখলাম সাত সকালেও কৃষকরা ফসল ফলাতে কী নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে গড়ে উঠেছে দোকান পাট। খাবারের দোকান, মুদি দোকান, তবে তা ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মতই। দিন বাড়ার সাথে সাথে রাস্তার পাশে হকাররাও পণ্য নিয়ে বসতে শুরু করেছে। সেই সাথে দেখলাম ছোট ছোট গাড়ি মেরামত ও সারানোর বেশ কিছু দোকান। দেখে ভালো লাগলো যে, গাড়ি বা সাইকেল সারানোর অবসরে তারা দিনের সংবাদ পত্র পড়ছে নিশ্চিন্ত মনে। যেতে যেতে পথের পাশে পড়ছে ছোট ছোট শহর। ঠিক আমাদের উপজেলার মত। তবে তা অনেক পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। আমাদের গ্রামের মত রাস্তার দু'পাশে হাট বসেছে। আমার বন্ধু শেনইয়াংয়ের চাং ই বললো, পল্লী এলাকার কোন কোন স্থানে এসব বাজার বসে সপ্তাহে দু'বার কি তিনবার। শানহাইকুয়ান আসতে গিয়ে চলার পথে আমার মাঝে মাঝে মনে হয়েছে আমি যেন আমার দেশের গ্রামের সবুজে ছাওয়া গাছ আর বাঁশ ঝাড়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
শানহাইকুয়ান রেল স্টেশন
প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা যাত্রার পর আমরা এসে নামলাম শাংহাই কুয়ান। হোবেই প্রদেশের একটি ঐতিহাসিক শহর। নেমেই আমাদের প্রথম কাজ ছিল আমাদের আগামীকাল বেইদাহ্ থেকে পেইচিং আর শেন ইয়াং ফিরে যাবার টিকিট কেনা। একই ফাঁকে আমি ঘুরে ফিরে এ এলাকার আশে পাশের বেশ কিছু ছবি তুলতে ভুলি নি। একটি রেস্তোরাঁয় কিছু একটা খেয়ে নেয়ার সময় দু'টি চীনা শিশুর সাথে খুব ভাব হলো। তারাতো আমাকে ছেড়ে তাদের মা বাবার কাছে যেতেই চাচ্ছিলনা। যদিও আমাদের ভাষা ভিন্নতর। তবে আন্তরিকতার টান কোন বাধার সৃষ্টি করে না। শিশুরাতো আদর প্রিয়। যেখানে তাদের ভালো লাগে সেখানেই তারা আরাম বোধ করে। সেখানেই তারা খেলায় মেতে ওঠে।
মা খেলনা কিনে দিতে দেরি করায়, দুষ্টুমি করে লাফ দিচ্ছে একটি শিশু
এই সেই শানহাইকুয়ান পাস। পেইচিং থেকে এর দূরত্ব ৩১৫ কিলোমিটার। এখানে আসতে সময় লাগে প্রায় চার ঘন্টার মত। কিন্তু আমরা এসেছি হুলুদাও থেকে। আমাদের সময় লেগেছে প্রায় আড়াই ঘন্টার মত। আমাদের হাতে সময় খুব কম। এখানে শানহাইকুয়ান পাস দেখে তারপর যেতে হবে ছিনহুয়াংদাও। পথে হয়তো কিছুটা সময় বেইদাহের সাগর তীর ঘুরে যেতে পারি। ২০০৬ সালে আমি যখন এখানে মানে চীনে প্রথম আসি তখন গ্রীষ্মকালে এই বেইদাহের সাগর তীরে তিন দিনের জন্য আসার সুযোগ হয়েছিল বেতারের নতুন আসা প্রায় সকল বিশেষজ্ঞের সাখে। তখন বেতারের বিদেশ বিভাগের পরিচালক ছিলেন নিউ দাও বিন। খুব অমায়িক মানুষ। খুবই বন্ধু বত্সল। এখন তিনি চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করছেন। যখনই কোথাও যাই। তার কথা খুব মনে হয়। এবারের সফরে তার কথা মনে হলো এ জন্য যে তারই ব্যবস্থাপনায় আমরা সাগর তীরে বিশাল এলাকা জুড়ে নির্মিত ইয়াও ই পিংগুয়ান অর্থাত্ মৈত্রী হোটেলে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেবার খুব জমেছিল আমাদের আড্ডা। কারণ দলবেধে এ ধরনের ভ্রমণ ছিল আমার জীবনে প্রথম। শ্রীলংকার রভিমল হান্ডুওয়ালা আর আমি ছিলাম একটি রুমে। তার তারণ্যময় তাজা প্রেমের কাহিনী আমাকে রাতভর শুনতে হয়েছিল এবং সেই সাথে দিতে হয়েছিল ভবিষ্যত পরামর্শ।
শানহাইকুয়ান পাসের ওপর চারতলা পর্যবেক্ষণ ভবন। এ ভবনের ওপর থেকে চার দিকে নজর রাখা যায়
ফিরে আসি শানহাইকুয়ানের কথায়। শানহাইকুয়ান রেল স্টেশন থেকে আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে আসি শানহাইকুয়ান পাসে। যাকে কি না বলা হয় 'স্বর্গের নিচের প্রথম পথ। প্রথম প্রবেশ পথ বললেও ভুল হবে না। লালোংথউ (এর অর্থ হল বৃদ্ধ ড্রাগনের মাথা) গ্রেট ওয়াল থেকে শানহাইকুয়ান মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে। শানহাইকুয়ান গ্রেট ওয়াল ধরে একটানা হেঁটে গেলে সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় ঘন্টা লাগতে পারে একেবারে সমুদ্রের পানিতে নেমে যেতে। ভাটার সময়ও এ দেয়াল সাগরের পানির ভেতরেই থাকে। এখানেও একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে, যেখান থেকে সমুদ্র পথে কেউ আসলো কি না তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য। ভাবাই যায় না যে তখনকার দিনে এত বিশাল আকারের পাথরের দেয়াল কী করে নির্মাণ করতে পেরেছিল?
ট্যাক্সি থেকে আমরা যখন হেঁটে হেঁটে সামনের দিকে এগুচ্ছি, তখন আমার কাছে মনে হচ্ছে একটি সবুজ ছায়া ঘেরা পাহাড়ি বনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। একই সাথে রাস্তার দু'পাশে রয়েছে জমকালো রেস্তোরাঁ আর চোখ ধাধানো সব পণ্য। আমরা টিকিট কেটে শানহাইকুয়ান গ্রেট ওয়ালে ওঠে পড়লাম। বেশ উঁচু, বয়স্কদের জন্য একটু কস্টকরতো বটেই। ওপরে উঠেই প্রবেশ মুখে দেখলাম বড় সড় দু'টি কামান। তার ওপর বসে লোকজন ছবি তুলছে ইতিহাসটাকে নিজের কাছে স্মৃতিময় করে রাখার জন্য।
শানহাইকুয়ান পাসের ওপরে প্রবেশ মুখে থাকা কামানের পাশে লেখক ও অপর পাশে শেনইয়াং-এর প্রাদেশিক সরকারের আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি বিনিময় কেন্দ্রের পরিচালক 'চাং ই'
শানহাইকুয়ান পাসের ওপরে উঠে আমার মনে পড়লো সেই অতীত ইতিহাসের কথা। হেবেই প্রদেশের ছিনহুয়াংদাও শহরের উত্তর পূর্ব দিকের এ দেয়ালটি মিং ডাইনাস্টির (১৩৬৮-১৬৪৪) রাজত্বকালে ১৩৮১ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। এটি দক্ষিণ পূর্ব দিক দিয়ে প্রসারিত হয়ে বোহাই সাগরে গিয়ে মিশেছে এবং উত্তর পশ্চিম দিক দিয়ে ইয়ানশান পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চলে গেছে। একে সংযুক্ত করে রয়েছে চারটি প্রধান গেট। পূর্ব দিকে চানদুং (Zhendong) গেট, দক্ষিণ দিকে ওয়াংইয়াং (Wangyang) গেট, পশ্চিম দিকে ইংয়েন (Ying'en) গেট এবং উত্তর দিকে ওয়েইউয়ান (Weiyuan) গেট। তখনকার দিনে সরকারী কর্মকর্তা বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এ গেটটিই যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতেন। মান্চুরিয়ানরা চীন আক্রমনের সময় দেশের কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আত্মসমর্পণ করে বিনা যুদ্ধেই এ গেট খুলে দিয়েছিল তাদের প্রবেশের জন্য। (চলবে) - আবাম. ছালাউদ্দিন
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved. 16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040 |