ঘরের দেয়ালে লাগানো রয়েছে মহিশ, লম্বা লোমওয়ালা পাহাড়ি গরু আর হরিণের বিশাল শিং ওয়ালা মাথা আর একটি ঘরে দেখলাম একটি প্রাচীনকালের ঘড়ি। বেশ বড় এ ধরনের ঘড়িগুলো সাধারণত দোলকের সাহায্যে চলে। চলার সময় শব্দ করে চলে। অনেকটা দূর থেকেও তার শব্দ শোনা যায়। এ ধরনের ঘড়ি বরিশালে আমার দাদার বাড়িতেও একটি ছিল। সে যখন চলতো তখন হালকা শব্দে ঢং ঢং করে তার আওয়াজ চারদিকে ছড়িয়ে যেতো। এখনো আমার মনে আছে আমার দাদীকে দেখতাম প্রতি মঙ্গলবার তাতে চাবি দিতে। আমার দু:খ সেটি এখন আর আমাদের সংগ্রহে নেই। দাদী মারা যাওয়ার পর কে যেন সেটা হাতিয়ে নিয়েছিল। শিল্পী যে শুধু একজন শিল্পীই নন, তিনি যে একজন সৌখিন ব্যক্তিও বটে, তা তার এই ঘর দেখেই অনুভব করা যায়। দেখলাম বসার ঘরে সাউন্ড সিস্টেমের মনিটরসহ প্রতিটি ঘরের দেয়ালেই লাগানো রয়েছে ৩৬ ইঞ্চির এল সি ডি টিভি। দেখতে পেলাম বিছানার ওপরও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ক্যামেরার যন্ত্রাংশ এবং পৃথিবীর অনেক দেশের সংগীত যন্ত্র। বিশেষ করে তাঁর পড়ার ঘরে গিয়ে অবাক হলাম তাঁর বইয়ের সংগ্রহ দেখে। তিনি জানালেন সংগীত সাধনার পাশাপাশি তিনি গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বই পত্র পড়েন। এটা যেন তার নেশার মত। অনেক আলোকচিত্র তাঁর ঘর জুড়ে। অনেকগুলো এ্যালবাম। সবগুলোই ঢাসা প্রকৃতি আর বিভিন্ন সময়ে তার নিজের তোলা এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশনারত তার আলোকচিত্রে। জানলাম এ গুণি শিল্পীটি আলোকচিত্র শিল্পেও চীনসহ বিদেশ থেকেও পুরস্কার পেয়েছেন। আসলো সংস্কৃতি ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ যেন সমুজ্জ্বল বর্ণিল আলোয় ভরা। আরো জানলাম এত সাধনার মাঝেও তিনি নিজেই রান্নার কাজে তার স্ত্রীকে নিয়মিত সাহয্য করেন। নিজে বহু ধরনের খাবারও তৈরি করতে পারেন। চেখে দেখার সৌভাগ্য হলো তার তৈরি মিষ্টি জাতীয় খাবার। দারুণ মজার হয়েছিল। স্বাদটা এখনো জিভে লেগে আছে। লক্ষ্য করলাম আমাদের সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে তিনি এবং তার স্ত্রী নাইকনের ডি ৯০ ক্যামেরা দিয়ে আমাদের সবার ছবি তুলছেন। তাঁর সংগীত চর্চা ও সংগীত পরিবেশনার ঘরটি হলো বসার ঘরেই। আধুনিক স্ট্যান্ড মাইক্রোফোন, স্পীকার ও টিভি মনিটর এ ঘরেই রয়েছে। আমাদের অনুরোধে তিনি সম্মত হলেন আমাদের সবাইকে তার নিজস্ব সৃষ্টি যন্ত্র সংগীতের সুর আর পাখির সুমধুর ডাক শোনাতে। তিনি যে পাখির রাজত্বে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন তা তার কন্ঠে পাখির ডাক শুনেই বুঝতে পেরেছি। আঙ্কেল বার্ড পাখির ডাকসহ ৮ শ'রও বেশি সুর বাজাতে পারেন। যা কি না বলতে গেলে অবিশ্বাশ্য। তিনি যখন আমাদেরকে তার কন্ঠে পাখির ডাক শোনাচ্ছিলেন, চেনা অচেনা সব পাখির ডাক। তার ছোট্ট বাড়িটিকে ঘিরে থাকা সবুজ প্রকৃতির মাঝে বসে তখন আমার কাছে মনে হচ্ছিল যেন আমি বাংলাদেশের সুন্দরবন, সিলেটের লাউয়াছড়া বা পাহাড়ি কোন গভীর বনের সবুজের ভেতর বুক চিতিয়ে শুয়ে আছি ঝিরিঝিরি হাওয়ার আলো ছায়ার খেলায়। মনে হচ্ছিল এসব পাখিরা যেন আমার চার পাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। আসলে তিনি আমাদেরকে প্রাচীন ও আধুনিককালের ছো্ট বড় মিলিয়ে বিশটি সংগীত যন্ত্রে সুর বাজিয়ে শোনালেন। আরো শোনালেন দু' আঙ্গুল আর ঠোঁট দিয়ে বাজানো বিভিন্ন রকমের সুর। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম এবং ফাঁকে ফাঁকে তার ছবি তুলছিলাম। আমাদের সাথে থাকা আমেরিকান মেয়েটাতো তার সুরের ধ্বনি শেষ হবার পরও বেশ কিছুক্ষণ ঝিম দিয়ে বসেছিল। সবাই এতটাই আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েছিলাম যে সবাই মিলে তার সাথে ছবি তুললাম তার নিজের সংগীত যন্ত্র নিয়ে বলতে গেলে অনেকটা বাজানোর ভান করেই। কারণ এসব যন্ত্রের বেশির ভাগই চীনের ঐতিহ্যিক ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের হওয়ায় এগুলো সম্পর্কে আমার খুব বেশি একটা পূর্ব ধারণা ছিল না। তার স্ত্রীও দেখলাম বেশ কয়েকটা যন্ত্র বাজাতে পারেন। তারা দু'জনে মিলেও আমাদের চীনা সংগীতের কয়েকটা সুর বাজিয়ে শুনিয়েছিলেন। আঙ্কেল বার্ড যার আসল নাম হলো ইয়ান ফুশিং (Yan Fuxing)। তিনি চীনের প্রথম শিল্পী যিনি ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে সব রকমের সুর সৃষ্টি করতে পারেন। তিনি দেশি বিদেশি আটশ' রকমের বাদ্য যন্ত্রে দু' হাজারেরও বেশি সুর বাজাতে পারেন। তার এসব বাদ্য যন্ত্র আঙ্গুল দিয়ে বাজানো সুর এবং মনোহরি অবিকল পাখির ডাক তিনি চীনসহ পৃথিবীর বহু দেশে পরিবেশন করেছেন এবং দারুণভাবে সম্মানিত ও পুরস্কৃত হয়েছেন। এসব অনুষ্ঠানে কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র প্রধানও উপস্থিত ছিলেন। সাফল্যের বরণ ডালায় তার আরো একটি দিক রয়েছে তা হলো দড়াবাজি। যাকে কি না আমরা ইংরেজিতে বলি এ্যাক্রোবেটিক। এতেও তিনি দারুণভাবে পারদর্শি। (চলবে)–আ বা ম. ছালাউদ্দিন
1 2 3 4